একটু ইতিহাস ঝালিয়ে নিই। প্রথম স্তরের অ্যানাটমির জ্ঞান ছিল অ্যানাটমির পুস্তকের পাঠের জ্ঞান, যা ছিল প্রধানত গ্যালেনের বই থেকে আহরিত এবং গ্যালেন নিজে ছাগল এবং বাঁদরের অতিরিক্ত একটি মনুষ্যদেহেও শবব্যবচ্ছেদ করেননি। সেসময় চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগৎ-কে নিয়ন্ত্রণ করছে “হিউমার” বা “ত্রিদোষ তত্ত্ব”-র ধারণা। একে অনেকেই “ফিলসফিক্যাল অ্যানাটমি” তথা দার্শনিক অ্যনাটমি বলে থাকেন। কারণ? এই স্তরের অ্যানাটমির জ্ঞানের দুটি নমুনা চিত্র। যে কেউ সহজেই বুঝবেন এখানে দেহকে দ্বিমাত্রিক হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। এবং দেহের এই বোধ পণ্য দুনিয়ার কোন কাজেই লাগবেনা।
Internal anatomy. 15th century anatomical diagram of the internal organs of the human head and torso. The diagram, known as a ^Isitus figure^i, is labelled in Latin and is from Johann Peyligk’s ^IPhilosophiae Naturalis Compendium^i (Leipzig, 1499).এর পরবর্তী সময়ে প্রধানত ১৫শ শতাব্দী থেকে ইটালিকে কেন্দ্র করে শব্যবচ্ছেদ-কেন্দ্রিক অ্যানাটমি শিক্ষা পুরোদমে শুরু হল। শব্যবচ্ছেদ করতেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং মাইকেলেঞ্জেলোর মতো শিল্পীরা, যে জ্ঞান ভেসালিয়াসের মতো ডাক্তারের হাতে পড়ে একেবারে ভিন্ন চরিত্র পেয়ে গেলো। একে বিশেষজ্ঞরা বলছেন “medical anatomy” – দেহের শরীরী অনুধাবনে ত্রি-মাত্রিক ধারণা একমাত্র হয়ে উঠলো। দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এলো দেহসংক্রান্ত ধারণায় ও চিকিৎসার সংস্কৃতিতে এবং বৌদ্ধিক জগতে – (১) অসুখ তথা রোগ যে দেহের অভ্যন্তরে অঙ্গসংস্থানের মধ্যে থাকে (organ localization of disease), কোন কল্পিত হিউমার বা “ত্রিদোষ তত্ত্ব”-তে নয় এ ধারণা এবং (২) মৃতদেহকে ভালো করে বোঝার মধ্য দিয়ে জীবিত দেহের ধারণা অর্জন করা যাবে – “The dead teach the living”। দেহকে বোঝার জন্য এক ধরনের নির্লিপ্তি বা নৈর্ব্যক্তিকতা চিরকালের জন্য অবিচ্ছেদ্যভাবে প্রবেশ করলো মেডিসিনের জগতে। এ নির্লিপ্তি বা নৈর্ব্যক্তিকতা দর্শনের পরিধিতে বিবেচনার ও আলোচনার স্তরের নৈর্ব্যক্তিকতা নয়, পরীক্ষিত ধারণার মধ্য দিয়ে লব্ধ নির্লিপ্ত নৈর্ব্যক্তিকতা – নৈর্ব্যক্তিকভাবেই মানুষের দেহ এবং অস্তিত্বকে কাগজের ওপরে প্লট করে ফেলা সম্ভব গ্রাফের চেহারায়, যেমন ভুগোলে হয়। আমি এ স্তরের অ্যানাটমির জ্ঞানকে বলছি “দ্বিতীয় স্তর”-এর অ্যানাটমির জ্ঞান।
আমরা দ্য ভিঞ্চির আঁকা দুটি শৈল্পিক ত্রিমাত্রিক ছবি দেখে নিই।
ভেসালিয়াসের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় অতি নিখুঁত ড্রয়িং-এর তুলনা করলে দ্য ভিঞ্চির শৈল্পিক সুষমা আরো ভালো বোঝা যাবে। ভেসালিয়াসের ত্রিমাত্রিক দুটি ছবি – দেহের মাংসপেশি ও মস্তিস্ক নিয়ে।
আমরা এখন হালের দুনিয়ায় আসতে পারি। গত ২১শে ম, ২০১৮ সমস্ত সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিল কলকাতায় প্রথম সফল হৃদপিণ্ড সংস্থাপন বা ট্র্যান্সপ্ল্যান্টের বিবরণ। সবাই কমবেশি স্মরণ করতে পারবেন সে ঘটনা। বাঙ্গালোরে পথ দুর্ঘটনায় মারা গেল ২১ বছরের এক তরুণ বরুণ ভি কে। কলকাতার ফর্টিস হাসপাতালে ভর্তি ছিল দিলচাঁদ সিং “irreversible severe cardio-myopathy” নিয়ে। তামিলনাড়ু, কর্ণাটক এবং পশ্চিমবাংলার অর্থাৎ তিনটি রাজ্যের চিকিৎসকেরা এক প্রদেশের হৃদপিণ্ড সংস্থাপন করলেন আরেক প্রদেশের ব্যক্তির দেহে। যদি রাজনীতির প্রেক্ষিতে মেডিসিন ও দেহকে ভাবি তাহলে দেহের রাজনীতির এবং বায়োমেডিসিনের এ হচ্ছে মানবিক মুখ, যা দেহের রাজনীতির বয়ানে অনির্বচনীয় আনন্দ বা bliss-এর স্বাদ আনে। আবার অন্যদিক থেকে থেকে দেখলে বায়োমেডিসিন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী জ্ঞানের ডিসিপ্লিন হিসেবে ফুকোর ভাষায় একটি “docile body” বা “অনুগত” দেহের জন্ম দিচ্ছে। আমাদের প্রতিদিনের কারবার এই অনুগত দেহ নিয়ে। এ দেহগুলো disciplined, বাধ্য এবং মেডিসিনের প্রয়োজনে এদের ওপরে সমস্ত রকমের পরীক্ষানিরীক্ষা করা যায়। কিন্তু দেহ যদি অনুগত না হয়? সেখানে রাষ্ট্র এসে সরিয়ে দেবে মেডিসিনকে, মেডিসিনের জ্ঞান তখন রাষ্ট্রের সাথী হবে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। আমরা তখন “অবাধ্য দেহ” ঐশী ঘোষদের কিংবা শাহিনবাদের নারী-বৃদ্ধা-শিশুদের বা উত্তরপ্রদেশের ২৩টি লাশ দেখবো।
দেহের ওপরে রাষ্ট্রের চিহ্ন এঁকে দেবার একটি ঐতিহাসিকভাবে পরীক্ষিত দিক হল মৃতুদণ্ড দেওয়া। আমরা যারা ফুকোর Discipline and Punish বইটি পড়েছি তারা ঐ বইয়ের প্রথম দুটি অধ্যায়ে দেখেছি প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দানের গ্রাফিক বর্ণনা। গা শিউড়ে ওঠা, দেহের প্রতিটি অনুভূতিকে অবশ করে দেওয়া সে বিবরণে আমরা জেনেছি দেহের ওপরে রাষ্ট্রের, রাজনীতির এবং দণ্ডনীতির কি ভয়াবহ পরিণামচিহ্ন এঁকে দেওয়া যেতে পারে – “দু-তিনবার চেষ্টা করার পরে, ঘাতক স্যামসন এবং যে অভিযুক্তের শরীর চিমটে দিয়ে মাংস ছিঁড়ে নিচ্ছিল তারা দুজনেই তাদের পকেট ঠেকে ছুরি বের করলো এবং ব্যক্তিটির দেহ অস্থিসন্ধি থেকে আলাদা আলাদা টুকরো করার বদলে দুই ঊরু কেটে ফেললো। এরপরে দুদিক থেকে দুটো ঘোড়া বিপরীতদিকে টানতে থাকলো আর দুই ঊরু আলাদা হয়ে গেলো – প্রথমে ডান দিক, পরে বাঁ দিক, এভাবে চারটে অঙ্গকে ছিঁড়ে ফেলা হলো। এরপরে যাজক এলো ওর স্বীকারোক্তি নেবার জন্য।”
আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার অসংখ্য ঘটনায় আমরা দেখি যে মেডিসিনে suffering বা ক্লিষ্টতাকে ধারণ করার কোন ক্ষেত্র বা স্পেস নেই। এখানে একটি মৃত্যু কেবলমাত্র একজনের “অদৃশ্য” বা “অপসৃত” হয়ে যাওয়া, কোন loss বা বেদনা হিসেবে লেখা হয়না। পল ফার্মার তাঁর Pathologies of Power পুস্তকে আলোচনার শেষ দিকে এসে বুলেটবিদ্ধ ম্যানো-র কথা বলেছেন। ম্যানো-র শরীরে, তার অ্যানাটমির মাঝে বুলেট লুকিয়ে আছে। “Manno’s attacker is in jail; there’s now less impunity in Haiti than there was a few years earlier. But that doesn’t help Manno get his left leg fixed. The bullet is still there, still lodged in his flesh, the fractures unpinned. Haiti does not guarantee its citizenry access to orthopedic hardware, although most anything can be bought for the right price. The word “insurance” is unknown among the poor.” একে ফার্মার বলছেন “স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স”।
আধুনিক মেডিসিন দেহের অঙ্গসংস্থান দিয়ে মানুষকে জানে, আর্থিক সঙ্গতির হদিস রাখেনা। নৈর্ব্যক্তিক মানুষকে জানে, তার সাফারিং বা ক্লিষ্টতাকে জানেনা। শুধু তাই নয়, অ্যানাটমির জ্ঞান নিবিড়ভাবে সংম্পৃক্ত হয় পণ্যজগতের মুনাফা উৎপাদনের কাজে। অ্যানাটমি দিয়ে জানা হয় পণ্য দুনিয়াকে, আবার পণ্যজগতের সাথে মিথষ্ক্রিয়ার অ্যানাটমির ধারণা নতুন চেহেরায় প্রতিভাত হয়। অ্যানাটমির এই বিশেষ ধারণাকে বলছি “তৃতীয় স্তরের” অ্যানাটমির জ্ঞান – মানুষের দেহ ও অস্তিত্ব যেখানে পণ্য, পণ্য তার দেহের সম্ভাব্য প্রতিটি অংশ।
দেহের ওপরে রাষ্ট্রের কর্তৃ্ত্ব খুব প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে মৃত্যুদণ্ড দেবার সময়। একবিংশ শতাব্দীতেও এর খুব তীক্ষ্ণ, নির্মম এবং অভ্রান্ত চেহারা দেখা যাবে আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ডের বিবর্তনের মাঝে। ১৯৭৬ অবধি আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত “death by firing squad”-এ। কিন্তু সময়ের সাথে বিচারব্যবস্থা দেখলো এধরনের মৃত্যু “too bloody and uncontrolled”। একাধিক মানুষকে গুলি করার পরেও তক্ষণাৎ মৃত্যু হয়নি। এ কেমনতরো কথা? গণতান্ত্রিক দেশে একজন “অপরাধীকে” মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে অথচ সে একবারে মারা যাচ্ছেনা। সমাজের চোখে খারাপ দেখানোর চাইতেও, আমার বিচারে, রাষ্ট্রের অভ্রান্ততা প্রশ্নের মুখে পড়ছে এরকম মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতিতে এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
এরপরে এল ফাঁসী। কিন্তু এটাও “came to be regarded as still more inhumane”। তারপরে এলো নাৎসী হিটলারের মতো গ্যাস চেম্বারের মৃত্যু। কিন্তু ১৯৯২ সালে অ্যারিজোনা রাজ্যে ডোনাল্ড হার্ডিং-এর মৃত্যু ঘটতে ১১ মিনিট সময় লেগেছিলো। ১৯৭৬ থেকে আজ অব্দি ২ জন বন্দীকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হয়েছে, ৩ জনকে ফাঁসীকাঠে ঝুলিয়ে এবং ১২ জনকে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ইলেক্ট্রিক শক (২৬০০ ভোল্ট) দিয়ে মারার পদ্ধতি চালু হল এবং এখানে এসে আবার একটি গোল বাঁধলো। ১৯৭৯-তে এক বন্দীকে ২৬০০ ভোল্টের শক পরপর দুবার দেবার পরেও ২০ মিনিট ধরে তীব্রতম যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন মুখ নিয়ে বেঁচে ছিল। রাষ্ট্রের অসমপূর্ণতা, অকার্যকারিতা আরেকবার প্রমাণিত হল। দেহের ওপরে রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকার এবং মৃত্যুদণ্ডের রাজনীতি পূর্ণত প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও “মুক্তচিন্তার” রাষ্ট্র কাজটি সুসম্পন্ন করতে পারছেনা। দেহের ওপরে রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্বের সাফল্যের ক্ষেত্রে এক বড়োসড়ো প্রশ্ন চিহ্ন উঠে যায়। রাষ্ট্রের পক্ষে একে হজম করা সম্ভব নয়।
ফুকোর গবেষণার এক নতুন চিত্রনাট্য যেন দেখতে পাচ্ছি একবিংশ শতাব্দীতে সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকায়। দেহের রাজনীতির এক নতুন চেহারাও বটে। গ্যাস চেম্বার পরবর্তী মৃত্যুদণ্ড দানের পরবর্তী পদ্ধতি হল “lethal injection”। কি দিয়ে তৈরি এ ইঞ্জেকশন? ২৫০০-৫০০০ মাইক্রোগ্রাম সোডিয়াম থায়োপেন্টাল (জীবিত দেহে অপারেশনের সময়ে এর সর্বাধিক ডোজ ২৫০ মাইক্রোগ্রাম), ৬০-১০০ মিলিগ্রাম pancurium বলে একটি রাসায়নিক পদার্থ যা সবকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবশ করে দেয় এবং এই ডোজ স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। এরপরেও দেওয়া হয় ১২০-২৪০ মি.ইকুইভ্যালেন্ট পটাশিয়াম। চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে মান্য পত্রিকা নিঊ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর নিবন্ধে একটি মন্তব্য করা হল – “Officials liked the method”, কারণ মৃত্যু ঘটানোর জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিকগুলো অ্যানাস্থেসিয়াতে ব্যবহৃত হয়। আরেকটি বড়ো কারণও ছিল – আমেরিকার সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর “cruel and unusual” মৃত্যুকে নিষিদ্ধ করেছে।
এটা জেনেও ভালো লাগে যে, রাষ্ট্র-নির্ধারিত মৃত্যু, ব্যক্তি দেহের মৃত্যু, যাতে নিষ্ঠুর এবং অস্বাভাবিক না হয় সেজন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানকে সাথী করে রাষ্ট্রের কি গভীর “মানবিক” অনুভব! নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর উদ্যোগে ২০০৮ সালে একটি প্যানেল ডিসকাশন হয়েছিল – “Discussion of Lethal Injection” শিরোনামে। সে আলোচনায় আইনের পরিচিত অধ্যাপক ডেবোরা ডেনো খুব মিহি করে জানিয়েছিলেন – “pancuronium bromide is used in order to enhance the dignity of the inmate who’s dying, because without pancuronium, there might be some jerking or involuntary movements that would disturb some of the witnesses.” যে মানুষটির legalized killing হচ্ছে তার “dignity” ত্বরাণ্বিত করার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে ১০গুণ বেশি ডোজে দেওয়া হচ্ছে pancuronium! অথচ রাষ্ট্রের তরফে সজোরে এবং সগর্বে প্রকাশ করা এ যুক্তিকে অস্বীকারও করা যাবেনা। কারণ আমরা অর্থাৎ সামাজিক মানুষ ও নাগরিক আগেই এর পূর্ববর্তী স্তর দেহের ওপরে মৃত্যূদণ্ড কায়েম করার নৈতিক, আইনী ও সাংবিধানিক অধিকার মেনে নিয়েছি। সাধারণভাবে সামাজিক মান্যতা পেয়েছে রাষ্ট্রের operating techniques, রাষ্ট্র উৎপাদিত জ্ঞান বা logos।
আমরা নিশ্চয়ই খেয়াল করবো যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নতুন করে সামনে এলো – (১) অ্যানাস্থেটিক এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত ওষুধ যখন মৃত্যু ঘটানোর কাজে ব্যবহার করা হয় তখন চিকিৎসক তথা অ্যানেস্থেটিস্টের উপস্থিতি প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়, (২) মেডিসিনের জ্ঞান – অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি – নির্ভুল্ভাবে মিশে গেল রাষ্ট্রের হত্যাকাণ্ডের সাথে, (৩) একজন ব্যক্তি – নাগরিক, বন্দী কিংবা মৃত্যুদণ্ডের আসামী যেই হোকনা কেন – তার ত্বকের সাহায্যে, শরীরের অঙ্গসংস্থানের মাঝে এ যন্ত্রণা অনুভব করে।
আমরা এবার ত্বকের অ্যনাটমিক্যাল গুরুত্বের হদিশ পেলাম – দেহের আভ্যন্তরীন space বা অঞ্চল (corporal space) থেকে পৃথক করছে প্রতিটি আলাদা এবং একক ব্যক্তির মধ্যবর্তী অঞ্চল তথা non-corporal space তথা মধ্যবর্তী ভউগোলিক অঞ্চলকে। ১৯শ শতাব্দীতে জন্ম নেওয়া ও বিকশিত হওয়া medical policing এবং স্যানিটারি সায়ান্সের প্রধান মনোযোগের স্থান হয়ে দাঁড়ালো corporal space এবং non-corporal space-এর মধ্যস্থিত এই ভৌগোলিক অঞ্চলটি। তাহলে একদিকে রইলো দেহের অ্যানাটমিক্যাল স্পেস, অন্যদিকে রইলো একটি non-corporal ভৌগলিক স্পেস। এই দুটি স্পেসের মধ্যে নিরন্তর বস্তুসামগ্রীর যাতায়াত একধরণের নতুন অ্যানাটমিক্যাল চেহারা ধীরে ধীরে খোদাই করে তুললো। শাস্তিদান, মৃত্যুদণ্ড ইত্যাদিকে অতিক্রম করে এক নতুন স্পেস নিরন্তর তৈরি হয়ে চলেছে অ্যানাটমিক্যাল জ্ঞানকে ব্যবহার করে পুঁজি, বাণিজ্য, মুনাফা, রাষ্ট্র এবং social psyche নির্মাণের কাজে। এই স্পেসটিই স্যানিটারি সায়ান্সে একদা ব্যবহৃত এবং চর্চিত non-corporal ভৌগলিক স্পেস।
এসবের সম্মিলিত ফলে দেহের একটি বিশেষ ধারণা ধীরে ধীরে জন্ম নিতে থাকলো। সে ধারণা সচ্ছিদ্র দেহের ধারণা, “porous body”-র ধারণা। আমাদের ত্বক অসংখ্য সূক্ষ্ম ছিদ্র নিয়ে তৈরি, আমাদের পায়ুদ্বার/যোনিদ্বার/মূত্রদ্বার, মুখ ইত্যাদি সবগুলোইতো প্রতিমুহূর্তে non-corporal ভৌগলিক স্পেস-এর সাথে বিনিময় করে চলেছে। দেহের আভ্যন্তরীন অ্যানাটমি যেন উপরিতলে রয়েছে এরকম এক নতুন বোধ আপাতভাবে প্রতিভাত হতে লাগলো। এই porous বা সচ্ছিদ্র দেহ আবার নতুন সজ্জায় plastic বা নমনীয় দেহও বটে। নমনীয় দেহের ওপরে পণ্য, বিজ্ঞাপণ, বাজারের বিপুল চাপ দেহকে ঘিরে এবং কেন্দ্র করে এক identity বা আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে। স্যানিটারি সায়ান্সের ইতিহাস অতিক্রম করে দেহের বহিস্থঃ ভৌগলিক অঞ্চল গঠিত হতে শুরু করলো পণ্যসংস্কৃতির স্রোতে – এর চাহিদা, বৌদ্ধিক প্রভাব এবং আকাঙ্খা দিয়ে।
যদি সমস্ত স্তরের এবং অবস্থানের মানুষকে পণ্যবাজারের চাহিদা অনুযায়ী মানসিকভাবে একজন “ক্রেতা” বা “ভোক্তা” এরকম বোধ তৈরি করে ফেলা যায় তাহলে পণ্যদুনিয়ায় দেহের বোধের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ এমন একটি বোধকে সহজেই সঞ্চারিত করা সম্ভব যে জরাকে হারিয়ে দিয়ে চিরযৌবন লাভ করা হাতের নাগালের মধ্যে এবং সেটাও সম্ভব হবে anti-aging cream দিয়ে যা ত্বকে ব্যবহৃত হবে। সমস্ত পুরষ দেহ হবে ডেভিডের মতো (সমসাময়িক পরিভাষায় 6-pack body) এবং সমস্ত নারী হবে ভেনাসের মতো। পণ্যদুনিয়ায় এসে সাবেকী অ্যানাটমির জ্ঞান এক নতুন চেহারা ও গঠন নিল, নতুন ব্যঞ্জনায় নির্মিত হল।
তাহলে পণ্যদুনিয়ায় দেহের বোধের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ এমন একটি বোধকে সহজেই সঞ্চারিত করা সম্ভব যে জরাকে হারিয়ে দিয়ে চিরযৌবন লাভ করা হাতের নাগালের মধ্যে এবং সেটাও সম্ভব হবে anti-aging cream দিয়ে যা ত্বকে ব্যবহৃত হবে। সমস্ত পুরষ দেহ হবে ডেভিডের মতো (সমসাময়িক পরিভাষায় 6-pack body) এবং সমস্ত নারী হবে ভেনাসের মতো। পণ্যদুনিয়ায় এসে সাবেকী অ্যানাটমির জ্ঞান এক নতুন চেহারা ও গঠন নিল, নতুন ব্যঞ্জনায় নির্মিত হল।
(পণ্যদুনিয়ায় আমাদের সোশ্যাল সাইকি নির্মাণের আধুনিক ভেনাসের বিভিন্ন পরিবর্তিত চেহারা)
সর্বোপরি ফলাফল? তৃতীয় স্তরের অ্যানাটমির জ্ঞান দেহের এবং, পরিণতিতে পণ্যদুনিয়ায় দেহের রাজনীতির নতন অর্থের উৎপাদক হয়ে ওঠে। মানুষের শরীরের প্রতিটি surface anatomical part-কে ভাগ করা হয় ১০ বা ততোধিক sub-parts-এ এবং প্রতিটি অংশেরই use value রয়েছে। প্রতিটি অংশের জন্য রয়েছে একটি বিশেষ “ব্র্যান্ড” যা ঘোষিতভাবে (বিশ্বাসযোগ্যভাবেও) অবসন্ন, কুশ্রী, অগ্রহণীয় মুখাবয়বকে সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে এমন একটি প্রতীতি জনমানসে প্রোথিত করতে পারে। নতুন মেডিসিন ও দেহের পণ্যধারণা একদিকে সময়কে (time) লক্ষ্য করে কথা বলে, অন্যদিকে প্যাথলজিকে স্থানচ্যুত করে চলনশীল (movable/mobile) করে তোলে। দেহের প্যাথলজির বোধ আর দেহাভ্যন্তরে থাকেনা, দেহের উপরিতলে এবং ভৌগলিক স্পেসে যেন এর অবস্থান।
কয়েকটি ছবি আমার বক্তব্যকে আরেকটু স্পষ্ট করবে বলে আমার ধারণ। ছবিতে যে যে অংশগুলোকে দেখানো হয়েছে সবকটি অংশেরই ব্যবহার মূলয় বা use value রয়েছে। একটুখানি বিসদৃশ শোনানোর মতো বলা যায় তন্বী, আরো তন্বী দেহের ভেনাসের খোঁজে সবকিছু সমর্পন করার পরে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রকট হয়ে ওঠে Bulinia Nervosa-র মতো অসুখ যা, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, অনেকসময়েই প্রাণঘাতী। দেহের রাজনীতির এ হল আরেক প্রকাশ।
রাষ্ট্রের ও মেডিসিনের নিবিড় সহাবস্থানের ফলে দেহের রাজনীতির অনেকগুলো ডিসকোর্স আমাদের সামনে খুলে গেলো। আমাদের নতুনভাবে ভাবার সময় ও উপাদান এসেছে। আমরা আরেকটু প্রসারিত চেহারায় ভাবার চেষ্টা করি, চলুন!
ভালো লাগলো বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে স্বচ্ছন্দ পরিক্রমায়। মৃত্যুদন্ড নিয়ে বক্তব্য এ্যানাটমির ডিসেকশনের থেকে সুখপাঠ্য লেগেছে। লেখক ও প্রকাশক দুজনকেই ধন্যবাদ।
অগম্য রাস্তায় দেখা।অসাধারণ।
কিন্তু ক’জন (এমনকি মেডিসিনের লোকজন ও চিন্তাজীবীরাও) ভাববে ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অন্তত ন্যূনতম প্রকাশ ঘটাবে?
Rapid can -vassing require to educate grass-root level community so they can acess general hygiene which is extremely require for upliftment for tha whole nation .Public/Mass -community as a whole enforce the pressure to every corner of politics—-whereas Gram-panchayet leader / counciler andevery member of political pyramid , that budget of every year of every panchayet, every ward/every division /everydistrict/ every State at first fulfil the minimum consumption ofcommunity hygiene, sothat every one feel a good atmosphere in their daily life everyone bound to do his/ her duty for maintain theharmony of social hain/e cosystem.Noone can debarred from the duty whereas he or she is gp-D / clerk/gp-c/gp-B/Gp-A/IASIPS/ Docter/ Engeenier.
ভয়ঙ্কর
চমৎকার, ডাঃ জয়ন্ত।
কি অবলীল স্বাচ্ছন্দ্যে আপনি শবব্যবচ্ছেদের গোড়ার ইতিহাসকে আমাদের বোধগম্য করিয়ে শিল্পের ইতিহাসে চলে গেলেন।
তারপর এল মানুষ খুনে (কাজীর বিচারে) ডাক্তারী বিদ্যার ব্যবহার।
শেষে করলেন পুঁজিবাদী দুনিয়ার শবব্যবচ্ছেদ।
অথচ পুরো লেখাটাই কিন্তু একসুরে বাঁধা।
অসাধারণ।
Indeed a well thought and out of the box thinking. Thanks
Khub sunder sir
চমৎকার লেখা। শরীরের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফুকোর চিন্তার সঙ্গে পরবর্তী কালে বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণের সংযোজন। মেডিক্যাল আর কসমেটিক, দুই বাণিজ্যের বিপণনে আমরা জেরবার।
অসাধারণ প্রবন্ধ জয়ন্তদা ।
Really Very nice sir.
অসাধারণ লেখা। উপযোগী তো বটেই। অনেক ধন্যবাদ।