ডিসক্লেইমারঃ দয়া করে, এটাকে কেউ আমার ব্যক্তিগত মতামত ভেবে ক্ষেপে উঠবেন না। বরং ইদানিং খবর বলে যা কিছু আসছে, সেগুলোর নিয়ে একটু মন খারাপ হচ্ছে বলেই এই লেখা।
থ্রি ইডিয়টস সিনেমার একটি ডায়ালগ – হাম মেশিন সে ঘিরে হুয়ে হ্যায়।
মনে পড়ে?
আমির খানের মেশিনের সংজ্ঞা বলা?
অবশ্যই মনে পড়বে।
না, মেশিন আমার বলার বিষয় নয়।
বলার বিষয় হলো খবর।
এই একই ডায়ালগটা বলা চলে খবর নিয়ে –
হাম খবর সে ঘিরে হুয়ে হ্যায়।
এবার প্রতিদিন হাজার গণ্ডা খবর তো আমাদের ঘিরে ধরছেই, আমরা প্রায় সবাই সেই খবর দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছি,
কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি – ঠিক কি খবর, কে বানাচ্ছে, কেন বানানো হচ্ছে, কী কী প্রয়োজনে খবরগুলো বানানো হচ্ছে?
কেনই বা আমরা অভিমন্যুর মত সপ্তরথীর সাত গণ্ডা খবর নামক অস্ত্রের মাঝে পড়ে হাঁসফাঁস করছি বেরিয়ে আসার জন্য?
কেনই বা আমরা সেই ব্যাঙের মত অপেক্ষা করছি সময় বুঝে এই খবরের ফুটন্ত কড়াই থেকে ঠিক লাফ দিতে পারব?
অথবা আদৌ ভাবছি কি?
না, ভাবছি না কোনটাই। নিজের নিজের কথা ভাবুন – সোশ্যাল মিডিয়ায় বা টিভি/খবরের কাগজ ইত্যাদি থেকে পাওয়া হাজারটা খবর আপনার মগজ যখন দখল করে নিচ্ছে, আপনাকে চালিত করছে নির্দিষ্ট দিকে,
আপনাকে এনগেজ করে রাখছে সোশ্যাল মিডিয়ায় তর্ক বিতর্ক ইত্যাদি করতে, কখনো কি আপনি ভেবেছেন – এই খবরটা খবর কেন?
ধরা যাক, চাঁদে প্রস্রাব করলে কী হতে পারে, এই নিয়ে একটি খবরের প্রতিবেদন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে।
হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষ ওই খবরে এনগেজড, লাইক কমেন্ট শেয়ার সব করেছে।
কেউ হাসি ঠাট্টা করছে, কেউ সিরিয়াসলি ভাবছে, কেউ এড়িয়ে গেছে।
এবার আপনাকে এই যে বিষয়টি খবর বলে খাওয়ানোর চেষ্টা করা হলো, এটা কে আপনি কী বলবেন?
এরকম একটি সাংবাদিকতার বিষয় নিয়ে মানে খবর তৈরির বিষয় নিয়ে এক ভদ্রলোক, যার নাম Hallin, যিনি আমেরিকান ছিলেন, তিনি বহুদিন আগে তিনটি গোলকের একটি থিওরি দিয়েছিলেন।
কি রকম সেটি?
ছবি দেখুন।
তারপর ভাবুন –
খবর বানানোর কারিগর রা জেনেশুনে বা নিজের অজান্তেই কিভাবে এই তিনটি গোলকধাঁধায় আটকে পড়ছেন আর আপনাকেও আটকে দিচ্ছেন!
এর নাম Hallin’s spheres.
এতে তিনটে স্ফিয়ার আছে।
এক. স্ফিয়ার অফ কনসেনসাস – মানে এখানে সাংবাদিক ধরে নিচ্ছেন – যে বিষয়টি একটি নির্দিষ্ট সময়ে, একটি সমাজের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে আপাতদৃষ্টিতে হলেও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবেই। উদ্দেশ্য ব্যবসা হোক বা অন্য কিছু হোক, খবরটি এমনই হবে – যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে এনগেজ করে দেওয়া যাবে।
খেয়াল করুন – এখানে পজিটিভ বা নেগেটিভ রিভিউর কোন দাম নেই সাংবাদিক এর কাছে।
খবরের মান নিয়ে কোন বিষয় থাকছে না। বলতে গেলে চার নম্বর ঠ্যাং বলে আপনাকেই উল্টে চেপে দেবে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আজকাল যত খবর বানানো হচ্ছে, তার বেশিরভাগ এই ক্যাটেগরির সাংবাদিকরা বানাচ্ছে। কারণ, তাতে আপনি আমি নিতান্তই এনগেজড হচ্ছি… কিন্তু সর্বস্ব দিয়ে!
কারণ, তারা জানে আপনি ঠিক কোনটা খাবেন?
শুনলে মনে হবে – এরা যে টপিকে বলছে সেটা “আমাদের কথা”, কিন্তু আসলে বলছে নিজের কথা। ব্যবসায়ী সংস্থার কথা।
খেয়াল করবেন – এই সব খবর থেকে দিনের শেষে দর্শক বা শ্রোতা হিসেবে আমার আপনার বা সমাজের পাওনা শূন্য।
বাকি কে কী কী পাচ্ছে, আপনি জানেন কি?
আরে মশাই, সাংবাদিককে গালি দেবেন না।
বরং ভাবুন, আপনার দৌড় কতদূর, সেটা উনি জানেন। ওনারা জানেন।
কখনো কখনো সাংবাদিক নিজেই বা সহযোগীরা এক্ষেত্রে চিয়ারলিডার হিসেবে কাজ করে।
আপনি জানেনই না – ওনারা কী খবর বানাতে পারেন!
শুধু সাংবাদিক ও নয়, এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদেরও আপনি চিনেও চেনেন না!
দুই. স্ফিয়ার অফ লেজিটিমেট কন্ট্রোভার্সি –
এই গোলকে সংবাদ মাধ্যম এবং সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি ডিসকমফোর্ট ফিল করেন। খেয়াল করুন – নিরপেক্ষ বিতর্ক সভা বলে এখন কোন কিছুই নেই। যে কটা হয়, সবই একদম নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে আয়োজিত কলতলার ঝগড়া!
সাংবাদিক যেখানে একজন নিরপেক্ষ অবজার্ভার সেজে থাকার কথা, অবজেক্টিভ হবার কথা, অন্যদের বিতর্ক উপস্থাপন করতে দেওয়ার কথা, সেখানে দাঁড়িয়ে তথাকথিত সঞ্চালক নিজেই একজন বক্তা। তার নিজস্ব মতামত আছে প্রতি মুহূর্তে। প্রত্যেক বক্তার কথার আগে পিছে এমনকি মাঝখানেও আরামসে নিজে চেঁচিয়ে ওঠেন! নিজের মত থাকতেই পারে, থাকবেও, কিন্তু সেটা কে যে খবর তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যায় না, এটি তারা ভুলে যান। আপনি সাংবাদিক হিসেবে যতই জ্ঞানী গুণী হোন, অন্য পরিসরে আপনি যা খুশি করুন, বাণী বিতরণ করুন বা
এই নিয়মের বাইরে গেলে আপনি (উদাহরণ এর অভাব নেই)
এবং এটাই নাকি এখন ট্রেণ্ড। সুপারহিট। বিতর্কিত কথা বলে নিজেই সুপারহিট হয়ে তথাকথিত সাংবাদিক বা সঞ্চালক আসলে কি করছেন? আমাদেরকে নিরুৎসাহিত করছেন খবর নিয়ে বিতর্ক সভা করতে বা দেখতে বা শুনতে।
তার মাঝে নিজের কথাটি/উদ্দেশ্যটি ঠিক পূরণ করে নিচ্ছেন।
এবং বাকি রা , যারা হয়ত একটা দুটো ঠিকঠাক কথা বলতে চান বা পারেন, তাদের মাইক ঠিক মিউট হয়ে যাচ্ছে অথবা তারা ও শেষমেশ ওই ফাঁদে পড়ে ভুলভাল বকতে শুরু করছেন।
নির্দিষ্ট স্ফিয়ারে থাকা কিছু মানুষ এটা সমর্থন করছেন, বাকিরা বিরোধিতা… খবর সুপারহিট। সেগমেন্টস অফ পিপল এর জন্য শেষ পর্যন্ত খবরটি ই কন্ট্রোভার্সি তে পরিণত হয়।
কন্ট্রোভার্সি শেষমেশ আর ও একটি বা অজস্র খবর হিসেবে তৈরি হচ্ছে সাংবাদিক বা খবর বানানোর কারিগরদের হাতে পড়ে! এবং তারা সবাই কম্পার্টমেন্টালাইজড।
অথচ, এই স্ফিয়ারে সাংবাদিককে হতে হত ব্যালান্সড এবং অবজেক্টিভ।
তিন. স্ফিয়ার অফ ডেভিয়ান্স –
এই ব্যাপারটা যখন Hallin বলেছিলেন, তখন ছিল এরকম – সাংবাদিকরা কিছু বিষয় নিয়ে খবর করেন না । কারণ, সেগুলো মাইনর বা হাস্যকর বা কোন সোশ্যাল ট্যাবু নিয়ে।
তাই সেই বিষয়গুলোকে স্বাভাবিক তর্ক বিতর্কের বাইরে রাখেন বা সেটা নিয়ে খিল্লি করেন না।
কখনো কখনো এই রকম বিষয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সেন্সরও করেন।
যেমন ধরুন – কেউ যদি বলে ফ্ল্যাট আর্থ, তাহলে তাকে নিয়ে খবর না করে অ্যাভয়েড করা যায়।
এতদূর বোধহয় ঠিকই ছিল।
কিন্তু আমার মতে এখন এই স্ফিয়ারে সাংবাদিকদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি। সোশ্যাল এবং সেক্সুয়াল ডেভিয়ান্সের যেসব দিকগুলো খবর হয়ে ওঠার কথা নয়,
সেগুলো রমরমিয়ে খবর হয়ে উঠছে।
খবরের পাতাগুলো খুললে আপনি আরামসে এগুলো পেয়ে যাবেন। ফেসবুক অ্যালগরিদম এগুলো দেখাবে কারণ নিষিদ্ধ উত্তেজনা, অতএব রিচ বেশি।
সাংবাদিক এই খবর করবেন ই কারণ, তার আর কিছু না হোক ইনকাম বেশি!
সংবাদমাধ্যম এগুলোকে অনলাইন অফলাইন নাম দিয়ে চালাবেন, কারণ দিনের শেষে বিক্রটা তাদের প্রায়োরিটি।
ফলাফল – আমরা যারা খবর এর বিশ্বাসযোগ্যতায় বিশ্বাসী, তারা ডেভিয়েট করে যাচ্ছি এমন কিছু বিষয়ে, যেগুলো দরকার নেই।
পাচৃছি না এমন খবর, যেটা আমরা সত্যিই চাই।
যাই হোক, উদাহরণ দিয়ে আর লেখা বড় করলাম না।
চাইলেই সবাই রিলেট করতে পারবেন মনে হয়।
আমার ব্যক্তিগত মত – খবর এবং তার সঙ্গে জড়িত মানুষ যারাই আছেন, তারা একটু খেয়াল রাখুন।
আপনাদের কলম/মুখকে এখনো মানুষ বিশ্বাস করেন।
আপনারা এই গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেলে বেশ বড়সড় বিপদ … আপনার আমার সমাজের দেশের…