আমি আসলেই এক জীবন্ত পাথর। রোমানিয়ার বিশেষ অঞ্চলে পাওয়া যায় সেই ট্রোভান্ট পাথর।
তারা আদতে নাকি গ্রহান্তরের জীব হলেও হতে পারে। স্থানীয় কেউ কেউ ভাবে। অন্যরা বলে নিছকই প্রাকৃতিক ব্যাপার। তারা আকারে বাড়ে। নড়াচড়া করে।
সেই পাথরেরই মত হয়ে গেছি। সেই তাদেরই মত আমি ক্বচিৎ এদিক ওদিক যাতায়াতও করি। সেই হিসেবে আমি ওই কী বলে জলজ্যান্ত লিভিংস্টোন।
তদুপরি এই আমাকে ডেকে অনায়াসে চমকানো যায়।
বলা যায়,- শুনুন মশাই, যে নামেই ডাকবার কথা বলে থাকুক, তাকে গত তিন যুগ ধরেই খাইয়ে পড়িয়ে বড় করেছি এই আমি। আমাকে যে নামে ডাকে সেই সম্বোধন চাইলেই হল?
তীব্র শোকে অবশ হয়ে যাওয়ার কথা এই রকমের বিবৃতি শুনে। তা, সেও তো অধিক শোকে এক রকমের পাথর হয়ে যাওয়াই, নাকি?
তাই সেই অর্থে ভাবতে গেলেও আমি ওই লিভিংস্টোনই। জীবন্ত পাথর।
তো যাই হোক, গতকাল আপনাদের হুজুরে দাখিল এই লিভিংস্টোন ওই যে এদিক ওদিক যাতায়াতের ভারি জাঁক তার… সেই রকমের এক অভিযানে গেছিল।
অভিযান শব্দটা শুনলে বুক ছম ছম করে। করে না? এ পাশে ঘন বন। তার মাঝ দিয়ে উঁকি মারছে হিংস্র আর নিরীহ শ্বাপদেরা। অজস্র মারণকীট গিজগিজ করছে। পদে পদে হারিয়ে যাচ্ছে পদ রেখা। সঙ্গে ছেঁড়াখোঁড়া মানচিত্র আছে কিম্বা নেই। সহযাত্রী মারা গেছে কিম্বা যাই যাই করছে।
নাঃ, এই রকমটি নয়। কিন্তু এর চাইতে কমও কিছু নয়। অথচ শুরুটা দেখে বোঝা যায়নি তত। যাত্রার শুরুতে অমিতবাবুকে ফোনে সেই উল্লাস জানিয়েওছিলাম। আকাশে মেঘের চাঁদোয়া। ইঞ্জিন-ভ্যানের ওপর সমাসীন আমি। দুপাশেই জানালা-ওয়ালা বাসের সিট যেন। হু হু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে যাচ্ছে। ভাবছিলাম… ডুয়ার্সে রয়েছি। যেন স্বপ্নযাত্রার এক
জঙ্গল-সাফারি।
স্বপ্নভঙ্গ হল মধ্যমগ্রাম পেরিয়ে দোলতলায় পৌঁছে।
দেলোয়ার মানে আমার ইঞ্জিনভ্যান চালক আচমকা গাড়ি ঢুকিয়ে দিলেন গঙ্গানগরের রাস্তায়। কী ব্যাপার?
– এয়ারপোর্টের পেছন দিক দিয়ে গেলে কম রাস্তা, বত্রিশ পাটি দাঁত ছিরকুটে জানালেন শ্রীযুক্ত সারথি।
একটু এগোনোর পরেই সেই কম রাস্তার বৃহৎ গুণাবলী প্রকাশ পেলো।
আমি আগে ইঞ্জিন-ভ্যান চাপিনি কখনও তা নয়। প্রচলিত রিক্সাকে মফস্বলে আদর করে ডাকতাম বডি-রিক্সা বলে। ভাগ্যের দোষে সে বেচারি এখন প্রায় অদৃশ্য। তাকে রিপ্লেস করেছে ভ্যান-রিক্সা। সেই ভ্যান-রিক্সার রকমফের হল এই ইঞ্জিন-ভ্যান। আগে শুনতাম চুরি যাওয়া বা বাতিল বাইকের ইঞ্জিন লাগানো এইগুলিতে। পরে জেনেছি অন্যান্য ডিজেল চালিত শ্যালো ইঞ্জিনও লাগানো হয় এইগুলিতে। যাই হোক না কেন, এই যন্ত্রে আমি আগে চেপেছি। ঝাঁকুনি আটকানোর স্প্রিং-টিংএর বালাই বিশেষ কিছু থাকে না। সে না থাকুক। কিন্তু যাত্রী-পরিবাহী সেই যানে চেপেছি।
এবারের কেসটা অন্যরকম। তিনখানা খাট ডিসম্যান্টল করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল হেথা থেকে হোথা। যারা বয়ে নিয়ে যাবে তাদের ঠিকঠিকানায় কে নিয়ে যাবে? সঙ্গে কে যাবে? কেন ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো এই আমি আছি না! এই সংসারের জীবন্ত জিপিএস।
সাহস যুগিয়েছিল অময়। খাট ডিসম্যান্টলের শিল্পী সে। – দিব্যি চলে যাবেন স্যার ভ্যানে বেঁধে রাখা খাটের মাথায় চেপে, রাজার মতন। ভ্যানে চাপেননি নাকি আগে?
– আরে, এই রকম কিছুর মাথায় আগে চাপিনি তো!
বলেই খেয়াল হল আগে তো অনেক কিছুই করিনি। এই যে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরুলো সেই মাধ্যমিকও তো আদৌ পাশ করিনি। আমাদের সময়ে মাধ্যমিক পরীক্ষাটাই উবে গেছিল। আমরা সরাসরি হায়ার সেকেন্ডারি। যাই হোক, অন্যের অনুপ্রেরনায়( আগে বলত গ্যাস খেয়ে) বহু কাজই করেছি জীবনে। এবারেও রাজি হয়ে গিয়েছিলাম সেই ঢিপি করে বাঁধা কাঠের বোঝার ওপর চাপতে।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম। দেলোয়ার কথিত সেই স্বর্গীয় রাস্তা প্রায় অগম্য হয়ে উঠল এক কিলোমিটার এগোতে না এগোতেই। খানা খন্দ… তদুপরি ঘন ঘন বাম্প শোভিত সেই রাস্তা। আমার অন্তরাত্মা অসীম সাহসী। বয়স বাড়েনি তার। বাড়তেই দিইনি। কিন্তু আমার মেরুদণ্ডের হাড়ের তো বয়স বেড়েছে। এই ঝাঁকুনিতে একটা কমপ্রেশন ফ্র্যাকচার হতেই বা বাধা কী?
চালাতে চালাতে দেলোয়ার হেন অসমসাহসীও বলতে বাধ্য হল,
তবে যে শুনেছিলাম রাস্তা ভালো হয়ে গিয়েছে। হয়নি দেকচি! পরের ভোটও তো সেই কিছু না হোক দু’বছর পর।
বলতে বলতেই দেখ না দেখ … ইঞ্জিন-ভ্যানটিকে সারথি রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে মেশিন বন্ধ করল। আমি ভাবছি, এবার তবে কি দু বছর অপেক্ষা করাবে নাকি রে বাবা!
প্রশ্নের চোখে তাকাতে আশ্বস্ত করল দেলোয়ার,- মেশিনের তেষ্টা পেয়েছে আজ্ঞে। জল খাওয়াতে হবে এরে।
সেই জল জোগাড়ের চেষ্টা করতে গেল কুড়ি মিনিট। মেশিন জলটল খেয়ে ধাতস্থ হবার পরে আবার সেই মহাপ্রস্থানের পথে রওনা হলাম। সেই পৌরানিক পথে তবু টুপটাপ ঝরে পড়ার অপশন ছিল। এই পথে তাও নেই।
যে কোনও দুঃখের পথই শেষ হয়। শেষে তেমন সুখ দাঁড়িয়ে থাকে না, যদিও। যাই হোক জীবন আমাকে এটুকু শিখিয়েছে।
শেষে সুখ থাকুক না থাকুক, এই দুঃখ-পথও শেষ হল। প্রায় সাত কিলোমিটার পরে ঝিকিয়ে উঠল যাত্রাদেবীর অনিন্দ্য মুখশ্রী আর দেলোয়ারের বত্রিশ পাটি। – হুই নারায়ণপুর শেষ।
এইবার রাজারহাট মেইন রোড। মাথার ওপরে গনগনে সূর্য।
আমার ডুয়ার্স-প্রহেলিকা শেষ হল। আমার ধারণা কম রাস্তার প্রলোভনে শুধু নয়, আইন-রক্ষকদের বেআইনি দাবীর ভয়েই সারথির এই মহাপ্রস্থানের পথ বেছে নেওয়া।
মিনিট দশেকের মধ্যে, জীবন্ত-পাথরের মানে এই লিভিংস্টোনের শেষ অভিযানটি শেষ হল।
*
বাবুমশাইয়েরা,এতক্ষণ তো শুধু নিজের কথাই বলে গেলাম।
গোড়াতেই আবছা যার কথা বলেছি… সেই তার কথা তো আপনাদের এই লিভিংস্টোন বললই না!
সেই তাকে নিয়ে লেখাটি পড়াবার অনুমতি চাই। প্লিজ…
*
স্বপ্নবরণ
————
রাত্রি প্রায় শেষ। তোমার নৌকোটা কেন যে খুঁজে নিল আমার চর?
নদীটি থই থই স্রোতে ও ঘুর্ণিতে। ভাঙনে উৎসুক। কী অস্থির!
বইছে ঘোলাজল গাছের গুঁড়ি আর কচুরিপানা। গত রাত্রিটির
স্বপ্নে তুমি ছিলে। অর্দ্ধ জাগরণে প্রলাপ যত ছিল ভয়ঙ্কর।
কোনওক্রমে সেই সুড়ঙ্গের শেষে কখনও যদি দেখি আলো আভাস,
সেটা যে প্রহেলিকা বোঝার আগে ঠিক উধাও হয়ে যায় নরম নীল।
আলোর কিছু কথা জানে বনস্পতি , বাকিটা জেনেছিল দুর্বাঘাস।
নীলের সব কথা ছড়ানো ডানা মেলে কুড়িয়ে নেবে একা শঙ্খচিল।
শুরুতে আঁকা যার শেষের ভাঙা ছল … তবু যে স্বপ্নকে বইতে হয়।
কিছুই দেবে না সে এ’কথা জেনে তবু নিজেকে ভেঙে ফেলি সারা জীবন।
তোমার সাথে সেই স্বপ্ন ভেসেছিল কুয়াশা যার খুব কাহিনিময়…
শ্বাপদ আর কিছু সরীসৃপ আর হারানো পথ এক লিভিংস্টোন।
রাত্রিশেষ। তবু স্বপ্নকেই নেব, আমার কাছে যদি আসে সে’টি।
নৌকো ভিড়বার খবর পেয়ে আজ সাজিয়ে রাখলাম ভাঙা জেটি।