আরজিকর-এর ঘটনা থেকে কিছু শিক্ষা আপনারা সবাই নিতে পারেন। আপনারা বলতে অন্তত তাঁরা, যাঁদের মেয়ে/দিদি/বোন/স্ত্রী – এককথায় বাড়ির/ প্রিয় যেকোনও মহিলা (বা পুরুষও) – ডাক্তার/নার্স/কোনো-না-কোনও ইমার্জেন্সি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত। আর সেইসব মেয়েরা, যাঁদের নিয়মিত এমন ডিউটি করতে হয়, তাঁদের তো বলা-ই বাহুল্য।
১. ডিউটি চলাকালীন এধরনের ঘটনা যেকোনও মেয়ের সঙ্গে ঘটতে পারে। হ্যাঁ, এই রাজ্যে। যে রাজ্য নাকি মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যাপারে গর্ব-অহঙ্কার ইত্যাদি করে থাকে। এবং লক্ষ করুন, ব্যাপারটা এতটাই কম অপ্রত্যাশিত যে এরকম ঘটনা ঘটলেও রাজ্য জুড়ে মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ছে, এমন কিচ্ছুটি দেখা যাচ্ছে না।
তবে ইমার্জেন্সি পরিষেবার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা জানেন, কর্মক্ষেত্রে শারীরিক আক্রমণ ইত্যাদির ঘটনা চূড়ান্ত অনভিপ্রেত ও অন্যায় হলেও বিরল নয়। যাঁরা এধরনের পেশা বেছে নেন, তাঁরা সেকথা মাথায় রেখেই পেশায় ঢোকেন। তদুপরি, হাসপাতালে নিরাপত্তা – ন্যূনতম নিরাপত্তা – কেন নেই, সে প্রশ্ন তোলা জরুরি অবশ্যই, কিন্তু যে রাজ্য দুর্বৃত্তদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হতে ক্রমশ কর্মহীন হুল্লোড় ও অরাজকতার গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে, সে রাজ্যের হাসপাতাল পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ করে দিলেও সমস্যার পুরোপুরি সুরাহা হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।
কিন্তু, মূল ঘটনার পরবর্তী কিছু ঘটনাক্রম থেকে – মূল ঘটনা বিষয়ে সবকিছু না জানা গেলেও বাকি ঘটনাক্রম আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে, ঘটে চলেছে – সেসব থেকে আরও জরুরি কিছু শিক্ষা আপনারা নিতে পারেন।
২. ডিউটিরত অবস্থায় মৃত্যুর পর, শরীরে অজস্র আঘাতের চিহ্ন থাকা সত্ত্বেও এবং পোশাক ইত্যাদি ছিন্নভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ বলবে, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, এটি আত্মহত্যার ঘটনা। তদন্তের মূলসুর ওইখানেই বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা হবে।
২. এতদিন যাঁরা মেয়েটির শিক্ষক/স্যার/বস্/ইত্যাদি ছিলেন – যাঁদের কাউকে কাউকে হয়ত মেয়েটি গতকাল অব্দি (মানে ধর্ষণ হয়ে খুন হয়ে যাবার আগে অব্দি) শ্রদ্ধাও করত – তাঁরা ‘তদন্ত কমিটি’-তে ঢুকে ভারি বিড়ম্বনায় পড়বেন। উপরমহলের চাহিদা কতখানি নিপুণভাবে পালন করা গেলে চেয়ারটি বাঁচানো যায়, অথচ নির্দেশ পালন করতে গিয়ে সামাজিক চক্ষুলজ্জা পুরোপুরি বিসর্জন দিতে হয় না, সে অঙ্ক তো সবসময় সহজ নয়।
৩. মেয়েটির সিনিয়র দাদা-দিদিদের কেউ কেউ গভীর সহানুভূতির ভান করে কিছু প্রশ্ন, সুকৌশলে, ভাসিয়ে দেবেন। যেমন, আহা, কী সাঙ্ঘাতিক ঘটনা, কিন্তু ডিউটির সময় ওইদিকে যেতে গেল কেন। যেমন, ইশশ, মেয়েটা একটু গোলমেলে ছিল বটে, তা বলে…
৪. সিনিয়র দাদা-দিদিদের মধ্যে যারা আরেকটু ধূর্ত, আরেকটু ঘোড়েল, তাঁরা বলবেন, মর্মান্তিক ঘটনা সত্যিই, কিন্তু পুরোপুরি না জেনে কিছু বলা ঠিক হবে না (যেন ‘পুরোপুরি না জেনে’ এঁরা কখনোই কিছুই বলেন না)। তাঁরা বলবেন, ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক তো বটেই, কিন্তু বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আলোচনা ঠিক নয়। (অথচ, এদেশে, আশারাম বাপুর নারীলিপ্সা থেকে রেশন-মন্ত্রীর চালচুরি, সব কিছুই অনন্তকাল বিচারাধীনই রয়ে যায় – এবং সেসব নিয়ে আলোচনায় কাউকেই কুণ্ঠিত হতে দেখি না।)
৫. সিনিয়র দাদা-দিদিদের মধ্যে যাঁরা আরও খানিকটা অগ্রসর, যাঁরা চক্ষুলজ্জা আরেকটু চট করে বিসর্জন দিতে সক্ষম, তাঁরা বলবেন, প্রশাসন তো দেখছে বিষয়টা। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা হবে – অমুক কাউন্সিলের তমুক হর্তাকর্তা চটজলদি বিষয়টি নিয়ে ব্যথিত হয়েছেন – পুলিশ সাততাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছেই জানিয়েছেন, ‘প্রাথমিকভাবে’ (মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে কী হবে, তা বলাই বাহুল্য) ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি… অতএব সরকার তো যথাসাধ্য করছে। তারপরও হইচই কেন?
৬. আর হ্যাঁ, কেউ কেউ অবশ্যই প্রতিবাদ করবে। ওই কিছু বাপে-তাড়ানো-মায়ে-খেদানো মাল। যাদের আপনি সচরাচর এড়িয়ে চলতেন, কিন্তু এখন তাদের উপরই ভরসা রাখতে চাইবেন। এরা খানিকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো টাইপ। আপনার চিরকালই সন্দেহ, পেশাজীবনে খুব একটা ভালো কিছু করতে পারেনি বলেই এরা এসব করে বেড়ায়। প্লাস, কর্তৃপক্ষের হাতে এরা যেভাবে হয়রান হতে থাকে, তা দেখার পর আপনি নিজে তো এদের এড়িয়ে চলেনই, বাকিদেরও পরামর্শ দেন এড়িয়ে চলতে। এই মুহূর্তে অবশ্য…
৭. ও হ্যাঁ, অনেকে এই সময়ে আচমকা প্রতিবাদে নামবেন। সেটা অবশ্যই আশার কথা, কিন্তু সত্যি বলতে কি, প্রতিবাদ ব্যাপারটা একটা অভ্যেস। আশেপাশের ছোট ছোট অন্যায়গুলো অবাধে চলতে দিলেই একদিন বড় অন্যায়গুলো ঘটতে পারে – প্রতিবাদ করতে হলে ছোট ছোট অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটাও জরুরি। তবে শুধু বড় ঘটনার মুহূর্তেই যাঁরা প্রতিবাদে নামেন, তাঁদের প্রতিবাদ কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। নি-জার্ক-এর মাধ্যমে মানুষ হাঁটতে শেখে না ঠিকই, কিন্তু স্নায়ুতন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা তা বোঝার জন্য নি-জার্কটুকু অক্ষত আছে কিনা, সেটুকু দেখে নিতে হয়।
তো যেকথা বলছিলাম, ঘটনার মুহূর্তে – অর্থাৎ কী করে ডিউটির সময় একটি জনবহুল ও সিসিটিভি-শোভিত সরকারি হাসপাতালে একটি মেয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারল এক পুরুষ – কীভাবে পোশাক ছিঁড়েখুঁড়ে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকল মেয়েটির শরীর – কীভাবে… কীভাবে… – আর্তনাদ থামাতে কীভাবে কেউ চেপে ধরল তার গলা – আর কীভাবে কোনও একটি মুহূর্তে মেয়েটির শরীর স্তব্ধ হয়ে গেল, হয়ত তখনও থামেনি পুরুষটির লালসা – না, সত্যি বলছি, ঠিক সেই মুহূর্তে ঠিক কীভাবে ঠিক কী ঘটেছিল, সেসব আমরা কেউই সঠিক জানি না।
কিন্তু তার পর ঠিক কী কী ঘটছে – ঘটেছে, ঘটছে, ঘটে চলেছে – তা একেবারে চোখের সামনেই ঘটছে। মূল ঘটনাটি যতখানি ঘৃণার, যতখানি আতঙ্কের – পরবর্তী ঘটনাক্রম তার চাইতে কম কিছু নয়। ইন ফ্যাক্ট, পরের ঘটনাক্রম ঠিকঠাক বিশ্লেষণ করতে পারলেই মূল ঘটনার কার্যকারণ অনুধাবন করতে পারা সম্ভব।
রামকৃষ্ণ পরমহংস তো বলেইছিলেন, যতদিন বাঁচি, ততদিন শিখি, তাই না?