সুব্রতদা আজ আমাদের মধ্যে নেই এটা বিশ্বাস করা কঠিন। যখন একজন মানুষ চলে যান অন্য পারে তাঁর শূন্যতা প্রকটভাবে অনুভূত হয় তাঁর পরিবার আর প্রিয় বন্ধুদের মধ্যে। একজন ডাক্তার চলে গেলে তাঁর শূন্যতার ব্যাপ্তি তাঁর রুগী, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ও তার কর্মকাণ্ডের ওপর ছাপ ফেলে। এই প্রবন্ধে আমি তার নিরলস ব্যথা নিরশনের প্রচেষ্টার কিছু অংশ তুলে ধরার করছি।
আমার সঙ্গে সুব্রতদার আলাপ মেডিকেল কলেজে ১৯৮৭ সালে। বিগত ৩৬ বছরে তাঁর সঙ্গে আলাপ গভীরতর হয়েছিল। পারিবারিক, সামাজিক ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাপারে তাঁর বাড়ানো হাত আমাদের অনেকেরই জীবন-সংগ্রামে সাহায্য করেছে। সুব্রতদা কারোর অসুবিধার খবর পেলে নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়তেন সাহায্য করার জন্য, সেটা চিকিৎসা, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা অন্য যেকোনো সমস্যার জন্য। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল-মত, ধর্ম, বর্ণ, প্রবীণ, নবীন নির্বিশেষে সবার জন্যই তাঁর সহমর্মিতা সমান ছিল। সামাজিক ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, রাজনৈতিক ও নৈতিক পরিবর্তন কীভাবে প্রান্তিক মানুষকে অসুবিধায় ফেলে দিচ্ছে, সে সব নিয়ে ১৯৯৬ সাল থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার আলোচনা চলতে থাকে। তাঁর নৈতিক ভাবনা আরও দৃঢ় হবার পর তাঁর কর্মকাণ্ড নিমজ্জিত হয় কৃষক, শ্রমিক মানুষদের স্বাস্থ্য ভাবনায় সরকারি পরিকাঠামোর মধ্যে। তাঁর স্বপ্ন অন্য সাধারণ ডাক্তারদের থেকে আলাদা ছিল, আর সে কথাটা আমার কাছে খুবই পরিষ্কার ছিল।
ইএসআই হসপিটালে যোগ দেওয়ার পর শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের ও ব্যথার উপশমের কাজে তাঁর প্রচেষ্টা আমি লক্ষ করেছি। অ্যানাস্থেশিয়ার ডাক্তার হিসাবে সুব্রতদা আমাদের কাছে জানতে চান বিলাতে এবং পাশ্চাত্যে কীভাবে ব্যথার চিকিৎসা হয়। সেটা ২০০৭-০৮ সাল। তখন আমি বিলাতের Pain Society, Royal College of London-এর কিছু কার্যকলাপ তাঁর গোচরে আনি। অনেক আলোচনা হয়। শিক্ষা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে কীভাবে প্রান্তিক মানুষের প্রয়োজনে কাজে লাগানো যায়, তাঁর সে স্বপ্ন সেই সময়ে আমার কাছে পরিষ্কার হয়। সুব্রতদা কানাডা ও আমেরিকার বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। তাঁর ভাবনায় তখন পেইন ইনস্টিটিউট, তারই কাজের কথা বিনিময় হয় তাঁদের সঙ্গেও।
পাশ্চাত্যে পেইন মেডিসিন কীভাবে শেখানো হয়, সেখানে কীভাবে পাঠ্যক্রম ঠিক হয়, কীভাবে ছাত্র-ছাত্রীর মূল্যায়ন হয়, কীভাবে দক্ষতা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, কীভাবে সামর্থ্য যাচাই করা হয়, এসব নিয়ে তাঁর অনুসন্ধিৎসা আমায় মুগ্ধ করে।
তাঁর কাজ শুরু হল। নিজেকে ব্যথা-চিকিৎসায় শিক্ষিত করা, অন্য ইনস্টিটিউশন, হাসপাতালে গিয়ে কাজ দেখা, সমমনস্ক ডাক্তারদের নিয়ে গ্রুপ তৈরি, একে অপরের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা, একত্রে শেখা চলতে থাকে। একজন বড়ো মানুষের গুণ হচ্ছে অন্তর্দৃষ্টি, সেটা তাঁর ছিল। নিজের জ্ঞান অর্জনের জন্য, আরও কাজ শেখার জন্য ইউরোপ যাত্রা করেন তিনি। এখানকার (বিলাত/ইউরোপ) শিক্ষা পদ্ধতি অন্যরকম, পরীক্ষাও অন্যরকম। সেখানে মানুষের সঙ্গে ডাক্তার কীভাবে কথা বলবেন, কীভাবে বোঝাবেন, সেগুলোর ওপর জোর দেওয়া হয় বেশি। তিনি ফেলোশিপ (FIPP) অর্জন করলেন আরেক ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে। চাকরি, সংসার, দৈনিক কাজকর্ম, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজ সামলে পড়াশোনা করা সোজা নয়। সে সব সামলে পরিণত বয়সে সুব্রতদা পিএইচডি ডিগ্রিও অর্জন করেন। যেকোনো বিষয়ের গভীরে না গেলে সে বিষয়ে এক্সপার্ট হওয়া যায় না। অ্যাকাডেমিক নলেজ, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়ে পড়াশোনা, উপলব্ধি ছিল তাঁর অত্যন্ত গভীর, তিনি ছিলেন যথার্থ এক্সপার্ট।
আশির দশকের শেষে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ স্টাডি অফ পেইন-এর কাজ শুরু হলেও পশ্চিমবঙ্গে তার প্রভাব ছিল সামান্যই। সুব্রতদা সেটা জানতেন। শুরু হল তাঁর নিরলস প্রয়াস–মেডিক্যাল সেমিনার আয়োজন, লেকচার, স্কিল ওয়ার্কশপ—ব্যথা উপশমের রাস্তার সচেতনতা বাড়ানোর কাজ। একটা প্রথাগত সাব-স্পেশালিটি, যেমন কার্ডিয়োলজি, পালমনোলজি, তাদের বিষয়ে মানুষ অবগত। কিন্তু নতুন এক বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো ও তাকে চিকিৎসক-সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা খুব শক্ত কাজ। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে নতুন প্রতিষ্ঠান করা আরও শক্ত। সামাজিক ও রাজনৈতিক বাধা এড়িয়ে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে কাজ করে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছায় জন্ম হল ইএসআই ইনস্টিটিউট অফ পেইন ম্যানেজমেন্ট।
একটা প্রতিষ্ঠান চালাতে হলে শুধু ডাক্তারির জ্ঞান থাকলে চলে না, জানতে হয় অনেক কিছু। এ নিয়ে আমার সঙ্গে বহু আলোচনা হয়েছিল। তাঁর দূরদৃষ্টি ছিল প্রখর। কীভাবে প্রশিক্ষণ হবে, পাঠ্যক্রম কী হবে, কারা কাজটা করতে পারবেন, তাঁদের কীভাবে তৈরি করা যাবে, এ সমস্তই তাঁকে মাথায় রাখতে হয়েছিল। যন্ত্র কীভাবে আসবে, কারা ট্রেনিং দেবেন, তাঁদের ট্রেনিং-এর মান কেমন তা কীভাবে জানা যাবে—এত কিছু বিষয় ভাবা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল। তার ওপর এটা শুধু ডাক্তারের কাজ নয়, প্রয়োজন ফিজিয়োথেরাপিস্ট, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, ফার্মাসিস্ট এবং তাদের প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম। তা ছাড়া আছে সরকারি লাল ফিতের ফাঁস, রাজনৈতিক ফোঁসফাঁস, অর্থ মঞ্জুরের আবেদন, ঠিকঠাক লোককে ঠিক পদে বসানো—এ কর্মযজ্ঞ সহজ নয়। অদম্য প্রচেষ্টার ফসল ইনস্টিটিউট শুরু হল ২০১৩ সালে।
আমি ওখানে গেছি ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৮-তে। আমায় মুগ্ধ করেছে তাঁর প্রশিক্ষণের চিন্তাভাবনা। শিক্ষা দেবার ঘর, দক্ষতা প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র, অডিও-ভিস্যুয়াল ব্যবস্থা, রোগীদের বসার জায়গা, সেমিনার রুমের ভাবনা ও কার্যকারিতা—সব কিছুতে নজর ছিল তাঁর। কোনো স্পেশালিটির বিশেষ কাজ করতে হলে জ্ঞান অর্জন ও প্রশিক্ষণ যে আগে প্রয়োজন, তাঁর সেদিকে প্রখর দৃষ্টি ছিল। লক্ষ্য ছিল স্থির—রোগীর ব্যথার উপশম। এসবের মধ্যেও তাঁর রসিকতা ছিল উপভোগ্য, যেমন—”টপ ফ্লোরে রোগীর বেডের মধ্য দিয়ে যে হুইল চেয়ার নিয়ে যাবে, তার প্রশিক্ষণ কলকাতার ট্যাক্সি চালকের থেকে বেশি হতে হবে”—এই কথা ভুলব না। করিডোর কতটা চওড়া হলে রোগীর ও কর্মীর সুবিধা সেই খুঁটিনাটির প্রতি তাঁর দৃষ্টি ছিল অসামান্য। সে সময়ে আমাদের মধ্যে পাঠক্রম, মূল্যায়ন ও প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক ধারণার আদান-প্রদান হয়েছিল। সুব্রতদা নিজেই জানিয়েছিলেন আরও অনেকের সাহায্যের কথা। অবশেষে কলকাতায় ফেলোশিপ চালু হল।
এবারের ঘটনাগুলো গল্পের মতো। চিকিৎসা-জগতে স্বীকৃতি, আরও সেমিনার, কলকাতায় প্রথম ন্যাশনাল পেইন কনফারেন্স, বিভিন্ন লেকচারে আমন্ত্রণ—২৪ ঘণ্টা কাজ চলতে থাকল। তা থামেনি শারীরিক অক্ষমতার সময়েও। এই দৃঢ়চেতা শক্তি, অক্লান্ত শ্রম, সহমর্মিতা, ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস এবং রোগীর প্রতি যত্ন ও মায়া শিক্ষণীয়।
এই কাজ সহজ ছিল না। ট্র্যাকডিশনাল চিন্তাধারা ছেড়ে নতুন দিশা দেখানো, বহুমতের মানুষকে একসঙ্গে নিয়ে চলা, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের একসঙ্গে নিয়ে কাজ করা, অনুদান জোগাড়, অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শ সত্ত্বেও সরকারের সঙ্গে কাজ করা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের স্ট্যান্ডার্ডের ওপর কড়া নজর রাখা, নতুন যাত্রায় সাথিদের টেনে আনা, সমালোচনা-বিদ্রূপ সহ্য করে অটল ও অবিচল থাকা—এত সবের মধ্যে তার লক্ষ্য ছিল নির্দিষ্ট। ব্যথার উপশম—রোগীর জন্য, মানুষের জন্য।
বাদ সাধল রোগ। অ্যামায়োট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস বা মোটর নিউরোন ডিজিজ-এর একটি ধরন ক্রমশ তাঁর শারীরিক ক্ষমতা কেড়ে নিতে শুরু করে। ইউকে-তে এই রোগ কীভাবে চিকিৎসা হয়, কীভাবে ফান্ডেড হয়; স্টিফেন হকিং-এর রোগ ও তার উন্নতির হার, ভারতবর্ষে এই রোগের চিকিৎসার উন্নতি কীভাবে হতে পারে, কী পদ্ধতিতে সরকারি ও চ্যারিটি একসঙ্গে গবেষণা করে ও তার পরিকাঠামো ইত্যাদি সেই সময়ের আমাদের আলোচনায় আসে। এত শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও হুইল চেয়ারে করে সেমিনারে যাওয়া—ব্যথা উপশমের পতাকা তোলার ভার তিনি নিয়ে চললেন। কাজ থামল না।
“The most beautiful people are those who can love and help without expecting any return.” সুব্রতদা অল্পে খুশি থাকতেন, ব্যক্তিগত চাওয়া খুবই কম ছিল। তার চাওয়া ছিল একটাই—ব্যথা চিকিৎসার উন্নতি, রোগীর জন্য। তাঁদের ব্যথা উপশমের জন্য। মোটর নিউরন ডিজিজ তাঁর জীবনশিখা নিয়ে নিলেও তাঁর আলোয় আলোকিত হলাম আমরা। তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, মূল্যবোধ, মায়া, পরোপকারিতা, সহমর্মিতা আর মতাদর্শের বহ্নিশিখা জ্বলুক আমাদের মননে, কর্মে আর জীবনে। ব্যথা চিকিৎসাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস সফল হোক। সেখানেই তাঁর অমরত্ব।