৯ই আগস্ট নাগাসাকি দিবস
১৯৪৫ সালের আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ। বার্লিন শহরের কাছে পটসড্যামে মিত্রশক্তির কনফারেন্স চলছে। উপস্থিত হয়েছেন তিন বৃহৎ সামরিক শক্তির মস্তিষ্ক’রা। হ্যারি ট্রুম্যান, উইনস্টন চার্চিল, জোসেফ স্ট্যালিন আর তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গরা বসেছেন আলোচনা সভায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাওয়া জার্মানি তথা যুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপের ভাগ বাঁটোয়ারা প্রায় শেষ লগ্নে। প্রয়োজন এখন এমন একটি সিদ্ধান্তের, যার মাধ্যমে এখনও লড়তে থাকা জাপানের চ্যালেঞ্জকে খতম করে দ্রুত এই বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটানো যায়।
আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মাথায় দুর্বুদ্ধি খেলা করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষার্ধে ইউরোপে সোভিয়েত রাজনীতির বাড়াবাড়ি তাঁর তীব্র না-পসন্দ। অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরে জাপানি সামরিক শক্তি’র লড়াই এখনো অব্যাহত।
এক ঢিলে দুই পাখি মারতে হবে।
এমন ‘সিক্রেট ওয়েপন’ তাঁর হাতে এসেছে যার তুল্য ক্ষমতা কোন মারণাস্ত্রের নেই। সদ্য জুলাই মাসে নিউ মেক্সিকো’তে যার পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন বিজ্ঞানীরা । এখন প্রয়োজন শুধু ব্যবহারিক প্রয়োগ।
‘দ্য ওয়েপন অফ মাস ডেসট্রাকশন’।
জাপানকে শেষ করে দেওয়ার পাশাপাশি সোভিয়েত রাশিয়া কেও সমঝে দেওয়া যাবে, কারা এই মুহূর্তে মিলিটারি সুপার পাওয়ার। একই সাথে বদলে দেওয়া যাবে ভবিষ্যৎ শতাব্দীর সামরিক শক্তির ভারসাম্য। হালকা একটা হাসির রেখা খেলে গেল ট্রুম্যানের ঠোঁটের কোণে। ভাসা-ভাসা ইঙ্গিতে জানিয়ে স্ট্যালিনকে,একটু চাপেও রেখে দিলেন নিশ্চিত।
২রা আগষ্ট, কনফারেন্স শেষে রাষ্ট্রনায়কেরা যে যার দেশের দিকে যাত্রা করলেন।
৬ই আগষ্ট, নর্দান মারিয়ানা আইল্যান্ড থেকে তিনটি B 29 বোমারু বিমান রওয়ানা দিল। সেখান থেকে জাপান প্রায় ছয় ঘন্টার পথ।তার মধ্যে একটি র নাম ‘ইনোলা গে’।
সুতমু ইয়ামাগুচি’র কাছে এইসব খবর ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন আর পাঁচটা সাধারণ জাপানি মানুষের মতোই চলছে তাঁর জীবন, বাড়ি নাগাসাকিতে। ২৯ বছর বয়সী তরুণ’টি পেশায় নেভাল ইঞ্জিনিয়ার, কাজ করেন মিৎসুবিশি’তে। কোম্পানির কাজে হিরোশিমায় এসেছেন আজ প্রায় তিন মাস, একটা তেলের ট্যাংকার বানানোর প্রয়োজনে। কাজ শেষে আজকেই ফিরে যাবার কথা নিজের বাড়িতে । তাই সকাল আটটার সময় এসে পৌঁছেছেন কারখানার গেটে, সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিতে।
আচমকা প্লেনের শব্দ কানে ভেসে এলো। মুখ তুলে চাইতেই দেখলেন নীল আকাশে একটা মার্কিন বোমারু বিমান চক্কর কাটছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটে গেল অঘটন।
বম্বার থেকে প্যারাসুটের মতো কিছু একটা নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে চোখ ধাঁধানো তীব্র আলোর ঝলকানি আর তার পরেই কানফাটানো শব্দ। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই ইয়ামাগুচি ঝাঁপ দিলেন সামনের একটা পুকুরে।
কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। শক ওয়েভের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিলো যে সেটা তাঁকে পুকুর থেকে তুলে টর্নেডোর মত ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো পাশের আলুর ক্ষেতে। মুখ আর হাত পুড়ে গেল অনেকটাই। কোনমতে যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে একটা এয়ার রেইড শেল্টারে রাত কাটিয়ে খবর পেলেন, ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। স্টেশনে অনেক কষ্টে পৌঁছে দেখলেন, চারিদিকে ধ্বংসস্তূপ আর লাশের ঢের। গাদাগাদি করা ট্রেনে যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষ উন্মাদের মতো শহর ছাড়ছে। একটা নদীর কাছে এসে সেই ট্রেন থেমে গেল। আর যাবে না, ব্রিজ ভেঙে গিয়েছে।
অসুস্থ দেহ নিয়ে কোনমতে সেই নদী সাঁতরাতে হলো। কলকল শব্দে বয়ে যাওয়া নদীর জলে ভেসে আসছে লাশের পর লাশ। সভ্যতার কলঙ্কের বিষবাষ্প বয়ে চলেছে চতুর্দিকে!!
আধপোড়া শরীরটাকে নিয়ে নাগাসাকিতে যখন পৌঁছানো গেল ডাক্তার বন্ধুর কাছে, মুখের অবস্থা দেখে চেনা যাচ্ছিল না। আধপোড়া মুখে মলম আর সারা গায়ে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে ভূতের মতো পৌঁছালেন বাড়িতে। আতঙ্কিত পরিবার তাঁর কাছ থেকেই শুনলো হিরোশিমার বিস্ফোরণের কাহিনি।
আরেকটা দিন কেটে গেল কোনক্রমে। হিরোশিমার খবর তখন রটে গিয়েছে বিশ্বজুড়ে। মিৎসুবিশি কোম্পানির অফিস থেকে আহত ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ডাক পড়েছে , সশরীরে সেই ঘটনা’র বিবরণ দেওয়ার জন্য। অসুস্থ শরীর নিয়ে সেখানে পৌঁছাতে হবে।
৯ই আগস্ট, ১৯৪৫, বেলা ১১টা।
ডিজিটাল মিডিয়ার রমরমা তখন ছিল না। বর্ণনা শুনে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইছেন না। একটা বোমা কিভাবে একটা পুরো শহর কে ধ্বংস করে দিতে পারে, তা কারো মাথাতেই আসছে না।
ইয়ামাগুচি ধীরে ধীরে সেই কানফাটানো শব্দ আর তীব্র আলোর কথা বলতে শুরু করলেন। ঠিক সেই সময় কারখানার কমপাউন্ডেও একই রকম আলোর ঝলকানি আর তার সঙ্গে বীভৎস আওয়াজ। বিস্ফোরণের অভিঘাতে ইয়ামাগুচি মেঝেতে পড়তে পড়তে ভাবলেন তিনিই বোধহয় হিরোশিমা থেকেই এই আলো আর শব্দ আমদানি করে নিয়ে এসেছেন।
সংজ্ঞা ফিরে আসার পরে বুঝতে পারলেন ; না, এবারেও মরেননি। আবারও এক ধ্বংসের পথঘাট পেরিয়ে বাড়ির ঠিকানায় এসে দেখলেন, কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বুঝতে পারলেন এবার পরিবারও গেল।
কিন্তু বিধাতা পুরুষ চিরকালই খামখেয়ালি। কপালের লিখন কেউই খন্ডাতে পারেন না। কারণ, বোমা বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ আগেই ইয়ামাগুচির স্ত্রী তাঁর পুত্রকে নিয়ে ওষুধ কিনতে বেরিয়েছিলেন। বিস্ফোরণের ঠিক আগে, এয়ার রেইড অ্যালার্ম শুনে রাস্তার পার্শ্ববর্তী একটি টানেলে আশ্রয় নিতে পেরেছিলেন। বাসস্থান ধ্বংস হলেও তাই পরিবার বেঁচে যায়।
সমস্ত দেহে পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা, ফেটে যাওয়া দুই কানের পর্দা আর তেজস্ক্রিয়তা ঝলসানো শরীর নিয়ে লড়াই করে যান ইয়ামাগুচি। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ক্রমে ক্রমে সেরে ওঠেন। শারীরিক সুস্থতা কেটে গেলেও মানসিকভাবে স্থিরতা ফিরতে সময় লাগে বেশ কিছুদিন।
এর মধ্যেই ১৯৪৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জাপান সম্রাট হিরোহিতো আত্মসমর্পণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়।
ইয়ামাগুচি ধীরে ধীরে তাঁর কর্মস্থলে ফিরে যান। মিশে যান অপমানিত জাপানি মানুষের ভিড়ে। আবার নতুন করে দেশ গড়ার পালা’য়। যে দেশ পরবর্তী কালে চমকে দেবে গোটা বিশ্বকে উন্নয়নের আলোয় । বুঝিয়ে দেবে সামরিক শক্তি শেষ কথা বলে না। নিজের উপর বিশ্বাস,পরিশ্রম আর মানসিক জোর বদলে দিতে পারে ভবিষ্যৎ।
তবে এই ঘটনার কথা তিনি ২০০০ সালের আগে কখনোই জানান নি। অবসরে কবিতা লিখতেন কেবল। সে বছরেই প্রথম তাঁর অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশিত হয় এক স্মরণিকা’র মাধ্যমে, পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসাবে।
এরপর ২০০৬ সালে নিউ ইয়র্কে, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, জীবনে দু- দুবার পারমাণবিক বোমার আঘাত সত্ত্বেও, ভাগ্য এবং একমাত্র ভাগ্যই তাঁকে সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছে।
২০১০ সালে ৯৩ বছর বয়সে, মৃত্যু হওয়ার এক বছর আগে জাপান সরকার তাঁকে ‘The Twice Bombed Person’ নামক একটি সম্মান প্রদর্শন করেন। কারণ ধ্বংসের আগুনের মধ্যে থেকে, একমাত্র ফিনিক্স পাখিরাই ডানা মেলে বেরিয়ে আসতে পারে।