(১১)
বিনোদ রুম থেকে বেরিয়ে ক্লাসে যেতে যাবে সকাল সকাল পড়বি তো পড় বিভাসের মুখোমুখি। মেন হস্টেলে এসে ইস্তক বেশ ভয়ে ভয়ে থাকে ও। এখানে নেতা গোছের দাদাদের পাল্লায় পড়লে আর রক্ষা নেই। সেদিনের সারা দিনটাই চলে যাবে লেকচার শুনতে শুনতে। সন্ধ্যেবেলার ওই লেকচার সভা তবু বিনোদ এড়িয়ে যেতে পেরেছে টিউশনির দোহাই দিয়ে। নাহলে শুভ যেরকম ঝুলোঝুলি করে তাতে এড়িয়ে যাওয়া মুস্কিল হত। কলেজের প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে যায় ওর। পকেটে হাত দিয়ে বিনোদের বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। বুক পকেটে রাখা টাকাটা নেই। এদিকে কন্ডাক্টার তাড়া লাগাচ্ছে। টিকিটটা করুন তাড়াতাড়ি। আপনি তো নামবেন এবার। আগেই বলা ছিল। মেডিক্যাল কলেজ স্টপেজ এলে বলে দিতে। কলকাতা শহরে বিনোদের সেই প্রথম আসা। এক হাতে ধরা একটা মাঝারি মাপের টিনের বাক্স। ভিড় বাসে এই বাক্স নিয়ে উঠতে দিতেই রাজি হয় নি প্রথমে তারপর দুটো টিকিট কাটতে হবে এমন শর্তে রাজি হয়েছে লোকটা। বিনোদ তাতেই সম্মত হয়েছে। ট্যাক্সি করার সামর্থ্য তার নেই। টিকিট কাটার তাগাদা দিতে বিনোদ বুঝতে পারে টাকা উধাও পকেট থেকে। স্টপেজ এসে যাওয়ায় কন্ডাক্টার এবার রীতিমতো চেঁচামেচি শুরু করল। ‘কি ব্যাপার দাদা আপনার দুটো টিকিট কোথায়?” বিনোদ কি যে অসহায় বোধ করেছিল। আমতা আমাতা করে জানিয়েছিল বুক পকেটে রাখা টাকাটা পাওয়া যাচ্ছে না। কন্ডাক্টর স্টপেজ থেকে একটু এগিয়ে বাসটা দাঁড় করিয়ে ভীষণ অবজ্ঞায় বিনোদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলেছিল “এই সব মাকরাগুলো কোথা থেকে আসে রে, শালা এই অফিস টাইমে ঢাউস বাক্স নিয়ে উঠে এখন বলে কিনা টিকিট কাটার টাকা নেই।“ আসলে বিনোদের চেহারায় সমীহ করার মতো কিছু নেই। তার চেহারা, পোশাক আশাক দেখলেই বোঝা যায় গ্রাম থেকে আসা নেহাতই সাধারণ ঘরের ছেলে সে। বিনোদ টিনের বাক্স হাতে নেমে এসে দাঁড়িয়েছিল এই শহরের রাস্তায়, একদম একা। আশ্রয়হীন কলকাতা শহরে ডাক্তারি পড়তে আসা বিনোদ এক রাশ অসহায়তা নিয়ে ভেবেছিল ডাক্তারি পড়তে আসার সিদ্ধান্ত তার মতো ছেলের কাছে নেহাতই বিলাসিতা। রুখাশুখা লাল মাটির গ্রাম, দারিদ্র্য, রুগ্ন বাবা, ছোট ছোট বোন সবার জন্য মনটা কেমন করে উঠেছিল। ছোট থেকে দারিদ্র্য-র সঙ্গে লড়াই করতে করতে বিনোদের মনটা কেমন ক্ষেপে গেছিল। কেবলই মনে হতো এই চক্র থেকে তাকে বেরোতেই হবে। তার পরিবারের ভাগ্য রেখা বদলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তাকে তুলে নিতে হবে। সেই লড়াইয়ে প্রথম থেকে তার সঙ্গে ছিলেন হাই স্কুলের হেড মাস্টারমশাই নিখিল সামন্ত। তাকে অনেক সাহায্য করেছেন। লন্ঠনের তেল কেনবার পয়সা নেই জেনে নিজের টাকায় আলোর ব্যবস্থা করেছেন। সময়ে অসময়ে তাকে পড়া দেখিয়েছেন। অন্য মাস্টারমশাইদের বলে স্পেশাল কোচিং এর ব্যবস্থা করেছেন। শিলাইয়ের বুকে বয়ে গেছে জল। যে বিনোদের বংশে সাত জন্মে কেউ স্কুলের মুখ দেখে নি সেই বিনোদ পেরেছে। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় স্টার পেয়ে পাশ করেছে। ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথমের দিকে র্যাঙ্ক করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে। আজ কলেজের প্রথম দিন। হেড স্যারের দেওয়া পাঁচশো টাকা সম্বল করে কলকাতা শহরে এসে পৌঁছোতেই সেই পাঁচশো টাকাও খোয়া গেল। তখন কোন দিকে যাবে কি করবে কিছুই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না বিনোদ। সেদিন প্রথম শুভ-র সাথে আলাপ হয় বিনোদের।
মনে পড়ে যায় পুরো কলেজ ঘুরে দেখার দিনটা। শতাব্দী প্রাচীন কলেজের সবটা ঘুরিয়ে দেখালো ওদের সিনিয়ররাই। ইউনিয়ন রুম, কমন রুম, ক্যান্টিন তো আছেই। তাছাড়া যা দেখে মুগ্ধ হল ওরা সেগুলোর স্থম্ভে, সিলিং এ কত ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে! জেনেরাল লেকচার থিয়েটর, অ্যানাটমি লেকচার থিয়েটর, সেকশন হল, ডেভিড হেয়ার ব্লক, এজরা বিল্ডিং……। প্রতিটা কোণায় কোণায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাস। প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের দল বেঁধে এই কলেজ ভ্রমণ যেন পূর্বসূরীদের হাত থেকে দায়িত্ব বুঝে নেওয়া। যে ইতিহাস এই কলেজ শতাব্দী পার করে বয়ে নিয়ে চলেছে তার উত্তরসূরী হতে গেলে কতটা দায়িত্ববান হতে হবে এ যেন তার প্রথম পাঠ। সব শেষে এম সি এইচ বিল্ডিং-এর ধাপ ধাপ নেমে যাওয়া সিঁড়িতে বসে সব সহপাঠী ও সহপাঠিনীদের সঙ্গে ছবি। এক জাহাজে যাত্রা শুরু দেড়শ’ জন নাবিকের।
মেন হস্টেলেই বিনোদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হল। আরও বেশ কিছু পড়ুয়াও অনেক দূর থেকে এসেছে। এদের অনেককেই ওখানে সাময়িক থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। সিনিয়রদের রুমে বাড়তি বিছানার ব্যবস্থা ছিল। তাতেই জায়গা হল নতুন ছেলেদের। পরে হস্টেল ঠিক হলে যে যার জায়গায় চলে যাবে। শুভ আসার সময় বিনোদের হাতে শ’ দুয়েক টাকা গুঁজে দিয়েছিল। নিজের হাত খরচের কিছু টাকা ভাগ্যিস সঙ্গে এনেছিল। ওদের সেদিন যেটা সব থেকে ভাল লেগেছিল রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা সত্ত্বেও ইউনিয়নের সদস্যদের মধ্যে একটা উষ্ণ সম্পর্কের ছোঁয়া আছে। তারা শুধু বয়সে বা সম্পর্কে বড় নয়, তাদের ব্যবহারে বড় হওয়ার পরিচয় রাখতে পেরেছে ওদের সামনে। বিশেষতঃ দূর থেকে আসা ছেলেদের ব্যপারটায় যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাতে বিনোদ স্বস্তি পেয়েছে। প্রথম দিন থেকেই শুভ-র সাথে একটা অন্য রকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ওর। যদিও শুভ-র সাথে চরিত্রগত বা সামাজিক অবস্থানের দিক থেকে কোনও মিল নেই ওর। শুভকে দেখলেই বোঝা যায় মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে, কলেজ রাজনীতিতে খুব আগ্রহ ওর। প্রায়ই কিসব সমাজ বদল টদলের কথা বলে। নিয়ম করে পাঠশালায় পড়তে যায়। কিন্তু বিনোদ ওই সিনিয়র দাদাদের পাঠশালায় পড়তে যেতে একদম ভালবাসে না। কলেজে এসে এখন ও একটু ভাল থাকতে চায়। সমস্যা থেকে দূরে। কথাটা স্বার্থপরের মতো শোনালেও সত্যি। ছোটবেলা থেকে সমস্যা আর কষ্টের সঙ্গে লড়াই করে করে ও ক্লান্ত। এরা সমাজতন্ত্রের রূপকথা আওড়ায়। আন্দোলন, সিস্টেম ভেঙে গুঁড়িয়ে নতুন ব্যবস্থার জন্ম……আর ও ভাবে কি করে ওই বেড়াজাল কেটে বেরিয়ে এসে একটা স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন কাটাবে। যে জীবনে সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই ভাবতে হবে না আজ উনুনে হাঁড়ি চড়বে তো? মাস্টারমশাই মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেয়। তাছাড়া নিজের টিউশনের রোজগারে হাতে দু’পয়সা যা আসে খেয়েই উড়িয়ে দেয়। পেট ভরে খেতে কি যে ভাল লাগে বিনোদের। ছোট ভাই বোনের মুখ মনে পড়লে মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবে সে যত যাই হোক বিনোদ মনে মনে জানে ও আর ওই জীবনে ফিরে যাবে না কিছুতেই।
“কি রে কোথায় চললি সকাল সকাল?’ বিনোদ প্রমাদ গোনে। গেল কেস খেয়ে আর গিয়ে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। যাহ! অ্যানাটমি ক্লাসটাতেই ঝাড় নেমে গেল। এমনিতে বায়োকেমিস্ট্রি বা ফিজিওলজিতে অত অসুবিধে নেই। অ্যানাটমিটা ওকেই যা হোক করে কিছুটা হলেও ম্যানেজ করতে হবে। ফার্স্ট এম বি বি এস-র ফাইনাল সেমিস্টারের পরীক্ষা দোরগোড়ায় এসে কড়া নাড়ছে। শুভ-র এখন হুঁশ ফিরেছে। এতদিন আন্দোলন করতে ব্যস্ত ছিল। “ক্লাসে যাব ভাবছিলাম গো।“ বিনোদ একটু কায়দা করে বলে। “ভাল করে পড়াশোনা কর। তোদের পরীক্ষা তো এসে গেল।“ বিভাসের উত্তর শুনে একটু অবাকই হল বিনোদ। বেশ তো! “তোকে দেখে মনে হচ্ছে বেশ চাপে আছিস।“ বিভাসের কথায় বিনোদ মাথা চুলকে বলে, “ ওই দাদা, অ্যানাটমিটা বড্ড ভোগাচ্ছে। আসলে ঠিক করে ক্লাসগুলো করা হয় নি তো।“ “হ্যাঁ, শুভও বলছিল বটে। তবে ও নিয়ে টেনশন করিস না। পরীক্ষার আগের দিন রুমে চলে আসিস। সাজেশন দিয়ে দেব। দেখবি ওইটাই আসবে পরীক্ষায়।“ বিনোদ বোঝে আজ আর ক্লাসের কথা ভেবে লাভ নেই। এর পর যেটা হতে চলেছে সেটা সবটা ওর জানা। বিভাস পরণের গামছাটা বদলে পায়জামাটা গলাবে। তারপর পায়ে হাওয়াই চপ্পলখানা গলিয়ে বিনোদকে বগলদাবা করে শিবুদার ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে হাঁটা লাগাবে। এখন নির্ঘাৎ নাইট ডিউটি চলছে। কাজেই ক্যান্টিনে বসে সারাদিন ছাত্র পড়ানো চলবে। যাক এই লেকচার শোনার একটাই ভাল দিক আছে ফ্রিতে খাওয়াটা মিলবে অন্ততঃ। বিনোদ ক্যান্টিনে যাওয়ার পথে আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে থাকে যদি ওদের ব্যাচের কারোকে দেখতে পায়। কিন্তু হায় বিধি বাম। আজ কোনও দিকে কারোকে দেখতে পায় না। হয়তো ক্লাসে আছে। নাহলে রুমেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। বিনোদের কপালটাই খারাপ। বেজার মুখে চলতে থাকে সে বিভাসের পাশে পাশে। হোস্টেল আর কলেজ ক্যাম্পাসের মলিন লোহার পাঁচ নম্বর গেট পেরিয়ে ইডেন বিল্ডিং বাঁ পাশে রেখে নাক বরাবর হেঁটে গেলে কলেজ ক্যান্টিনের পেছন দিক দিয়ে ঢুকে পড়ল ওরা। হসপিটাল মুভমেন্টের জেরে এখন ক্যান্টিন জেগে ওঠা আগ্নেয়গিরি। ইচ্ছা না থাকলেও বিনোদ গুটি গুটি পায়ে গিয়ে বসল বিভাসের সঙ্গে। ক্যান্টিনের আলোচনার কোনও শুরু বা শেষ থাকে না। আলোচনা শুরু হল হয়তো বর্তমান সমাজে নারীর পণ্যায়ন নিয়ে বেলা গড়িয়ে, সিগারেটের ধোঁয়ায় ক্যান্টিন ভরিয়ে সেই আলোচনা গিয়ে পৌঁছল কোন বিপ্লবপন্থী দাদার স্বর্ণময়ী হস্টেলের ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার গল্পে। বিনোদ উস্খুস করতে থাকে এবার সটকে পড়তে হবে। দুপুরের পেট পুজো হয়ে গেছে দাদাদের উদারতায়। এমনিও আজ আর ক্লাস কিছু হবে না রুমে গিয়ে যদি পড়া কিছুটা ঝালাই করা যায় সে চেষ্টা করা ভাল। বিনোদ উঠে পড়ে ওখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। কিন্তু বিনোদের আজ কপালটাই খারাপ। রুমে ফিরে দেখল সেখানে এক মহা কান্ড হয়ে বসে আছে। ওরা চারজন থাকে রুমে। ওদের ব্যাচের হেঁড়ে কৌশিক। আসলে কৌশিক নামটা এতই কমন যে একই ক্লাসে অন্ততঃ পক্ষে দু’জন কৌশিক তো থাকবেই। তাই সে ক্ষেত্রে কৌশিক নামের সঙ্গে একটা উপরি বিশেষণ লাগিয়ে দেওয়া। যেমন এই কৌশিকের গলা হেঁড়ে তাই একে হেঁড়ে কৌশিক নামেই ডাকা হয়। বিকাশ, সুধীর আর বিনোদ। এদের মধ্যে সুধীর অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। সে শৌখিনও বটে। তার টিনের তোরঙ্গখানা খাটের নীচে রাখা থাকে। তাতে তার যাবতীয় সাজের জিনিস, সাবান, তেল, গায়ে মাখার সুগন্ধী সব তালা বন্ধ রাখা থাকে। হেঁড়ে কৌশিক এই নিয়ে শুরুর থেকেই ওর পেছনে লেগে থাকে। ‘সুধু তোর সাবানটা দে না বগলে বড্ড গন্ধ হয়েছে লাগাব। হেব্বি গন্ধ মাইরি ওটায়।“ কোন দিন বলে, “আজ নাইট শো-য়ে সিনেমা দেখতে যাব তোর সেন্টটা দে না একটু লাগিয়ে যাই। তনিমা না হলে হেব্বি খ্যাচ খ্যাচ করে।“ তনিমা কৌশিকের গার্ল ফ্রেন্ড। কৌশিকের গলার জন্য কোনও কথাই ফিস ফিস করে বলতে পারে না। সে কথা বললে ঘর গমগম করে ওঠে। প্রতিবারই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে সুধীর সে সব আবেদন নাকচ করে। তালা বন্ধ ট্রাঙ্কের আকর্ষণ আরও বাড়তে থাকে। কি এমন সম্পত্তি আছে ওর ভেতরে? আজ সুধীর তালা খুলে আবিষ্কার করেছে যে ট্রাঙ্কের ভেতরের বেশির ভাগ জিনিস উধাও। অথচ তালা যেমন লাগানো ছিল তেমনই আছে। সেই চুরি রহস্যের সমাধান করার জন্য বেশ কয়েকজন সিনিয়রও এসে উপস্থিত হয়েছে ওদের ঘরে। মেঝের ওপর খোলা অবস্থায় চিৎপটাং পড়ে রয়েছে ট্রাঙ্কখানা। তাতে কিছু জামা কাপড়, একটা খালি সাবানের বাক্স, টুকটাক কিছু কাগজপত্র। মজার ব্যপার হল সাবান তেল সেন্ট চুরি গেলেও টাকা পয়সার কোনও এদিক ওদিক হয় নি। সুধীরের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে একটা ভীষণ ঝড় বয়ে গেছে ওর ওপর দিয়ে। বিনোদ ঘরে ঢুকতেই একশো পাঁচের দাদা বলল, “এই যে আমাদের আর একজন প্রাইম সাসপেক্ট এসে গেছে এবার ওকে জেরা করা হোক।“ বিনোদ চমকায়। কি ব্যাপার প্রথমটায় ধরতে পারে না। চুরি শুনে প্রথমেই বুকটা ধক করে ওঠে। ও এদের মধ্যে সব থেকে গরীব। বিনোদ বোঝে সেটা। মাস্টারমশাইয়ের দয়ায় পড়তে পারছে ও। তাই ভয়ে বুক শুকিয়ে যায় ওর। শেষে কী চুরির দায়ে ফেলবে ওকে? তদন্ত জারি থাকল। কিছুতেই রহস্যের সমাধান করা যায় না। চাবি দেওয়া ট্রাঙ্ক সেই চাবি সর্বক্ষণ নিজের সঙ্গে রাখে সুধু। তাহলে জিনিস হাপিশ হবে কিভাবে? এই করতে করতে প্রায় সন্ধ্যে গড়িয়ে এল। বিনোদদের ঘরেই আড্ডা বসে গেল। প্রায় সাতটার নাগাদ হেঁড়ে কৌশিক এসে পৌঁছল ঘরে। ততক্ষণে চুরি থেকে আড্ডার আভিমুখ ঘুরে গেছে আসন্ন ফুটবল লীগের দিকে। মোহন বাগান ইস্টবেঙ্গল দু’ভাগে ভাগ হয়ে উঠে পড়ে লেগেছে ঘটি-বাঙালের তর্জাতে। কৌশিকের আগমণে হুঁশ ফিরল সবার। কৌশিক সন্দীপের দিকে চেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল। সে যখন ক্লাসে গেছিল সন্দীপ তখন গামছা পরে স্নানে যাবে বলে ঘর থেকে বেরিয়েছিল। সেই সন্দীপদা এখনও গামছা পরে তাদের ঘরে কি করছে ভেবে পেল না সে। হতভম্ব কৌশিক বিনোদের দিকে ফিরে হাতের ভঙ্গিমায় জানতে চায় কি ব্যাপার। তখন ঘরে শ্মশানের শান্তি। তারপর চুরির ঘটনা শুনে ঘর ফাটিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে সে। “আমি নিয়েছি তোর জিনিস। কি করবি শালা কর।“ সন্দীপ ভুঁড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বলতে থাকে, “কৌশিকের এই অসাধারণ প্রতিভার জন্য আমার তরফ থেকে সবার জন্য আর আর মাংস রুটি। এবার বল কি করে নিলি?” কৌশিক লাফিয়ে বিছানায় চড়ে ঘরের ঘুলঘুলি থেকে হাত বাড়িয়ে একটা স্ক্র ু ড্রাইভার পেড়ে আনল। এই যে এই ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে। ততক্ষণে ঘরে উপস্থিত সব্বার চোখ ছানাবড়া আর মুখ এত্ত বড় হাঁ। কৌশিক হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল ট্রাঙ্কের কব্জার স্ক্র খুলে সে জিনিস সরিয়েছে। সুধীরকে জিনিসগুলো ফেরত দিয়ে বলেছিল, “নে রাখ।“ তারপর থেকে সুধীর আর তেল সাবান বাক্স বন্দী করে রাখে নি কখনও। রাতে মাংস রুটি খেয়ে বিরাট একটা ঢেঁকুর তুলে বিনোদ যখন বিছানায় শুতে গেল তখন বারোটা বেজে গেছে।