আত্মারাম ও তার সঙ্গীরা রওনা দিল দানীটোলার উদ্দেশ্যে। দল্লিরাজহরা থেকে দানীটোলা বাইশ কিলোমিটার হবে। বিশ না বাইশ, ওরা অত গ্রাহ্য করে না। ওরা জানে এই মূহূর্তে দানীটোলা পৌঁছনোটা খুব জরুরী। কাজেই খুব ভোর থাকতেই উঠে বাসে চেপে রওনা দিয়েছে ত্রিশ-চল্লিশ জন মতো লোক। ওরা জানে সূর্য মাথার ওপর চড়ার আগে পৌঁছে যাবে দানীটোলা।
এখন বসন্তকাল। গাছে গাছে পলাশের ফুল আগুন ধরিয়েছে। লাল মাটির দল্লি রাজহরা এখন কোকিলের কুজনে মুখরিত। ছত্তিশগড় ভূমি যার দিগন্ত জুড়ে যত দূর দেখা যায় পাহাড়ের সারি, কালো মেঘের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সে পাহাড়ের কোলে কোলে ছবির মতো সাজানো আদিবাসী গ্রামগুলি। পাহাড়ের গা থেকে ঝরে পড়ছে স্বচ্ছ জলের ঝর্না। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সরু সরু লাল মাটির রাস্তা অর্থাৎ ডংরি, গ্রামগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে জালের মতন ছড়িয়ে আছে। গগনচুম্বী শাল, পিয়াল, মহুয়ার অরণ্য , ফুটে থাকা বুনো ফুলের গন্ধ, আদিবাসী জনজীবন সব মিলিয়ে যেন এক মোহময় আদিম জীবনের ছাপ ফুটে উঠেছে ছত্তিশগড়ের এই ছোট্ট জনপদে। এমন ফাল্গুনের দিনে কোথায় মেয়ে মরদে মিলে একটু আনন্দ ফুর্তি করবে সে উপায় কি আছে ওদের মতো ঠেকাদারী খনি শ্রমিকদের। দগদগে একটা ঘা বুকে চেপে বসেছে এই মূহূর্তে। রক্ত চুইয়ে পড়ছে সেই ঘা দিয়ে! যে ইউনিয়নের নেতাদের ওপর ওরা অখন্ড বিশ্বাস রেখেছিল সেই নেতারাই তলে তলে ম্যানেজমেন্টের লোকেদের সঙ্গে সমঝোতা করে বসল। যারা পাকা নোকরি করে তাদের বোনাস ৩০৮ রুপিয়া আর তাদের মতো ঠেকাদারী মজদুর পাবে ৭০ রুপিয়া। কাজ তো ওরা একই করছে। ভীষণ ক্ষোভে আর রাগে সব ইউনিয়ন থেকে ওরা বেরিয়ে এল। বেইমান নেতাদের চাই না আর। কাম বন্ধ! লাল ময়দানে ধরনায় বসল। কিন্তু বুদ্ধি বলল এভাবে পারবে না বেশিদিন। দিশাহীন নৌকার কাণ্ডারি চাই, ওদের একজন নেতা চাই। যে ওদের সত্যিকারের ভালবাসবে, ওদের সুখ দুঃখ বুঝবে। ওদেরই একজন হবে সে গদ্দারী করবে না কখনও। আনপড় ঠিকাদার শ্রমিকের এই দলটি জানতেও পারল না নিজেদের অজান্তেই দল্লিরাজহরার বুকে ওরা গড়ে তুলতে চলেছে ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। ওরা শুধু সেই মূহূর্তে মরিয়া হয়ে একজন নেতার তলাশ করছে, যে ওদের সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হবে, ওদের ঘাম, রক্ত আর চোখের জল নিয়ে হোরি খেলবে না। বেমতলব ফায়দা ওঠাবে না! খবর আছে এমন একটা লোক আছে ওদের জন্য। ‘দেওতা’-র মতো সে ঘুরে বেড়ায় এই ছত্তিশগড়ের পাহাড়ে জঙ্গলে। যেখানে তাকে ডাকো সে হাজির। কোথায় যে তাকে পাওয়া যাবে তা কেউ জানে না। কখনও সে দুর্গের হাটে ছাগল বেচে আবার কখনও ফেরিওয়ালা হয়ে মনোহারী জিনিস ফেরি করে। কখনও বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মানুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে আবার কখনও সেচের জলের জন্য চাষাদের সঙ্গে ভিড়ে তাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আবার কখনও বনের পথে পথে খ্যাপার মতো ঘুরে বেড়ায়। আত্মারাম লোকটার সম্বন্ধে অনেক খোঁজখবর নিয়েছে। আগে কোথায় কোথায় ঘুরেছে কে জানে তবে বেশ কয়েক বছর হল লোকটা দানীটোলাতেই থাকছে। সেখানেই একটা খনিতে পাথর ভাঙার কাজ করছিল। প্রেম ভালবাসা করে বিয়ে থা করেছে ওখানেরই এক মজদুরের মেয়েকে। খনির মজদুরদের সংগঠন বানিয়েছিল বলে দানীটোলা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে ঢুকিয়ে ছিল লোকটাকে। আত্মারামের কাছে খবর আছে জেল থেকে সবে ছাড়া পেয়েছে লোকটা। মনে আশা নিয়ে ছুটে এসেছে। যদি ওদের দুর্দশার কথা শুনে ওদের মাথার ছাতাটা হয়ে দাঁড়ায়। দেখতে দেখতে ওরা প্রায় পৌঁছে গেছে দানীটোলা।
আত্মারাম আর তার সঙ্গীর দল যখন দানীটোলা পৌঁছল তখন বেলা বিশেষ গড়ায় নি। বাতাসে লাগে নি উষ্ণতার ছোঁয়া। বাস থেকে একে একে নেমে ওরা লোকটার বাড়ির সন্ধানে গ্রামের ভেতর ঢুকল। এ সময়ে গ্রাম প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। মেয়ে মরদ সব পেটের খাতিরে এদিক ওদিক কাজে গেছে। রয়ে গেছে ডোকরা-ডোকরির (বুড়ো বুড়ির) দল আর কচিকাচারা। রাম জানে না যে কাজে এসেছে সে কাজ হবে কিনা। লোকটার সঙ্গে দেখা হবে কিনা। কিছুদুর এগোতে ওরা দেখল একটা কাঁচা রাস্তা বাঁক খেয়ে ঢালুর দিকে নেমে গেছে। ঢালুর ঠিক আগে একটা পিপল গাছের নীচে বসে এক ডোকরা। এগিয়ে গিয়ে ওর কাছেই জানতে চাইল লোকটার বাড়ি কোন দিকে। বয়স্ক লোকটা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো ওদের দিকে। কারণটা সহজেই অনুমেয়। এই সবে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে লোকটা এর মধ্যেই জনা দশেক ভিন গাঁয়ের লোক খুঁজতে এসেছে দেখে কৌতূহলী হওয়াই স্বাভাবিক। নিঃশব্দে নেমে যাওয়া ঢালু রাস্তার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে মাথা ঈষৎ নাড়াল বুড়ো। ওরা ঢালু বেয়ে নেমে এগিয়ে গিয়ে দেখল পর পর বেশ কয়েকটা খোলার ছাউনি দেওয়া ঘর। আত্মারাম আন্দাজে এগিয়ে গিয়ে একটা ঘরের দরজার শিকল ধরে ঝন ঝন পেটাল। বাকিরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে উৎসুক চোখে সেই দিকে চেয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে মুখ বাড়াল এক কম বয়সী অওরত। গোল মুখখানায় টল টল করছে লাবণ্য। লোকটার খোঁজ করাতে কিছুটা ভয়ে ও দ্বিধায় আমতা আমতা করে বলল, “কাবর পুছত হাস?” ওরা বুঝল ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছে। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল তরুণী। আত্মারাম আর চমকলাল দরজা পার করে পৌঁছাল উঠোনের মধ্যে। সেখানে একটা আম্রুতের পেড় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনের মাঝ বরাবর। তার নীচে একটা দড়ির খাটিয়া পাতা। দুটো বাচ্চা উঠোনের এক ধারে খেলায় মত্ত। তরুণী দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে যায়। ওরা উৎসুক চোখে দরজার দিকে চেয়ে থাকে। এমন সময় পাল্লা ঠেলে মাথা ঈষৎ নামিয়ে দরজা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওদের সামনে দাঁড়ায় যে লম্বা লোকটা তাকে দেখে প্রথমে ওদের মুখে রা কাড়ে না। কেবল আত্মারাম উত্তেজনা চাপতে না পেরে চমকলালের কানে ফিস ফিস করে ওঠে, “শংকর নাম বা উ কার, আসলি নাম কউন জানে কা বা”!
বাইরে কিছুটা খোলা জায়গা থাকায় সেখানেই গোল করে বসে ওরা লোকটাকে ওদের আসার উদ্দেশ্য জানায়। ওদের ইউনিয়ন কেমন করে ওদের ধোঁকা দিয়ে বি এস পি-র হয়ে কাজ করছে সে সব কথা খোলসা করে বলে। লোকটা নির্বিকার মুখে সব শুনতে থাকে। পরণে জেল থেকে পাওয়া জীর্ণ হাফ প্যান্ট আর হাফ হাতা একটা গেঞ্জি। মাথার চুল কিছুটা বড় বড় অবিন্যস্ত। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দেখলে বোঝা যায় অনেকদিন কাঁচি, ব্লেডের স্পর্শ পায় নি। চমকলাল বোঝে লোকটার আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। খুব ধীর অথচ দৃঢ় স্বরে লোকটা বলে এ সমস্যা তো আজকের নয়। ট্রেড ইউনিয়নের এই সমস্যা তো আছেই। আত্মারাম, চমকলালের দল আবদার করে বসে ওদের সঙ্গে তাকে যেতে হবে। লোকটা ঘাড় নাড়ে। “হম উহা যা কে কেয়া করেঙ্গে? ইহ কাম তো আপ হি কর সকতে হো। য়দি আপ লোগ সংগঠিত হোঙ্গে, সমঝেঙ্গে, শোচেঙ্গে তো ইয়ে কাম আপসে না হো অ্যায়সি কোই বাত নহী।“ চমকলাল বলে ওঠে, “মগর হম মজদুর মন ইস কাম মে আনপড় হ্যায়। কায়সে করে, কায়সে না করে। আপ হামারে সাথ চলো।“ ওদের অনুরোধ ফেলতে পারল না লোকটা। সুয্যি যখন ঢলে পড়ল রাজহরা পাহাড়ের গায়ে, ওদের সঙ্গে সে এসে পড়ল খনির শহর দল্লী-রাজহরায়। তখন লাল মাটি উড়িয়ে ঘরে ফিরছে রাখালের দল। ঘরমুখী পাখিদের ডানায় লেগে আছে গোধূলির আলো। ধীরে ধীরে রাতের কালো অন্ধকার ঘিরে ধরল চারপাশের বন, পাহাড়, জনবসতি। সেই অন্ধকারে মিশে রইল এক রাশ অনিশ্চয়তাও।
Bah