শরতের নীল আকাশে সাদা পুঞ্জীভূত মেঘের জমায়েত, শিশিরমাখা শিউলি ফুলের গন্ধ, চারপাশে উৎসবের আলোড়ন মনের গভীরে বার বার কি যেন এক অভিঘাতের সৃষ্টি করে। সেখানে একটা ব্যথা চারিয়ে আছে। সদ্য আঘাতের দগ দগে ঘা। কিন্তু তার ওপরে আবার মোলায়েম একটা প্রলেপ আছে। যেন মানুষ হিসাবে কিছুটা বড় হয়ে যেতে পেরেছে ও। নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের ওপরে যেতে পারলে তবেই তো কর্মের মাধ্যমে মুক্তি। ধর্ম, ঠাকুর, দেবতা এসবে বিশ্বাসী নয় শুভ। মার্ক্স, লেনিন আর এম সি ডি এস এ-র বীজ মন্ত্র ওর ধমনীতে বইছে। লাল মাটির একটা দেশ শুভব্রতকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। দীর্ঘদেহী মানুষটার কন্ঠস্বর কানে বাজতে থাকে। “জেল কা তালা টুটেগা, হামারা সাথী ছুটেগা”। এমনই এক শরতের দিনে দল্লি রাজহরায় পৌঁছল শুভ। সঙ্গে রুম মেট তরুণ। বাস তো নামিয়ে দিয়ে খালাস। এবার শহীদ হাসপাতাল পৌঁছায় কি ভাবে? পিচ ঢালা বড় রাস্তা ধরে দু’জনে চলতে লাগল। অজানার আকর্ষণ আছে, অচেনার অস্বস্তি আছে। তবু দেখতেই তো এসেছে। কাজেই ছত্তিশগড়ের কাঠ ফাটা রোদ মাথায় নিয়ে দুই ডাক্তার হাঁটতে লাগল। কিছুটা যেতে দেখা মিলল, ছত্তিশগড় মাইন্স সংঘের লাল সবুজ পতাকা ওড়ানো জীপের। দাঁড়ালো ওরা, হাত দেখালো। সেই জীপই ওদের পৌঁছে দিল শহীদ হাসপাতালের দোরগড়ায়। একটা টিলার ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে পনেরো বেডের হাসপাতাল। সামনে উঁচু ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে। অল্প দূরে বিশাল ইউনিয়ন অফিস। ঘুরে ঘুরে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে শুভ। শংকর গুহনিয়োগী সম্বন্ধে, ছত্তিশগড় আন্দোলন সম্বন্ধে প্রথম জানতে পারে ১৯৭৯-এ, তখন শুভ মেডিক্যাল কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র। বোধ হয় কাটের্ন নামের এক পত্রিকায় সেসব কথা প্রথম পড়েছিল ও। ১৯৮২-তে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় এক সিনিয়র দাদা, ডা. পবিত্র গুহ শুনিয়েছিলেন ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘ-এর সাফাই আন্দোলন, শহীদ ডিস্পেন্সারি, শহীদ হাসপাতাল তৈরির স্বপ্ন…এসবের কথা। পবিত্রদা ১৯৮১ থেকে কয়েক মাস সি এম এস এস-এর সঙ্গে কাজ করেছিলেন। ঘুরে ঘুরে হাসপাতাল দেখল ওরা। সর্বত্র একটা ইতিবাচক আদর্শের ছাপ ফুটে উঠেছে। তারপর ইউনিয়ন রুমে বসে নিয়োগীজির সাথে কথা হল। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, অনেক স্বপ্নের কথা। শুভ-র ভীষণ ভাল লেগে গেল। আর অন্য ভাবনা নয়, মন ঠিক করে ফেলল এখানেই আসবে পাকাপাকিভাবে। এখানেই জয়েন করবে। তাই পারিশ্রমিকের কথা মুখ ফুটে জানতেও চাইল না। শৈবালদা মানে ড: শৈবাল জানা আর আশীষদা অর্থাৎ ড: আশীষ কুন্ডু এদের সাথেও অনেক কথা হল। খাওয়া দাওয়া করে গেস্ট হাউসে ফিরে এক চোট বিশ্রাম নিয়ে নিল ওরা। যখন ঘুম ভাঙল তখন সূর্য পশ্চিমে পাহাড়ের কোলে ঢোলে পড়েছে। কেবল তার লাল ছটা কালো কালো পাহাড়ের গা বেয়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কলকাতায় আজন্ম লালিত হওয়া ছেলেটা এই মূহূর্তে এই মহৎ কাজে সামিল হওয়ার সুযোগ পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করল। কিন্তু চলার পথের কাঁকড়গুলো সম্বন্ধে বাস্তব জ্ঞান তার কি বা আছে! শুধু জেনে নিয়েছে ইলেক্ট্রিক আর পায়খানা, স্নান করার ব্যবস্থা আছে কিনা। ও দুটো না হলে তার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব নয়। এ যাত্রায় দু’দিনেই ফেরার কথা। ট্রেনের টিকিটও সেভাবেই করা আছে। কিন্তু ভাবলেই যে পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কিছু সুষ্ঠুভাবে হবে সে নিশ্চয়তা কে কবে পেয়েছে। প্রথম রাত তো কাটল একরকম। পরের দিন ভোরে দু’বন্ধু মিলে আগে চলল আশেপাশের গ্রাম দেখতে। লোহা খনির শ্রমিকদের জীবনশৈলী সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়া যাবে তাহলে। বেলার দিকে দুজনে দুটো সাইকেল জোগাড় করে ফেলল। হসপিটালের ঠিক উল্টো দিকে আছে উঁচু টিলা। এসব জায়গার মাটি লোহার আকর।
দু’বন্ধুতে সেই টিলার ওপরে পৌঁছে গেল। কিশোরবেলার উন্মাদনা ঘিরে ধরল দু’জনকে। রেস! রেস! রেস! আচমকা সাইকেলের হ্যান্ডেলটা ঘোরাতেই, কি হল কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাইকেল থেকে ছিটকে পড়ল শুভ। সেই দিনদুপুরে চোখে নেমে এল রাতের অন্ধকার। আর কিছু মনে নেই ওর। জ্ঞান ফিরল যখন তখন মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা। সারা শরীরে ব্যথা, মাথায় একটা ব্যান্ডেজ করা আছে, উঠে বসার ক্ষমতা নেই শুভ-র। এ অবস্থায় ওখানেই দু-তিন কাটল। ট্রেনের টিকিট নতুন করে পাওয়া মুশকিল। অত্যন্ত কষ্ট সহ্য করে অবশেষে ফিরল কলকাতায়। তবে ডিসেম্বরে ওখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলালো না। কলেজের সিনিয়র দাদাদের অভিমত এ ব্যাপারে মোটেই ইতিবাচক ছিল না। সব স্যারেরাও যে তার এই সিদ্ধান্তকে খুব উৎসাহ দিয়েছেন এমনটা নয়। তবে শুভ-র মা বাবা তার এই সিদ্ধান্তে আপত্তি করেন নি একেবারেই। হয়তো আর নতুন করে কোনও সমস্যা তৈরি করতে চাননি। হয়তো ভেবেছেন এই কাজে জুটে গেলে শুভ-র মনের ভাঙা টুকরো গুলো জুড়ে যাবে আবার।
শৈবালদার মুখে দল্লিরাজহরার শহীদ হাসপাতালের গল্প শুনে খুব ভাল লেগেছে অলকানন্দার। দিদির সঙ্গে আলাপের সুবাদেই শৈবালদা একদিন বাড়িতে এসেছিল। সেখানকার শ্রমিকদের তিল তিল করে হাসপাতাল গড়ে তোলা, ডাক্তারদের এই স্বাস্থ্য আন্দোলনে সামিল হওয়া, এইসব শুনে মনে হয় মানুষের জন্য কিছু কাজ করতে পারাটা বোধ হয় খুব জরুরী। সে মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে। এই বিশ্বের কোনও ঘটনাই বিচ্ছিন্ন নয়। সব কিছু এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে বাঁধা। একটি মানুষের চেতনার অভ্যুত্থান ক্রমশ: একের পর এক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিক থেকে বুদ্ধিজীবি থেকে, ডাক্তার থেকে, শিক্ষার্থী থেকে সব্বাই একে একে জুড়ে যায় সেই নির্মাণ কাজে। এই যোগসূত্র জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সেই সূদূর ছত্তিশগড় থেকে সালকিয়ার এক সাধারণ মেয়ের মনে। শৈবালদা বলছিল মেডিকেল কলেজ থেকে একজন নতুন ডাক্তার যোগ দেবে ওখানে। সে আবার ওখানে গিয়ে সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে রক্তাক্ত কান্ড ঘটিয়েছে। বেচারা আবার তোতলা!