১৯৮৭-র ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। কনকনে ঠান্ডার রাত। সারাদিনে প্রচুর ধকল গেছে। তাই অকাতরে ঘুমোচ্ছে শুভ। এখন শহীদ হাসপাতালের ডাক্তার বলতে সে আর ড: শৈবাল জানা। বাকি যাঁরা শহীদ হাসপাতাল শুরু হওয়ার আগে থেকে এখানে ছিলেন তাঁরা কোনও না কোনও ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা কর্ম সংক্রান্ত কারণে এখান থেকে চলে গেছেন। শুভ শল্য চিকিৎসার দিকটা দেখে। ড: জানা মেডিসিন আর অবস্ট্রেটিক বিভাগ সামলান। অপারেশনের সময় সকাল সাতটা থেকে। তারপর ওয়ার্ডে রাউন্ড দেওয়া সেরে সকাল সাড়ে ন’টার থেকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত আউটডোর। বিকেলে আবার সাড়ে চারটের থেকে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত আউটডোর। তারপর ওয়ার্ডে রাউন্ড দেওয়া, রাতের সিস্টারদের যথাযথ নির্দেশ দেওয়া। এমন একটা ব্যস্ত দিনের পরে ঠান্ডার রাতে অঘোরে ঘুমোনাটাই স্বাভাবিক। ড: জানা মপেড চালাতে গিয়ে পা ভেঙে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় শুভকেই দায়িত্ব নিয়ে সবটা করতে হচ্ছে। আজ শুভ দুটো আপেন্ডিসেক্টমি সেরে বিকেলের আউটডোরে যখন বসেছে একজন মহিলা এলেন পেটের ডানদিকে ব্যথা নিয়ে। পরীক্ষা করে মনে হল আপেন্ডিসাইটিস হবে। রাইলস টিউব দেওয়া হল আর স্যালাইন চালাতে নির্দেশ দেওয়া হল। শুভ ঠিক করল, অপারেশন করতে হলে বিকেলের আউটডোর সেরে অপারেশন করবে। এরপর রাতের রাউন্ডে গিয়ে দেখে এসেছে রোগিণী বেশ ভালই আছে। পেটের ব্যথা কমেছে। রক্তচাপ আর নাড়ীর গতি স্বাভাবিক হয়েছে। রোগিণী মুখে খাবার খেতে চাইছেন। পরিস্থিতি বুঝে অপারেশনের সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে। স্যালাইন চালু রাখার নির্দেশ দিয়ে, ঘরে ফিরে খাওয়া দাওয়া করে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে শুভ। মাঝ রাতে একবার সিস্টার এসে জানিয়ে গেছে, রোগিণী নড়া চড়া করতে গিয়ে স্যালাইন খুলে ফেলেছে। রক্তচাপ, নাড়ীর গতি স্বাভাবিক আছে শুনে শুভ নিশ্চিন্তে শুতে গেছে। কাল সকালে যা হোক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। রাত নিস্তব্ধ। শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের কনসার্ট চলছে।আর পাতায় জমে থাকা রাতের হিম টুপ টাপ করে খসে পড়ার শব্দ, শেয়ালের রোদন, সব মিলিয়ে যেন রহস্য জগতের সৃষ্টি হয়েছে চারপাশে। ডাক্তার, হসপিটাল, চিকিৎসা সব থাকা সত্ত্বেও মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তা অস্বীকার করা যায় না। হয়তো একটা সিদ্ধান্ত, হয়তো একটা মূহূর্তের অন্যমনস্কতা, মানবীয় কিছু ত্রুটি—- চিকিৎসা বিজ্ঞান এর উর্ধ্বে উঠতে পারে না। একেই সাধারণ মানুষ নিয়তি নামে চেনে। সেই নিয়তিই সেদিন গ্রাম্য বধূটির শিয়রে এসে দাঁড়াল। দরজায় ধপ ধপ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল শুভ-র। সিস্টার ডাকছে। ধড়মড় করে উঠে বসল শুভ। বিছানা ছেড়ে গায়ে চাদর চাপিয়ে ছুটল ওয়ার্ডের দিকে। ইমার্জেন্সি! রোগিণীর অবস্থা সংকটজনক। বাঁচানো গেল না তাকে। ঝরণদল্লির খনিতে পাথর ভাঙার কাজ করতেন স্বামী স্ত্রী। মহিলা ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। অকালেই ঝরে পড়ল একটা জীবন। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল মাস দুয়েক হল মাসিক বন্ধ ছিল ওঁর। কেসটা আপেন্ডিসাইটিসই নয়। এটা এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি কেস। যেখানে ভ্রূণ জরায়ুতে না পৌঁছে, নালির মধ্যে নিজেকে স্থাপিত করে। ফলে যত দিন যায় আকার বৃদ্ধি পায় ও নালি ফেটে অসম্ভব যন্ত্রণা হতে শুরু করে। সময়ে ধরা গেলে অপারেশন করে রোগিণীকে বাঁচানো সম্ভব। মেয়েটির স্বামী, ইউনিয়নের সবাই এই আকস্মিক মৃত্যুতে হতভম্ব হয়ে গেল।
একরাশ অপরাধবোধ এসে গ্রাস করে শুভকে। সাফল্যের অভিঘাত সুখকর। কিন্তু অসাফল্যের অভিঘাত সয়ে নেওয়া যে মুখের কথা নয়। ডাক্তারদের সেই বোঝা বইবার শক্তি সঞ্চার করতে হবে। শুভ যেহেতু স্বামী স্ত্রী দু’জনকেই চিনত, ওর অপরাধবোধের পরিমাণ যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠল। কিছুতেই নিজের দায়িত্বহীনতার বোঝা অস্বীকার করে উঠতে পারছে না। সে মনে মনে ঠিক করল এই পাপের বোঝা কিছুটা হলেও হাল্কা করতেই হবে। হাসপাতাল কর্মীদের মিটিং ডাকা হল। শুভ বসে আছে চুপ করে। বুকের মধ্যে একটা কামারশালের হাপড়ের ওঠানামা। ভেতরে ভেতরে নিজেকে শক্ত করে ও। ওদের জানা দরকার যে তার একটা ভুলের জন্যই আজ অসময়ে মরেছে মেয়েটা।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, জীবন আর কোনও দিনও এই ভুল করবে না সে। মহিলা পেশেন্টের ঋতুচক্রের ইতিহাস নেওয়া যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে শুভ। মৃত্যু বিফল হয় নি মেয়েটির। একটা জরুরী শিক্ষা হয়তো বাঁচিয়ে দেবে আরও অনেক প্রাণ। শুভ ভুলবে না। ভুলতে পারে না।
সবার সামনে কবুল করেও যেন মন খারাপ কমতে চায় না। নিয়োগীজির কাছেও একান্তে পাড়ল কথাটা। নিয়োগীজি শান্ত হয়ে শুনলেন সবটা। অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন কথায় কথায়। এরপর দিন কেটে গেল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ লাগার তীব্রতা কিছুটা হলেও লাঘব হল। বিভিন্ন ভাল মন্দ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে শুভ-র দিন কাটতে লাগল শহীদ হাসপাতালে।ব্যক্তিগত পরিসরে অলকানন্দার সাথে সম্পর্ক গভীর হল। ঘন ঘন চিঠিতে যোগাযোগ হতে লাগল। তার জীবনের যে ছন্দ সেই ছন্দ মিলবে কি শহুরে শিক্ষিত ওই মেয়ের জীবনের ছন্দের সাথে। এদিকে অদ্ভূতভাবে বিয়ে হল ড: জানা ও আল্পনাদির। আল্পনাদি অলকানন্দার দিদি। মাঠের মধ্যে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হল। আদিবাসীদের আত্মীয়তায়, কলকাতা থেকে বহুদূরে, দুইটি মানুষ একসঙ্গে জীবনের পথ চলার সিদ্ধান্ত নিলেন। আল্পনাদি শহীদ হাসপাতালের একমাত্র ট্রেন্ড নার্স হিসাবে জুড়ে গেলেন। এক দশকের যাত্রা শেষ করে নব্বইয়ের দশকে পা রাখল আপামর মানুষের সভ্যতা। আর এক দশক কাটাতে পারলে একবিংশের সূচনা।
ক্রমশ…