আমাদের দেশের ১৪০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার স্বাস্থ্যকে যাঁরা দেখভাল করেন সেই স্বাস্থ্য কর্মীরা কেমন আছেন?
এটি একটি বিশাল বিষয় ও প্রেক্ষিত। সব চাইতে বেশি ভারতীয় যেখানে বাস করেন আমরা এখানে সেই গ্রামীণ ভারতের একদম গ্রাম স্তরে যে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মীরা সারা বছর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি পরিষেবা দিয়ে থাকেন তাঁদের প্রধান কয়েকটি অংশের বিষয়ে এই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখছি।
বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অনুষ্ঠিত একটি আলোচনা সভায় স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথে যুক্ত অসরকারি সংস্থা Child In Need Institute (CINI)-এর প্রতিষ্ঠাতা, বর্তমানে ইতালি নিবাসী শিশু চিকিৎসক ডা. সমীর চৌধুরি হিসেব করে দেখিয়েছিলেন যে গ্রাম স্তরে স্বাস্থ্য দফতর, পঞ্চায়েত সহ বিভিন্ন সংস্থার অন্তত ১০ জন কর্মী স্বাস্থ্য পরিষেবার সাথে যুক্ত এবং নতুন সংযোজনের আগে প্রয়োজন তাঁদের দক্ষতাকে যতটা বেশি সম্ভব গ্রহণ করা ও তাঁদের মধ্যেকার সঠিক সমন্বয়।
বিষয়টি খুব নাড়া দেয় এবং গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদান ও জাতীয় কর্মসূচিগুলি পালনের ক্ষেত্রে, তার সাথে বন্যা ইত্যাদি আপৎকালীন ব্যবস্থায়, স্বাস্থ্য দফতর নিয়োজিত Block Public Health Nurse (BPHN), PHN, Block Sanitary Inspector (BSI), SI, Malaria Inspector (MI), Medical Technologist (MT), Social Welfare Officer (SWO), Health Supervisor (HS), Health Assistant (HA), Auxiliary Nurse & Midwifery (ANM), Accredited Social Health Activist (ASHA), Community Health Guide (CHG), Trained Dai, Vaccine Carrier, Senior Treatment Supervisor (STS), Senior Tuberculosis Laboratory Supervisor (STLS), Laboratory Technician (LT), DOT Provider প্রভৃতি কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক, পঞ্চায়েতের গ্রাম সেবক, স্বাস্থ্যের দায়িত্বপূর্ণ পঞ্চায়েত সদস্য, অঙ্গনওয়ারি কর্মী, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এর কর্মীদের সমন্বয় করে কাজ করার চেষ্টা করি এবং সুফল পাই। তার সঙ্গে সঙ্গে এই তৃণমূল স্তরের স্বাস্থ্য কর্মীদের কঠোর জীবন সংগ্রাম ও সমস্যাগুলি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করি।
তাহাদের কথা:
১) বছর দুই আগে MPH (Master of Public Health) স্কলার দের নিয়ে মালদা আর মুর্শিদাবাদ জেলার কালিয়াচক, গাজোল, ডোমকল, জলঙ্গি, সামসেরগঞ্জ, ভগবানগোলা প্রভৃতি ব্লকে Outbreak Investigations-এ গিয়েছিলাম। ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক এবং প্রধানরা আতিথেয়তার সাথে সাথে আমাদের সহায়তা করতে বেশ কিছু যুবক যুবতীদের পাঠিয়েছেন। কেউ KTS (Kala-azar Treatment Supervisor), কেউ Block Epidemiologist, কেউ Block Public Health Manager, Block Data Manager ইত্যাদি। সবই contractual কর্মী। সব শিক্ষিত গুণী ছেলেমেয়ে। চাকরি নিয়ে নানারকম সমস্যা আর আশঙ্কায় ভুগছেন। এদিকে বয়স হয়ে যাচ্ছে। অনেকেরই অভাবী পরিবার এবং তাঁদের উপর নির্ভরশীল। তাঁদের সাথে রয়েছেন VST (Vector Survey Team), VCT (Vector Control Team) প্রভৃতির সদস্য সাধারণ প্রশাসন নিযুক্ত এক গুচ্ছ যুবক যুবতী। অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত, কয়েকজন আয়ুষ চিকিৎসকও রয়েছেন। জেনে খারাপ লাগলো তাঁদের প্রোগ্রাম অনুযায়ী কাজ এবং সেই সময় ভাতা দৈনিক মাত্র ১৭৫ টাকা।
২) ৩০ বছর আগে ফিরে যাই। টানা কয়েক বছর ধরে প্রত্যন্ত গ্রামের এক গ্রামীণ হাসপাতাল চালানোর নিত্য নৈমিত্তিক সমস্যা। সহযোগী চিকিৎসক, নার্সিং ও স্বাস্থ্য কর্মীরা সহযোগিতা করেন তবে কয়েকজন মুশকিল আসান-এর নাম এখনও স্মরণ করি: বড়কা দা (বড়কা দুসাদ, গ্রুপ ডি কর্মী হলেও আসলে হাসপাতালের সার্জন ও অ্যানেসথেটিস্ট), মন্মথ দা (মন্মথ জমাদার, সাফাই কর্মী), ইসলাম (ডা. বজলুল ইসলাম, CHSO), শুভেন্দু (অফিস কর্মী) এবং চন্দন। চন্দন ছিল এক বিধবা গ্রুপ ডি কর্মীর বেকার সন্তান। বাড়িতে অনেকগুলি পেট। সবার ফাইফরমাশ খাটে, হাসপাতালের যে কোন কাজ করে দেয়। আসলে সে একজন Vaccine Carrier। ঝড় বৃষ্টি সব ঋতুতে দূরদূরান্তে হেঁটে সাইকেলে ভ্যাকসিন পৌঁছে দেয় ও নিয়ে আসে। অতি সামান্য টাকা contingency থেকে দেওয়া হয়। তাও অনেক দিন পরে পরে, টাকা ঢুকলে।
৩) তৃণমূল স্তরের স্বাস্থ্য কর্মীদের দুর্দশার এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। লেখা না বাড়িয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রাণভোমরা আশা কর্মীদের একটি উদাহরণ দিয়ে এই পর্ব শেষ করি। বাম শাসনের শেষ দিকে এবং তৃণমূল ক্ষমতায় আসার সময় খুব সংকটময় ও অস্থির পরিস্থিতিতে একটি জেলার জনস্বাস্থ্যের পাশাপাশি মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের দায়িত্ব অনেকদিন পালন করতে হয়। অনেকেই দেখা করতে আসতেন। একদিন অফিসে দুপুরের দিকে এক সুদর্শন তরুণ দম্পতি দেখা করতে আসেন। মেয়েটির সমস্যা একটি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের আশা কর্মী নির্বাচিত হওয়া সত্বেও আইনি জটিলতায় অনেক মাস হয়ে গেল কাজে যোগ দিতে পারছেন না। তাঁর আবেদন পত্র দেখে অবাক হয়ে গেলাম। মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়েটি এম এ পাশ। আশা কর্মী হওয়ার একাডেমিক কোয়ালিফিকেশন ক্লাশ এইট পাশ। মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে গেলো: “আপনি এত শিক্ষিত হয়েও আশা কর্মীর কাজ করবেন?” মেয়েটির বিনীত উত্তর: “উপায় কি? অন্য কিছু তো পাচ্ছিনা।” আর কিছু বলতে পারিনি।
আশা কর্মীদের সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করি। সৌভাগ্য সেই সময় ওখানকার দাপুটে কিন্তু সহৃদয় জেলা শাসক এবং অত্যন্ত ভালোমানুষ জনজাতি সম্প্রদায়ের মহিলা সভাধিপতি খুব সাহায্য করেন। আশা কর্মীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁদের সংগঠনের সাথেও যুক্ত হয়ে পড়ি। উপদেষ্টা হিসেবে তাঁদের দাবী সনদ তৈরিতে, তাঁদের রাজ্য সম্মেলনে এবং স্বাস্থ্য ভবনে তাঁদের ডেপুটেশনে অংশ নেই। অন্যান্য বিষয়ের সাথে মেক্সিকোর জনজাতি অঞ্চলে ডেভিড ওয়ার্নার-এর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আশা কর্মীদের সঙ্গে মেডিসিন কিট রাখা, তাঁদের টর্চ, ছাতা ও সাইকেল দেওয়ার বিষয়গুলি আমরা রাখি।
এর কিছুদিন পরেই অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশা কর্মীদের সল্ট লেক স্টেডিয়ামে ডেকে এগুলি দেওয়ার এবং তাঁদের সাম্মানিকের একটি অংশ fixed amount করার প্রতিশ্রুতি দেন। অচিরেই আশা কর্মীরা শুধু স্বাস্থ্য নয় দুয়ারে সরকার, পাড়ায় সমাধান, ভোটার লিষ্ট তৈরি, আবাস যোজনা থেকে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণের একটি প্রধান স্তম্ভ হয়ে ওঠেন।
এক নজরে আশা, অঙ্গনওয়াদি কর্মী ও সহায়িকা এবং মিড ডে মিলের রাঁধুনি ও সহায়িকা দের সাম্মানিক এবং সহায়ক পুষ্টি ও মিড ডে মিলের বরাদ্দ:
এর মধ্যে সবচাইতে পুরনো প্রোগ্রাম মিড ডে মিল। ১৯৫৬ সাল থেকে এই প্রোগ্রাম তামিলনাড়ুতে চলার পর এবং শিক্ষার্থীদের পুষ্টি, মানসিক বিকাশ, স্কুলে আসার উৎসাহ বৃদ্ধি, অন্যদিকে তাদের পরিবার থেকে স্কুলে পাঠানো বৃদ্ধি প্রভৃতির সাফল্যের পর তামিলনাড়ুতে সরকারি ও সরকার পোষিত স্কুলে দুপুরের খাবার ছাড়াও সকালে প্রাতরাশের ব্যবস্থা করা হয়। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে চালু করার সিদ্ধান্ত হয় এবং ১৯৯৫ থেকে অন্যান্য রাজ্যে চালু হয়। কেরল, তামিলনাড়ু যে রাজ্যগুলিতে এই প্রকল্প ভালো চললো সেখানে মূল উদ্যোগ ও আর্থিক বরাদ্দ রাজ্যের।
অনেক রাজ্যে টালবাহানার মধ্যে শীর্ষ আদালত নির্দিষ্ট নির্দেশ দেন যে সমস্ত সরকারি ও সরকার পোষিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র ছাত্রীদের দিনের মাঝে গরম রান্না করা খাবার দিতে হবে। তারপর থেকে কোথাও ভালো ভাবে, কোথাও কোন রকমে, আবার কোথাও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এই প্রকল্প চলছে। ২০২১ থেকে এই প্রকল্পের নাম পরিবর্তন হয়ে হয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রী পোষণ শক্তি নির্মাণ যোজনা’ বা ‘পি এম পোষণ’। সর্বশেষ নির্দেশে প্রত্যেক ছাত্র ছাত্রীকে ৩০০ ক্যালরি শক্তি উৎপাদনকারী সহায়ক খাদ্য দিতে হবে যার মধ্যে ৮ থেকে ১২ গ্রাম প্রোটিন থাকতে হবে। এর জন্যে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্কুলে ছাত্র প্রতি দৈনিক বরাদ্দ যথাক্রমে ৫.৪ ও ৮.১ টাকা মাত্র।
পশ্চিমবঙ্গে এর রান্না ও সরবরাহ র সাথে যুক্ত রাঁধুনি ও সহায়িকারা (Cook cum Helper বা CCH) পান মাসে মাত্র এক হাজার টাকা করে। এপ্রিল থেকে আরও ৫০০ টাকা বেড়ে হবে ১৫০০। ২৫ জন ছাত্র প্রতি একজন, ২৫ থেকে ১০০ দুজন, তার বেশি তিনজন … এরকম ভাগ আছে। টাকাটা এমনিতেই খুব কম, তার উপর কেবল ১০ মাসের পাওয়া যায়, তার উপর মহিলা স্বনির্ভর দল (Self Help Group বা SHG) পায় বলে ভাগ হয়ে প্রায় কিছুই থাকে না। আবার একাধিক SHG পাওয়ায় শুধু যে সময়টুকু কাজ পাওয়া যায় সেটুকুরই ভাগ হওয়া টাকা। প্রায় কিছুই না। কি অমানবিক, নিদারুণ পরিস্থিতি। যেখানে জনগণের কষ্টার্জিত টাকা থেকে অসাধু নেতা মন্ত্রীরা কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ বা অপচয় করে সেখানে শিশু শিক্ষার্থীদের খাবার এবং কর্মীদের পারিশ্রমিক নিয়ে কি সাংঘাতিক কার্পণ্য! এই বিষয়গুলি নিয়ে CCH-রা বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলে আন্দোলনের পথে নেমেছেন। ইতিমধ্যে AMMA প্রমুখ কিছু সংগঠনের উদ্যোগ চোখে পড়েছে।
আবার মিড ডে মিলের অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কোন স্কুলে রান্নার জায়গা নেই, কোথাও বাচ্চাদের বসে খাওয়ার জায়গা নেই, কোথাও স্কুল গৃহের চাল নেই, কোথাও সামান্য জলে মেঝে ভেসে যায়। কোথাও বাইরে থেকে খাবার আনা হয় তা অনেক সময় ঠাণ্ডা ও মিইয়ে যাওয়া থাকে, মানও খারাপ থাকে। কখনও খাবারের মধ্যে টিকটিকি, সাপ ইত্যাদি পাওয়া যায়। বাচ্চাদের ঐ সামান্য খাদ্য নিয়েও চুরি ও দুর্নীতি হয়। পঞ্চায়েত ও রাজনীতির লোক ঢুকে নানারকম গোলমাল পাকায়। রান্নার বরাত পাওয়া নিয়েও এই গরীব রাজ্যের অনেক জেলায় দেখেছি দু দলের মারামারি, বোমা ও গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটেছে।
Integrated Child Development Services অথবা ICDS চালু হয় ১৯৭৫ সালে শিশু, নারী ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রকের অধীনে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল স্বাস্থ্য পরীক্ষা, স্বাস্থ্য শিক্ষা, সহযোগী পুষ্টি (Supplementary Nutrition), বিদ্যালয় পূর্ব অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা (Non-formal Preschool Education)। এর উপভোক্তারা হলেন ছয় বছর বয়স অবধি শিশুরা, বয়ঃসন্ধির মেয়েরা এবং নারীরা বিশেষত গর্ভবতী মহিলারা। আর্থিক সাহায্য কেন্দ্র : রাজ্য :: ৬০ : ৪০। কেন্দ্র সাহায্য উত্তর পূর্ব ও হিমালয় অঞ্চলে এবং বিধানসভাহীন কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে যথাক্রমে ৯০ % ও ১০০ %। প্রতি ৪০০ থেকে ৮০০ জনসংখ্যায় একজন অঙ্গনওয়ারি কর্মী (Anganwadi Worker বা AAW) থাকার কথা। দেশের ৭০৭৫ টি ICDS ব্লকে ১৩ লক্ষ ৭৭ হাজার অঙ্গনওয়ারি কেন্দ্র (AWC) এবং সমগ্র উপভোক্তার সংখ্যা ৮ কোটি ৩৬ লক্ষ ২৫ হাজার।
সহযোগী পুষ্টির জন্য বছরে ৩০০ দিনের জন্যে ছয় বছর বয়সী অবধি শিশুদের দেওয়ার কথা দৈনিক ৫০০ ক্যালরি যার মধ্যে থাকবে ১২ থেকে ১৫ গ্রাম প্রোটিন। আর বরাদ্দ মাত্র আট টাকা শিশু প্রতি। যে শিশুরা গুরুতর অপুষ্টিতে ভুগছেন তাঁদের জন্য দৈনিক মাত্র সাড়ে নয় টাকা এবং গর্ভবতী মহিলাদের জন্য মাত্র ১২ টাকা। এই সামান্য বরাদ্দে সকালে দুধ / কলা / ডিম / ফল / বিস্কিট / কেক এবং দুপুরে গরম রান্না খাবার দেওয়ার কথা। পশ্চিমবঙ্গে একজন AAW মাসে ৮২৫০ টাকা এবং একজন অঙ্গনওয়ারি হেল্পার মাসে ৬০০০ টাকা পান। এপ্রিল থেকে তাঁদের যথাক্রমে ৭৫০ ও ৫০০ টাকা করে বাড়ার কথা। সহযোগী পুষ্টিতে কম বরাদ্দ, কর্মীদের অল্প পারিশ্রমিক ছাড়াও বেশিরভাগ AWC ভাঙ্গাচোরা, অপরিচ্ছন্ন, অন্ধকার, বিদ্যুৎহীন ইত্যাদি। রান্না করা তো পরের বিষয়। আর জ্বালানির যা দাম এই সামান্য বরাদ্দে খাবার কিনে রান্না করে খেতে দেওয়া কি সম্ভব? ফলে অনেকসময় তাঁরা বাধ্য হন উপভোক্তাদের কাঁচা মাল বা টাকা দিয়ে দিতে যা প্রকল্পের মূল নীতির বিরোধী। তাঁদের কেন্দ্রে যখনই গেছি এগুলি বলার সাথে কাতর অনুরোধ করেছেন বাচ্চাগুলোর মুখ চেয়ে তাদের খাবার টাকার বরাদ্দ কিছুটা বাড়িয়ে দিতে। অনেক জায়গায় দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছি এই গরীব কর্মীরা তাঁদের অপ্রতুল পারিশ্রমিকের টাকা থেকে শিশুদের খাবার কিনে দিচ্ছেন। পঞ্চায়েত ও স্বাস্থ্য দফতরের সাথে অনেকক্ষেত্রেই সমন্বয়ের প্রচণ্ড অভাব। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দুর্নীতি, আধুনিক প্রশিক্ষণের অভাব ইত্যাদি তো রয়েইছে।
রাজস্থান, ছত্তিশগড় প্রভৃতি রাজ্যে জন স্বাস্থ্য আন্দোলনগুলিতে তৃণমূল স্তরের স্বাস্থ্য কর্মীদের সদর্থক ভূমিকা দেখে কেন্দ্র সরকার ২০০৫ সালে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের (National Rural Health Mission বা NRHM, পরে NHM) অধীনে ASHA (Accredited Social Health Activist)-দের নিয়োগ করেন দেশের গ্রামাঞ্চলে প্রতি ১০০০ জনসংখ্যায়। আদিবাসী, পাহাড়ী ও মরুময় অঞ্চলে আরও কম জন সংখ্যায়। সেই গ্রামেরই কোন উপযুক্ত মহিলা (বিবাহিতা / বিধবা / বিবাহ বিচ্ছিন্নদের গ্রহণ করা হয় যেহেতু তাঁদের ঐ গ্রামেই থাকার সম্ভাবনা) যাঁর বয়স ২৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে এবং অষ্টম ক্লাশ অবধি পড়া রয়েছে তাঁদের নির্বাচিত করে প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রামের মানুষের প্রাথমিক যাবতীয় স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হল। বেগুনি শাড়ি পরিহিতা এই স্বাস্থ্যকর্মীরা উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ANM-দের অধীনে কাজ করতে শুরু করলেন। পরে শহরের পৌরসভার অধীনেও শহরের তৃণমূল স্তরের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেখতে তাঁদের নিয়োগ করা হলো।
কালক্রমে তাঁদের নিজেদের ছাড়াও অন্যদের এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যাবতীয় কাজকর্ম এদের মাথার উপর চাপিয়ে দেওয়া হল। পরবর্তীকালে ভোটার লিষ্ট তৈরি থেকে আবাস যোজনার কাজ কিইনা তাঁদের দিয়ে করানো হলো।
অথচ রাত দিন ৩৬৫ দিন কাজ করা এই গ্রামীণ স্বাস্থ্য কর্মীদের সামান্য সাম্মানিকের সাথে কাজ প্রতি যৎসামান্য ভাতার ব্যবস্থা হল। সেটিও খুবই অনিয়মিত। ভাতা বাড়ানোর টোপে তাঁদের অনেককে দুর্নীতির সাথে যুক্ত করার চেষ্টা হলো। অনেকক্ষেত্রেই সংশাপত্র সই করার এবং ভাতা দেওয়ার সময় তাঁরা স্বাস্থ্য আধিকারিক, অফিস ষ্টাফ ও সুপারভাইজারদের শোষণ, দুর্ব্যবহার ও হয়রানির শিকার হলেন। অনেক আন্দোলন করে পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের সাম্মানিক পৌঁছল ৮২৫০ টাকায়। যা এপ্রিল থেকে ৭৫০ টাকা বেড়ে হবে মাসিক ৯০০০ টাকা। ৪৬ তম লেবার কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক তাঁরা মাসে ন্যূনতম বেতন ২১০০০ টাকা, মাসিক ১০০০০ টাকা পেনশন, কোভিড অতিমারির সময়কার বকেয়া ‘ঝুঁকি ভাতা’ দেওয়া, নিয়মিত ভাবে বেতন দেওয়া, উপযুক্ত কাজের পরিবেশ, সবেতন ছুটির সুযোগ, স্থায়ীকরণ প্রভৃতি দাবি নিয়ে WBAHWU প্রভৃতি সংগঠনের নেতৃত্বে একের পর এক জোরালো আন্দোলন সংগঠিত করছেন।
মানুষ মানুষের জন্যে:
এই বছর-ভর নির্বাচনে কত কত টাকা খরচ হচ্ছে! এই দোল উৎসবে মদের পিছনে, আই পি এল জুয়ায় কিংবা শাহরুখ খান – সালমান খানদের ফাঁপানো সিনেমায় কি বিপুল টাকা খরচ হয়! কেন্দ্র সরকারের এক লহমার নির্দেশে ব্যাংকে গচ্ছিত সাধারণ মানুষের সাড়ে চোদ্দ লক্ষ কোটি টাকা প্রতারকরা গায়েব করে দিল! নোট বন্দী, ভুল কোভিড নীতিতে বহু পরিবার ধ্বংস হয়ে গেলো! রাজ্য সরকার বিরামহীন মেলা, উৎসব, অনুদান, পুজো, ক্লাব ইত্যাদির পিছনে কোটি কোটি টাকা অপচয় করছেন! জনগণের করে নেতা মন্ত্রীদের ঘোরা, ভোগ ইত্যাদি তো আছেই। তার উপর আবার বল্গাহীন দুর্নীতি।
অথচ যে শ্রমজীবী মানুষগুলি যাঁদের একটি বড় অংশ মহিলা, দলিত, পশ্চাদপদ, জনজাতি ও মুসলমান, যাঁরা অত্যন্ত আন্তরিকতা, নিষ্ঠা এবং পরিশ্রম করে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ব্যবস্থাটি ধরে রেখে সমাজকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁরা দু বেলা ঠিকমত খেতে পারেন না। পরনের প্রয়োজনীয় পোশাক নেই, মাথার উপর ছাদ নেই, মা – বাবা – স্বামীর ঠিকমত চিকিৎসা করতে পারেন না, সন্তানদের ঠিকমত পড়াতে পারেন না। এই পাহাড় প্রমাণ আর্থিক বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে তাঁদের কি সম্মানজনকভাবে বাঁচতে দেওয়া যায় না?
মরমী সঙ্গীত শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ড. ভূপেন হাজারিকার কথার প্রতিধ্বনি করি:
“মানুষ মানুষের জন্য,
জীবন জীবনের জন্য।
একটু সহানুভূতি কি
মানুষ পেতে পারে না? …..”
২৭.০৩.২০২৪