এ কাহিনীর মুখ্য চরিত্র অগাস্টো ওডোনে এবং তাঁর স্ত্রী মিকায়েলা। অগাস্টো পেশায় অর্থনীতিবিদ। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। চাকরির সুবাদে ফ্রান্সের কোমোরো দ্বীপে বাস। মিকায়েলা ভাষাবিদ। ছোট্ট লরেঞ্জোকে নিয়ে তাঁদের তিনজনের সংসার। যে সময়ের কথা লিখছি, তখন লরেঞ্জোর সাড়ে তিন বছর বয়স। এই বয়সের স্বভাবসিদ্ধ চাপল্যে, নিত্যদিনের দুরন্তপনায়, আধো আধো কথায় ছোট্ট সংসার ভেসে যাচ্ছে। স্বচ্ছল পরিবার। আর্থিক নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, মোটের ওপর নিরুদ্বেগ জীবন… প্রায় সবকিছুতেই প্রাপ্তির ভাঁড়ার কানায় কানায় পূর্ণ। কে জানতো আর কিছুদিনের মধ্যেই দুশ্চিন্তার মেঘ ধেয়ে আসবে?
সালটা ১৯৮২। হঠাৎই ছোট্ট লরেঞ্জোর মধ্যে অদ্ভুত সব পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল। চার বছরের বাচ্চাটা সারাদিন অনর্গল কথা বলে চারদিক মাতিয়ে রাখতো। হঠাৎ তার কথা জড়াতে শুরু করলো। চটজলদি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হ’ল। লাভ কিছু হ’ল না। ওডোনে দম্পতি গোটা শহর চষে ফেললেন। ততদিনে বহু ডাক্তারের দ্বারস্থ হয়েছেন তাঁরা। কেউ আশার আলো দেখাতে পারছেন না। আরও বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে। লরেঞ্জোর অবস্থার অনেক অবনতি হয়েছে। হাঁটতে গেলে পড়ে যায়। মারাত্মকভাবে শারীরিক অস্থিরতাগুলো বেড়ে গেছে। বাবা-মা পাগলের মতো ছোটাছুটি করছেন। অগুনতি পরীক্ষা নিরীক্ষার পর রোগ ধরা পড়লো- অ্যাড্রিনোলিউকোডিস্ট্রফি, যে রোগের কোনও চিকিৎসা নেই।
রোগটার নাম বড় শক্ত। সহজ করে খানিকটা বলি। যেমন বাড়িতে বিদ্যুতের তারের ওপর একটা আস্তরণ দেওয়া থাকে, তেমনি স্নায়ুগুলোর চারদিকেও একটা মায়েলিনের আস্তরণ থাকে। এ রোগে মায়েলিনের আস্তরণগুলো ক্রমশ ক্ষয়ে যায়। রক্তে লম্বা দৈর্ঘ্যের ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো জমে যেতে শুরু করে। প্রথমে স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপর চোখ, অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি, লিভার ইত্যাদি একে একে প্রায় সর্বাঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। নিজে থেকে খাওয়া-দাওয়া বা পেচ্ছাব পায়খানা করার ক্ষমতাও চলে যায়। যে লরেঞ্জো সারা বাড়িময় চিৎকার করে ঘুরে বেড়াতো, সেই ধীরে ধীরে বিছানায় মিশে যেতে থাকলো। নাকে পরানো নল দিয়ে খাইয়ে দিতে হয়। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন, আয়ু আর বড়জোর কয়েক মাস।
লরেঞ্জোর বাবা অগাস্টো হার মানতে রাজি হলেন না। লাইব্রেরির পর লাইব্রেরি চষে ফেললেন। পাগলের মতো দিনরাত অসংখ্য বই পড়তে থাকেন। সবটাই এই রোগ সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে। কিন্তু বইতে আর কতটুকু পাওয়া যায়? সারা পৃথিবীতে যে সব বিজ্ঞানীরা এই রোগ নিয়ে কাজ করছেন তাঁদের একটা তালিকা তৈরি করে ফেলেন অগাস্টো। তারপর নিজের খরচে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করেন। উদ্দেশ্য একটাই, সেখানে বিজ্ঞানীরা সম্ভাব্য চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবেন। এমন পদ্ধতি যেগুলো এখনো পুরোপুরি প্রথা মেনে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণ হয়নি অথচ প্রাথমিক পরীক্ষায় কিছু সদর্থক আভাস পাওয়া গেছে। অনেক আলোচনার পর খানিক আশার আলো দেখা গেল। ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী উইলিয়াম বি রিজ্জো জানালেন, ওলেইক অ্যাসিড ব্যবহার করে কোষের মধ্যে লম্বা দৈর্ঘ্যের ফ্যাটি অ্যাসিড জমে যাওয়া বন্ধ হ’তে দেখা গেছে। যদিও সেটা পুরোটাই পরীক্ষাগারের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে। মানুষের শরীরে এর প্রয়োগ কখনো হয়নি। ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরতে চায়। এইটুকু তথ্য হাতে নিয়ে আবার রাস্তায় নামেন অগাস্টো ও মিকায়েলা। সম্ভাব্য উপায় তো জানা হ’ল কিন্তু পরীক্ষাগারের রাসায়নিক মানুষের ওপর ব্যবহার করার মতো করে পাওয়া যাবে কীভাবে?
বিভিন্ন জায়গার রসায়নবিদদের কাছে ছুটতে থাকেন তাঁরা। কোথাও সে অমৃতের সন্ধান মেলে না। ওডোনে দম্পতিও হাল ছেড়ে দিতে চান না। প্রায় একশোর বেশি রসায়নবিদের দোরে দোরে ঘোরার পর অবশেষে বৃদ্ধ ব্রিটিশ রসায়নবিদ সে অমৃত বানাতে সম্মত হলেন। অলিভ তেল ও রেপসিড তেলের সংমিশ্রণ অগাস্টোর হাতে তুলে দিলেন।
সবাইকে অবাক করে লম্বা দৈর্ঘ্যের ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ দ্রুত কমতে শুরু করলো। ডাক্তার হুগো মোজার তখন সারা বিশ্বে অ্যাড্রিনোলিউকো-ডিস্ট্রফি নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় মুখ। এই সাফল্য দ্রুত তাঁর নজরে এলো। চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়লো। ইংল্যান্ডের সাত বছরের ব্যারি একই রোগে আক্রান্ত। ব্যারির ওপরেও এই তেল প্রয়োগ করা হ’ল। একই ম্যাজিক! রক্তে লম্বা দৈর্ঘ্যের ফ্যাটি অ্যাসিড কমছে! বছরখানেক বাদে লরেঞ্জোর কিছু কিছু উন্নতি লক্ষ্য করা গেল। চোখের দৃষ্টি এখন সামান্য হলেও অর্থপূর্ণ। পছন্দের গান শুনলে মুখে খুশির ভাব ফুটে ওঠে। যদিও রক্তের রিপোর্ট যতখানি ভালোর দিকে গেছে, স্নায়ুতন্ত্রের উন্নতি মোটেই ততখানি নয়। যতটা উন্মাদনা নিয়ে তেলের ব্যবহার শুরু হয়েছিল কার্যক্ষেত্রে সেরকম সুফল পাওয়া গেল না। তবে? রক্তের রিপোর্টের এতখানি উন্নতি… সেটাকে তো বানের জলে ভেসে যেতে দেওয়া যায় না… আবার খোঁজ, আবার দৌড়। এবারের খোঁজ শুধু হার না মানা বাবার আবেগ দিয়ে সম্ভব নয়। প্রফেশনাল দক্ষতা, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ছাড়া ‘পরশ পাথর’ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
ততদিনে জানা গেছে অ্যাড্রিনোলিউকোডিস্ট্রফি জিনঘটিত রোগ। একই পরিবারে একাধিক মানুষ আক্রান্ত হন। আগে রক্তে লম্বা দৈর্ঘ্যের ফ্যাটি অ্যাসিড জমে যায়। তারপর স্নায়ুতন্ত্রের ওপর কু-প্রভাব পড়ে। ভাবনা আসে- তাহলে যদি স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষয় আসার আগেই রক্তের খারাপ জিনিসগুলো বের করে দেওয়া যায়? সাত বছরের ব্যারির নাম আগেই বলেছি। তার ছোটভাই গ্লেন। এখনও অব্দি বাইরে থেকে দেখলে তার কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। অথচ রক্ত পরীক্ষায় দেখা গেল তার দেহেও লম্বা দৈর্ঘ্যের ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ অনেক বেশি। গ্লেনকেও একই তেল খাওয়ানো শুরু হ’ল। এবং, গ্লেন সুস্থ থাকলো। তারপর আরও বেশ কিছু বাচ্চাকে একই তেল খাওয়ানো হ’ল। বোঝা গেল, রোগবৈশিষ্ট্য প্রকাশের আগেই এই তেল খাওয়ানো শুরু করা গেলে রোগ আটকানো যায়। যদিও রোগ একবার স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে দিলে উন্নতি হয় খুব সামান্যই।
রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রতিটি কানাকড়িও মূল্যবান।অ্যাড্রিনোলিউকো-ডিস্ট্রফি রোগীদের চিকিৎসার কোনও রাস্তাই এতদিন খোলা ছিল না। সামান্য কিছু পরিচর্যা ছাড়া নির্দিষ্ট কোনও ওষুধ ছিল না। তিলে তিলে মৃত্যুই ছিল ভবিতব্য। এখন থেকে একটু করে আলোর দিশা পাওয়া গেল। সামনের রাস্তা এখনও কণ্টকাকীর্ণ। এখনো অনেকদূর পথ হাঁটা বাকি। এ কাহিনীর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে এক হার না মানা বাবা-মায়ের কথা। সন্তানের ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাওয়া তাঁরা সহ্য করতে পারেন নি। কষ্ট আর যন্ত্রণার নিকষ কালো জল মন্থন করে তুলে আনতে চেয়েছেন অমৃত। যে অমৃতের সন্ধান তাঁরা পেয়েছেন তাতে নিজের সন্তানের উন্নতি হয়েছে যৎসামান্য কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য তাঁরা রেখে গেছেন সে অমৃতের উত্তরাধিকার।
চিকিৎসকদের কথামতো লরেঞ্জোর আয়ু ছিল বড়জোর আর কয়েক মাস। সবাইকে ভুল প্রমাণ করে লরেঞ্জো এই পৃথিবীর জল-হাওয়ায় বেঁচে ছিল তিরিশ বছর! বিভিন্ন ধরনের নার্ভ-ক্ষয়ে ভোগা অজস্র শিশু প্রতিদিন অসহায় চোখে কী এক অব্যক্ত সংকেত খুঁজে যায়। কে জানে, এ খোঁজার শেষ কোথায়?
সুখের দিনে ওডোনে পরিবার। তখনও ঝড় আসেনি।
(ছবি ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত)