প্রথমে আসা যাক চিত্রনাট্য কাহিনী সংলাপ নিয়ে। এই ছবিতে পরিচালক অনীক দত্ত মশাই সত্যজিৎ এর গোটা জীবন নিয়ে নয়, পথের পাঁচালী তৈরির সময়টা মূলত ১৯৫০, ৫১, ৫২, ৫৩ এই সালগুলো পুনঃনির্মাণ করেছেন। করতে গিয়ে তাঁকে এক জবরদস্ত রিসার্চ টিমের সাহায্য নিতে হয়েছে সেটা ছবির টাইটেল কার্ড দেখলেই মালুম হবে। বিষয়ের প্রতি দত্ত মশাই তথ্যনিষ্ঠ থাকার চেষ্টায় কতটা পরিশ্রম করেছেন তার প্রমাণ ছবিটার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে। খালি গোটা চারেক খটকা লেগেছে।
খটকা এক। পথের পাঁচালীর ডাক্তার ও চক্কত্তির ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য বোড়াল গ্রামের বাসিন্দা হরিমোহন নাগ ও হরিধন নাগকে একবার দেখেই সত্যজিৎ রায় পছন্দ করে রেখেছিলেন মনে মনে। কিন্তু ছবি তোলার সময় ওদের নাম বলতে না পারায় গ্রামবাসী এরা তাদের হাজির করতে পারছিল না। সত্যজিৎ ওই দুজনের অবয়ব পেন্সিল স্কেচ করে দেখান। ওই দেখে চিনে ফেলে তাদের হাজির করা হয়। এই ঘটনাটা বদলে দত্ত মশাই এর ছবিতে হয়ে গেছে সত্যজিৎ রায় টাক মাথা একজনের খোঁজ করছেন, তার স্কেচ আঁকলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কেন এই বদল সেটা ধরতে পারিনি। আরো ধরতে পারিনি এই প্রসঙ্গে দত্ত মশাই এমনটা দেখালেন কেন যে “টাক চাই টাক চাই” বলে রায় মশাই হইচই করছেন।
খটকা দুই। দত্ত মশাই তার ছবিতে দেখাচ্ছেন যে দুর্গা চরিত্রের মেয়েটি সেজেগুজে হাজিরা দিতে আসলে পরে রায় সাহেব তাকে বাতিল করে দিচ্ছেন, কিন্তু রায় গিন্নি তাকে ঘরের ভেতর ডেকে নিয়ে গাছ কোমর শাড়ি পড়িয়ে টেনে চুল বেঁধে মেকাপ ছাড়া চেহারা রায় সাহেবের সামনে হাজির করলে উনি তক্ষুনি নির্বাচিত করে ফেলেন। অর্থাৎ দত্ত মশাই এর ভাষ্য অনুযায়ী দুর্গা আবিষ্কারের কৃতিত্বটা রায় গিন্নির। প্রকৃত ঘটনা এর উল্টো। রায় গিন্নি নিজেই জানিয়েছেন যে দুর্গা চরিত্রের জন্য উমা দাসগুপ্তকে খুঁজে বের করার কৃতিত্ব লেখক আশীষ বর্মণের। মেয়েটি সেজেগুজেই দেখা করতে আসে। রায় সাহেবের নির্দেশে রায় গিন্নি মেয়েটিকে আটপৌরে চেহারায় হাজির করেন রায় সাহেবের সামনে। আমরা সবাই জানি যে সত্যজিৎ পরিচালক হিসেবে যত বিখ্যাত ততটাই বিখ্যাত কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে। বিভিন্ন চরিত্রের জন্য উপযুক্ত পেশাদার বা অপেশাদার মুখ খুঁজে বের করতে তাঁর জুড়ি ছিল না। কেন দত্ত মশাই বদলে দিলেন ঘটনাটা কে জানে। এটা কি সায়নীর চরিত্রের ওজন বাড়াতে ?
খটকা তিন। অনীক দত্ত মশাই তাঁর ছবিতে সত্যজিৎ সহ প্রায় প্রতিটি চেনাজানা চরিত্রের নাম বদলে দিয়েছেন। বেশ করেছেন। সেটা তাঁর সিনেমাটিক লাইসেন্স। তিনি তো আর তথ্যচিত্র বানাতে বসেন নি। ছবিতে অপুর নাম হয়েছে মানিক আর মানিক অর্থাৎ সত্যজিৎ এর নাম হয়েছে অপরাজিত। এই যাকস্টাপজিশন ভালই লাগে। কিন্তু বেকুব বনে যাই যখন দেখি দত্ত মশাই বাইসাইকেল থিভস-এর নাম বা তার পরিচালক এর নামটা অবধি পাল্টে দিয়েছেন। চিত্রনাট্যের কোন দাবি মেনে এই বদল সেটা বোধগম্য হল না।
খটকা চার। সত্যজিৎ নিজে জিনিয়াস ছিলেন এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই কিন্তু তাঁর যে টিম পথের পাঁচালী বানিয়েছিল তার সদস্যরাও কিছু কম ছিলেন না। দত্ত মশাই তাঁর ছবিতে দেখালেন যে এডিটিং এর সময় রাত জেগে কাজ করতে করতে ক্লান্ত এডিটর একটু ছুটি চাইছে আর সত্যজিৎ তাঁকে মোটিভেট করছেন। বাস্তবে ঘটেছিল তার ঠিক উল্টো। সম্পাদক দুলাল দত্ত জানিয়েছিলেন দিনরাত কাজ করতে হবে ভেবে নিয়ে তিনি ঝোলায় করে সকাল সকাল তেল সাবান মাজন নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। এটা দেখে রায় সাহেব অবাক হয়ে গেছিলেন। উনি ভাবতেও পারেন নি এমন রাত দিন এক করে কাজ হবে। টিমের ক্যাপ্টেন হিসেবে অনেক কৃতিত্বই রায় সাহেবের প্রাপ্য কিন্তু দত্ত মশাই দুলাল বাবুর ওই ডেডিকেশনের কাহিনীটা কেন কেড়ে নিতে চাইলেন কে জানে। এ কি রায় সাহেবকে আরো বেশি করে লার্জার দ্যান লাইফ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ?
এবার আসা যাক ছবিটার সিনেমাটিক ট্রিটমেন্ট নিয়ে। দত্ত মশাই বেশ সরল রৈখিক কালানুক্রমে গল্প বলে গেছেন, বিশেষ ঝুঁকিটুকি নেন নি। সত্যজিৎ এর একটি রেডিও স্বাক্ষাৎকারের সাহায্য নিয়ে উনি ঘটনাগুলোর মালা গেঁথেছেন। এমনিতে ভালই। তবে কিছু কিছু সময় ওই সাক্ষাৎকারটি কিঞ্চিৎ লম্বা মনে হয়েছে, বিশেষ করে মারী সিটনের ভাষ্য পাঠ। আর ইন্টারভ্যালটা কেমন দুম করে এসে যায়, একটা ধাক্কা লাগে (প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে পথের পাঁচালীতে কোনো ইন্টারভ্যাল ছিল না)। ছবির সংলাপ যথাযথ। খালি একটাই কথা বলার, সত্যজিৎ এর মা সুপ্রভা রায় সম্ভবত বাঙাল উপভাষায় কথা বলতেন বাড়িতে যেটা ছবিতে পাওয়া গেল না। আবহ সঙ্গীত নিয়ে অসাধারণ কাজ করেছেন দেবজ্যোতি মিশ্র যেমন অসাধারণ ক্যামেরার কাজ সুপ্রতিম ভোলের।
অভিনেতা অভিনেত্রী নির্বাচনে দত্ত মশাই যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। কেবল বিধান রায়ের চরিত্রে পরান বন্দোপাধ্যায়কে না নিলেই পারতেন। যদিও ছবির অন্যান্য অভিনেতা অভিনেত্রীদের মতই উনিও চুটিয়ে অভিনয় করেছেন।
এই কাস্টিং প্রসঙ্গে জিতু কমলের নির্বাচন একটা আলাদা অনুচ্ছেদ দাবি করে। ছবি দেখিয়েদের প্রায় সকলেই জানেন যে বিদেশি ছবিগুলিতে একজন আলাদা কাস্টিং ডিরেক্টর থাকেন যাঁর কাজ হল বিভিন্ন চরিত্রের জন্য উপযুক্ত অভিনেতা অভিনেত্রী খুঁজে বের করা। সত্যজিৎ নিজের ছবির ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব নিজেই পালন করতেন এবং কতটা সাফল্যের সাথে করতেন সেটা বোঝার জন্য গু-গা-বা-বা তে তপেন ও ফেলুদা সিরিজের সৌমিত্রর নির্বাচনই যথেষ্ট। লুক অবশ্যই ম্যাটার করে। এ নিয়ে সত্যজিৎ স্বয়ং আক্ষেপ করে গেছেন যে ও দেশে সুপারম্যান করার মতো হিরো খুঁজে পাওয়া যায়, যাকে দেখলে মনে হয় কমিকস এর পাতা থেকে উঠে এসেছে আর আমাদের দেশে খুবই মুস্কিল। ক্রিস্টোফার রিভ ছাড়া সুপারম্যান হত না। তেমনই জিতু কমলকে খুঁজে বের করে বেছে নেয়ার জন্য পরিচালক মশাই এর আলাদা একটি সাধুবাদ প্রাপ্য।
সব শেষে যে প্রশ্নটা উঠে আসে সেটা হল বাঙালি দর্শক ছবিটা কি ভাবে নেবেন। যতই বায়োপিক বলে চেঁচামেচি করা হোক, এই ছবিটিকে বায়োপিক বলে ভাবতে রাজি নই। এটা বেসিক্যালি এক মধ্যবিত্ত বাঙালি যুবকের বিশ্ব জয়ের গল্প। যেহেতু গল্পটা বানানো নয়, সত্য কাহিনী অবলম্বনে তাই এর মধ্যে খানিকটা ডকুমেন্টরি ফিল্মের ছোঁয়া আছে। তাবলে এর মধ্যে ফ্ল্যাহার্টির নানুক-এর ন্যারেটিভ স্টাইল খুঁজতে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা।
বাঙালির ছেলে বিজয় সিংহ হেলায় লঙ্কা জয় আমরা এ প্রজন্মের বাঙালিরা দেখে যেতে পারিনি, সত্যজিৎ এর বিশ্বজয়ের সংগ্রাম পূর্ন কাহিনীর আমরা সাক্ষী। এর মধ্যে কোনো মিথ নেই, মিথ বাস্টার নেই। চাইলে বাঙালি পারে এই একটাই থিম নিয়ে এ ছবি বানানো। ধুতি বা পাজামা পাঞ্জাবি শোভিত বাঙালির হাতে একদিন সত্যিই অস্কার উঠেছিল এটা মানতে কারুর কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তাঁর বিশ্বজয়ের উদযাপন আরেকবার করতে আমরা সবাই চাই। কারণ আমরা আমবাঙালি স্বপ্ন দেখতে এখনো ভালোবাসি। পরিচালক সেই স্বপ্ন দেখাটা একটু উস্কে দিলেন এই মাত্র।
সবশেষে নন্দন বিতর্ক। পথের পাঁচালীর সাফল্য নিয়ে অনেকের মধ্যেই একটা ভুল ধারণা আছে যে বিদেশে সাফল্য লাভের পরে বাঙালি ছবিটাকে পাত্তা দেয়। এটা একটা ভুল ধারণা। পথের পাঁচালী মুক্তি পায় ২৬ আগস্ট ১৯৫৫ সালে বসুশ্রী বীণা ছায়া ইত্যাদি প্রেক্ষাগৃহে। আর কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পায় ১৯৫৬ সালে। কলকাতায় মুক্তি পাওয়ার প্রথম তিন চার দিন তেমন ভিড় হয় নি। তার পরে লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে যে সুকুমার রায়ের ছেলে একটা অসাধারন অনবদ্য ছবি বানিয়েছে। হতভম্ব হতবাক বাঙালির ভিড় উপচে পরে প্রেক্ষাগৃহগুলিতে। ছবিটা সুপার হিট। বিস্ময় আর মুগ্ধতার কাহিনী। এর পরে খবরের কাগজগুলি চুটিয়ে প্রশংসা করে। আগে থেকে করা চুক্তির জন্য বসুশ্রী থেকে পথের পাঁচালী যখন তুলে নেয়া হল ছয় সপ্তাহের মাথায় তখনও ভিড় একটুও কমে নি। অনীক দত্ত এর এই দুর্দান্ত ছবিটি নন্দনে জায়গা পায় নি তো কি। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ুক এই ছবির কথা। দর্শকরা ভিড় করুন বিভিন্ন প্রেক্ষগৃহে। অপরাজিত আজও অপরাজিত এটাই প্রমাণিত হোক।