মানুষকে দেখে বোঝা দায় তার ভিতরে কী আছে। একেকজন আছে- বেশ ঝকঝকে চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত কথা বার্তা। অথচ ভালো করে চেনাশোনা হওয়ার পর বোঝা গেল, তার ভেতরের মনটা মোটেও সুবিধাজনক নয়। ষড়রিপু দখল করে রেখেছে সেটা। অন্যদিকে শান্তশিষ্ট সাধারণ চেহারার মানুষটিকে প্রথমে পাত্তা দেওয়ার মতো না মনে হলেও আস্তে আস্তে বোঝা যায় ষন্নিগ্রহী মানুষটির গুণের শেষ নেই। অতলান্ত ভালোবাসার জালে সে যখন জড়িয়ে ফেলে, সেই জাল কেটে সহজে বের হওয়া যায় না। বেরনোর ইচ্ছেও করে না।
মানুষ নিয়েই কারবার আমার। সারাদিন মানুষই দেখি। এবং রোজই আশ্চর্য হই। সেরকমই একের পর এক রোগী নয়, মানুষই দেখছিলাম বাড়ির খুপরিতে। খুপরির শেষদিকটা বড্ড দীর্ঘ হয়ে যায়। বারবার পার্থকে জিজ্ঞেস করি, ‘আর কতো জন?’ পার্থ প্রতিবারই একই জবাব দেয়, ‘এই তো ডাক্তারবাবু, প্রায় হয়ে এসেছে।’
তারপর দরজা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে বলে, ‘বাইরে টোটোয় একজন পেশেন্ট রয়েছে। দুই পা প্যারালাইসিস। হাঁটতে পারেন না। একটু দেখে আসতে হবে।’
রাস্তায় নেমে দেখি এখনও বেশ ভিড়। রেগে পার্থকে বললাম, ‘এই তোমার প্রায় হয়ে আসা?’
পার্থ বলল, ‘আসলে রোগী দেখার সময় আপনার মনোবল ভাঙতে চাই না।’
টোটোর কাছে গিয়ে দেখি দুজন বসে আছেন। এক বৃদ্ধ আর এক বৃদ্ধা। দুজনেরই বয়সই আশির কাছাকাছি। তাঁদের দেখে আমার মনোবল আরও ভেঙে গেল। চেহারা দেখে যা বোঝা যাচ্ছে দুজনের শরীরেই অসংখ্য রোগ।
ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হার্টের অসুখ- এগুলো তো শিওর আছে, কাগজ পত্র ঘাঁটলে আর কী বেরোবে ভগবান জানে?
বৃদ্ধর তিন চারদিন ধরে জ্বর আর কাশি। একেবারেই ঝিমিয়ে গেছেন। বুকে স্টেথো বসালাম। দিব্যি সপ্তসুর শোনা যাচ্ছে। বললাম, ‘এনার অবস্থা তো সুবিধার নয়। কবে থেকে এমন ঝিমচ্ছেন?’
বৃদ্ধা বললেন, ‘নাড়ু এমনিতেই ঝিমিয়ে থাকে। ওর মাথায় ডিফেক্ট আছে। অনেকগুলো নার্ভের ওষুধ খায় তো। এই দেখুন ওর সব পুরনো প্রেসক্রিপশন।’ বলেই তিনি আমার হাতে এক-তাড়া কাগজ গুঁজে দিলেন।
বাহ… বৃদ্ধার বয়স হলে কি হবে, বেশ আধুনিক। নিজের স্বামীকে নাড়ু বলে ডাকছেন। একগাদা পুরনো প্রেসক্রিপশন আর নানা রকম রিপোর্টের তাড়া নিয়ে কাকে ধরানো যায় ভাবছি, হঠাত পেছন থেকে একজন বলল, ‘ডাক্তারবাবু, কুলপি খাবেন?’
এই কুলপি-ওয়ালা আমাদের রান্নার দিদির কীরকম একটা ভাই হয়। রোজ চেম্বারের শেষে এর কাছে আমরা গোটা চারেক করে কুলপি খাই। আমি রেগে মেগে বললাম, ‘এটা কি কুলপি খাওয়ার সময়… অ্যাঁ… তোমার একটা বিচার বিবেচনা নেই? এই নাও ধরো।’ কুলপি-ওয়ালার হাতেই সব কাগজপত্র ধরিয়ে বৃদ্ধাকে বললাম, ‘কী হয়েছে এবার ভালো করে বলেন।’
বৃদ্ধা বললেন, ‘আপনি কুলপি খেয়ে নিতে পারেন। আপনার যা মেজাজ গরম হয়ে রয়েছে কথা বলতেই ভয় লাগছে।’
পেছন থেকে একজন রোগী জামা ধরে টানলেন, ‘ডাক্তারবাবু, ইসিজিটা একটু দেখে দিন না। দোকান খুলে এসেছি।’
অনেক কষ্টে রাগ চেপে বললাম, ‘আপনি দয়া করে দোকান বন্ধ করে আসুন।’
বৃদ্ধা মহিলা বললেন, ‘আপনি নাড়ুকে দেখে নেন। আমি হাঁটতে পারি। চলুন আমি ভেতরেই যাচ্ছি।’
খুপরিতে ঢুকে আগের প্রেসক্রিপশন দেখে বললাম, ‘আপনার স্বামীর তো অনেক রোগ।’
বৃদ্ধা বললেন, ‘কে আমার স্বামী?’
‘ওই যে যাকে নাড়ু বলে ডাকলেন…’
বৃদ্ধা হাসি মুখে বললেন, ‘যা… আপনি কী যে বলেন ডাক্তারবাবু। নাড়ু তো আমার ভাই। আমার বর কবেই তো স্বর্গে চলে গেছেন।’
‘ও সরি, আমি বুঝতে পারিনি। আসলে ওনাকে দেখে আপনার চেয়ে অনেক বয়স্ক মনে হয়। ওনার পায়ের জোর চলে গেছে কবে থেকে।’
‘একাত্তর সালে।’
‘সেকি, এত আগে? এখন ওনার বয়স ৭৪। তাহলে তো তখন ওনার বয়স ছিল ২১। এতো কম বয়সে কী হয়েছিল? কোনো দুর্ঘটনা?’
বৃদ্ধা বললেন, ‘দুর্ঘটনাই বটে। পুলিশের মার খেয়ে ওর নিম্নাঙ্গ অসাড় হয়ে গেছিল। যুক্তফ্রন্টের বন্দী-মুক্তির সময় জেল থেকে ছাড়া পায় বটে, কিন্তু ততদিনে পুলিশের অত্যাচারে শুধু শারীরিক নয়, নানা রকম মানসিক সমস্যাও শুরু হয়েছে।’
আমি বললাম, ‘দুঃখিত, আমি বুঝতে পারিনি।’
বৃদ্ধা বললেন, ‘তুমি দুঃখিত পরে হয়ো। আগে টপাটপ ওষুধ লিখে দাও, যাতে দু-তিন দিনেই নাড়ু সুস্থ হয়ে যায়। আর আমাকে একটু ঘুমের ওষুধ লিখে দাও। না হলে নাড়ুর চিন্তায় আমার রাত্রে ঘুম হয় না।’
আমি বললাম, ‘বাড়িতে আর কেউ নেই?’
‘আর কে থাকবে? শারীরিক আর মানসিক ভাবে পঙ্গু মানুষের কেউ থাকে? মা বাবা ছাড়া? তা তারাও স্বর্গে গেছেন অনেক দিন।’
‘আর আপনি… আপনার তো নিজের লোকজন আছে?’
‘হ্যাঁ, তা আছে। দুই ছেলে আছে। দুজনেই পড়াশুনোয় ভালো। দুজনেই বর্ধমানে বাড়ির কাছাকাছিই চাকরি করে।’
‘তাহলে…?’
‘কী তাহলে? কেন আমি ছেলেদের ছেড়ে নাড়ুর কাছে পরে আছি? তুমি যা ভাবছো তা নয়। আমার ছেলেরা যথেষ্ট ভালো। আমাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে।’
আমি চুপ করে রয়েছি দেখে উনি বললেন, ‘আমি নাড়ুর কাছে দিদি নই, ওর মা। আর মা কাকে সবচেয়ে বেশি আগলে রাখে জানো? তাঁর সবচেয়ে দুর্বল সন্তানকে। নাড়ু পড়াশুনোয় ভালো ছিল। অংকে অনার্স করতে করতে পড়া ছেড়ে নকশাল রাজনীতিতে ঢুকে গেল। সেসময় টানা আটমাস ওর কোনো খবর পাই নি। পুলিশ এসে নিয়মিত বাড়িতে ঝামেলা করত। শেষে একদিন ওকে না পেয়ে আমাকেই তুলে নিয়ে গেল। নাড়ু কোথা থেকে খবর পেয়েছিলো জানি না, সেদিনই আমাকে বাঁচানোর জন্য ও আত্মসমর্পণ করে। খুন হতে পারে জেনেও ইতস্তত করেনি। যে আমায় এতটা ভালোবাসে তাকে আমি কী করে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেব?’
‘আপনার বাড়িতে সমস্যা হয়নি?’
‘যতদিন হাজব্যান্ড ছিলেন, আমার নিজেরই একটু ইতস্তত লাগত। বাপের বাড়ি- শ্বশুর বাড়ি করতাম। তবে উনি বড়ো ভালো মানুষ ছিলেন। বারবার বলতেন, নাড়ুর তোমাকে আমার চেয়ে বেশি প্রয়োজন। তখন ভাইকে মাঝে মাঝেই বর্ধমানে নিয়ে গিয়ে রাখতাম। ছেলেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পর পরই উনি হঠাত চলে গেলেন। তারপর থেকে এখানে বাপের বাড়িতেই থাকি। দিদি- ভাই মিলে দিব্যি আছি।’
বৃদ্ধা চলে যাওয়ার পর কেমন আচ্ছন্ন লাগছিল। একজন মেধাবী ছেলে নকশাল রাজনীতিতে জড়িয়ে নিজের জীবনটাকে পুরোপুরি নষ্ট করেছেন। তার জন্য তাঁকে করুণাই করা উচিৎ। কিন্তু করুণার বদলে হতভাগ্য মানুষটিকে আমার হিংসাই হচ্ছে। সারাজীবন মানুষটি দিদির যে ভালোবাসা পেয়েছে, সেই আশ্চর্য ভালোবাসা কয় জনের ভাগ্যে জোটে?