পদ্মার ঢেউরে:- ৩০ জুলাই’২৪ সংবাদপত্রের ভিতরের পাতায় দেখা গেল মুর্শিদাবাদ জেলার সামসেরগঞ্জের শিবপুর গ্রামে একরাতে গঙ্গার ভাঙ্গনে ২৫ টি বসতবাড়ি নদীগর্ভে, আশপাশের ৪৮ টি বাড়ির বাসিন্দারা ঘরছাড়া। দশকের পর দশক এইভাবেই চলে আসছে মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলার নদীপাড় সংলগ্ন অঞ্চলগুলিতে। ‘স্বাস্থ্য শিক্ষা উন্নয়ন’ পত্রিকার অক্টোবর’২১ সংখ্যায় এক গবেষণামূলক প্রবন্ধে শ্রী সুনীতি কুমার বিশ্বাস (কোভিডে চলে গেলেন) ও শ্রী তপন কুমার সামন্ত যে বিস্তৃত পরিসংখ্যান দেন তা যোগ করলে দাঁড়ায় ১৯৩১ – ২০১১ অবধি গঙ্গা – পদ্মার ভাঙ্গনে মুর্শিদাবাদে বিলীন হয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ৩৯,৫৩৯ হেক্টর, বছরে গড়ে ৪৮৮.১৩ হেক্টর। ওই পত্রিকার জুলাই’১২ সংখ্যায় মালদার নদীভাঙ্গন উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ করা শ্রী শুভম ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন গঙ্গার উজানে ভাঙ্গনের ফলে মালদা জেলার ৬৪ টি মৌজার ২০০ বর্গ কিমি. বিস্তৃত জমি বিলীন হয়ে গেছে।
মালদায় কর্মসূত্রে প্রতিবেদক রোদ – বৃষ্টি, ক্ষুধা – অভাব, মশা – মাছি – পথ কুকুরদের সাথে সহবস্থান করে কোনরকমে রেলওয়ের প্ল্যাটফর্মে আশ্রয় নেওয়া চরম দুর্দশাগ্রস্ত ভাঙ্গন উদ্বাস্তুদের পরিবারগুলিকে প্রত্যক্ষ করেছে। গঙ্গার উত্তর পাড়ে কালিয়াচক২ এর পঞ্চানন্দপুর ছিল একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ও কর্মব্যস্ত বন্দর, অথচ মানিকচক – মালদা টাউন কক্ষপথে এটির এখন অস্তিত্ব নেই। এর পশ্চিমে ভূতনি প্রমুখ যে দিয়ারা বা চরগুলির সৃষ্টি হয়েছিল সেখানেও গঙ্গার প্লাবন ও ভাঙ্গনে চরবাসীদের অনেকেই গৃহহারা। তাদের মধ্যে যারা কোনরকমে কষ্ট করে টিকে গেলেন ঝাড়খণ্ডের দুর্বৃত্তদের আক্রমণে দিশেহারা। অনুরূপভাবে গঙ্গার দক্ষিণে মুর্শিদাবাদ জেলায় কর্মসূত্রে ভগবানগোলা২ এর আখেরিগঞ্জ এবং ফারাক্কার বেনিয়াগ্রামে দেখেছি পদ্মা ও গঙ্গার তাণ্ডবে ব্যাপক ভাঙ্গনের ধ্বংস চিত্র। এখানেও নির্মল চর সহ যে সমস্ত চর জেগেছে সেগুলি যেমন অগম্য আবার সেগুলিতে বাংলাদেশী নাগরিকদের আধিপত্য।
ও যে – জন ভাঙ্গল কূল, ভাঙ্গল বাসা রে:- গত শীতেই কর্মসূত্রে গিয়েছিলাম মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলায়। গঙ্গার ভাঙ্গন ছাড়াও কালিয়াচক১, ইংরেজবাজার, ওল্ড মালদা, গাজল, রতুয়া২ ব্লকগুলি ঘুরে মহানন্দা, কালিন্দ্রী, পাগলা, বেহুলা নদীগুলির করুণ অবস্থা প্রত্যক্ষ করলাম। কোথাও কোথাও নদীগুলি এতটাই বুজে গেছে যে নালা মনে হবে, স্রোতহীন কচুরিপানায় ভরা। নদীদের স্তব্ধ করে অসংখ্য কালভারট, ব্রিজ, অবৈধ নির্মাণ, ভেড়ি, ইটভাটা। মালদার প্রধান নদী মহানন্দা প্রবলভাবে দূষিত। তার উপর যত্রতত্র বাঁশের সাঁকো নির্মাণ করে তাতে কাঠের তক্তা ফেলে পয়সা নিয়ে বাইক, ছোট গাড়ি, ছোট লরি পারাপার করা চলছে।
মুর্শিদাবাদে গিয়ে দেখলাম গত শতাব্দীর ৯০ এর দশক থেকে ভাঙ্গন বাড়িয়ে চলা জলঙ্গী নদী রানিনগর, ডোমকল, হরিহরপাড়া প্রভৃতি জায়গায় খালের আকৃতি হয়ে গেছে। লালগোলা ব্লক থেকে জলঙ্গী ব্লক পর্যন্ত পদ্মার বুকে চরের পর চর। ধুলিয়ানের কাছে গঙ্গারও একই অবস্থা। নিমতিতায় ভাগীরথীর উৎস মুখ শুকিয়ে বুজে গেছে। ফারাক্কা ব্যারেজের ফিডার ক্যানাল দিয়ে যৎসামান্য জল এনে আহিরনের কাছে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা।
ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে:- নানাভাবে কথিত হলেও উপমহাদেশের এই প্রধান নদী উত্তরাখণ্ডের দেবপ্রয়াগ থেকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে পদ্মা ও ভাগীরথী রূপে বিভাজন পর্যন্ত গঙ্গা এবং হাওড়া জেলার গড়চুমুকে ভাগীরথীর সাথে দামোদরের মিলনের পর থেকে হুগলী নামে পরিচিত। তারপর এটি সাগর দ্বীপের কাছে দুটি ধারায় (পশ্চিমে মূল ধারা এবং পুবে বড়তলা বা মুড়িগঙ্গা নামে) বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ডিভিশনের চাঁদপুর জেলায় পদ্মায় মেঘনা নদীর মিলনের পর বিশাল ধারাটি মেঘনা নামে প্রবাহিত হয়ে বরিশাল ডিভিশনের ভোলা জেলায় তেঁতুলিয়া (ইলশা), শাহবাজপুর, হাতিয়া ও বামনি চারটি ধারায় বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।
এবার আসা যাক গঙ্গা – পদ্মা – ভাগীরথী – জলঙ্গীর যে ভয়াবহ ভাঙ্গন, যা কিনা একের পর এক জনপদ এবং বিস্তীর্ণ উর্বর কৃষিক্ষেতকে ধ্বংস করে চলেছে, তার কারণ কি? এর উত্তরে দুই জেলার মানুষ এবং বহু বিশেষজ্ঞ এক কথায় বলে দেন ফারাক্কা ব্যারেজ। অবশ্যই ফারাক্কা ব্যারেজ অন্যতম কারণ। এছাড়াও রয়েছে আরও অনেক কারণ। সেগুলির সন্ধানে আমরা এবার ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে যাত্রা করি। “নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?” – তাঁর ফলতার চমৎকার বাগানবাড়ির পাশ থেকে বয়ে চলা রূপবতী বিশালাকৃতি নদীকে দেখে বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র লিখেছিলেন সেই আশ্চর্য সুন্দর লেখাটি – ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’। রূপকার্থে তাঁর বর্ণিত মহাদেবের জটা অর্থাৎ হিমালয় পর্বতের সুউচ্চ শৃঙ্গগুলিতে অবস্থিত বিস্তৃত হিমবাহগুলি থেকে সৃষ্টি উপমহাদেশের যাবতীয় নদনদীর।
নির্দিষ্টভাবে উত্তরাখণ্ডের গঙ্গোত্রী ও খাটিলাং হিমবাহের গোড়ায় অবস্থিত গোমুখ (৩৮৯৮ মিঃ) থেকে ভারতভূমিকে সিঞ্চিত করা এই বারিধারার সৃষ্টি। তারপর ভাগীরথী নামক এই স্রোতস্বিনী পাহাড়ি তটিনী মন্দাকিনী, অলকানন্দা, ধউলিগঙ্গা, পিন্ডার, কেদারগঙ্গা, অসিগঙ্গা, বিলগ্না প্রমুখ বহু ধারার সাথে বিভিন্ন প্রয়াগে মিলিত হয়ে গঙ্গা রূপে হৃষীকেশ অঞ্চলে প্রতিভাত এবং হরিদ্বারের নিকট তার সমতলে প্রবেশ। তারপর রামগঙ্গা, গোমতী, ঘর্ঘরা, গণ্ডক, যমুনা, শোন, কোশী, মহানন্দা, যমুনা (ব্রহ্মপুত্র), মেঘনা প্রমুখ অসংখ্য বড় ছোট উপনদ উপনদীর জলধারায় পুষ্ট হয়ে ২৫২৫ কিমি. দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পদ্মা এবং ভাগীরথী (হুগলী) দুটি প্রধান ধারায় সাগরসঙ্গমে উপনীত।
কোন কালসাপে দংশিলো তোর সুজন নাইয়া রে:- গঙ্গার উৎসস্থলেই জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যে তেহরি, কারমোলি, হরশীল, ভাইরংঘাটি, লোহারিনাগ পালা, পালা পানেরি, কোটেশ্বর, কোলিবেল ১ ও ২ সহ ১৭ টি স্থানে মা গঙ্গাকে বাঁধের বেড়ি পরিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি ব্যাপকভাবে অরণ্য নিধন, পরিবেশ দূষণ, পাহাড় ফাটিয়ে সড়ক সুড়ঙ্গ হেলিপ্যাড নির্মাণ, অবৈধ হোটেল ও গৃহ নির্মাণ, বাণিজ্যিক ধর্ম পর্যটন ইত্যাদির অত্যাচারে ভঙ্গুর জায়মান হিমালয় পর্বত এবং তাঁর মুল্যবান বাস্তুতন্ত্র যেমন উপর্যুপরি বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তেমনি ভারতীয় সভ্যতার অন্যতম সৃষ্টিকারী গঙ্গা মাইয়া এবং তাঁর সহোদরারাও বিপর্যস্ত। হাজার হাজার বছর ধরে মানব সভ্যতাকে ধারণ করা এই প্রকৃতি, পাহাড়, নদনদী, অরণ্য, বাস্তুতন্ত্রকে আগ্রাসী মুনাফাকেন্দ্রিক বৃহৎ পুঁজি এবং তার দালাল – ঠিকাদার – ব্যাবসায়ী – মাফিয়াদের হাত থেকে রক্ষার জন্য করণ সিং, চণ্ডীপ্রসাদ ভাট, গাওরা দেবী, সুদেশা দেবী, বাচনি দেবী, সুন্দরলাল বহুগুনা, গোবিন্দ সিং রাওয়াত, ধুম সিং নেগি, সামসের সিং বিস্ত, ঘনশ্যাম রাতুরি প্রমুখের নেতৃত্বে ভূমিপুত্ররা ‘চিপকো’ সহ একের পর এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সেরকমই ‘কলুষিত অশ্রুনদী’ গঙ্গাকে বাঁচাতে তাঁকে আষ্টেপৃষ্টে পেঁচিয়ে ধরা বাঁধগুলি মুক্ত করতে স্বামী জ্ঞানস্বরুপ সানন্দ (পরিবেশবিদ ও ইঞ্জিনিয়ার জি ডি আগরওয়াল) সহ একের পর এক সান্ন্যাসী অনশন করে বা গঙ্গায় স্বেচ্ছা জলসমাধি বরণ করে প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য কেন্দ্র এবং কোন রাজ্য সরকারই কোন কর্ণপাত করেনি। বিপর্যয় ঘটেই চলেছে, মা গঙ্গা হয়েছেন আরও বাধাপ্রাপ্ত ও কলুষিত। প্রতিবেদক নিজেও স্বচক্ষে দেখে এসেছে তেহরি বাঁধ ও জলাধারে আশপাশের সমস্ত গ্রাম, বনভূমি ও উপত্যকার ডুবে যাওয়া।
এরপর হৃষীকেশ থেকে ক্যাম্প, ওয়াটার স্পোর্টস, রিসোর্ট, পর্যটন ইত্যাদির নামে গঙ্গাকে ধ্বংস করার উদ্যোগ। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত গঙ্গা হরিদ্বারে পৌঁছলে বাণিজ্যিক ধর্মীয় পর্যটনের উদ্দেশে ব্যারেজ নির্মাণ করে তাঁর মূল প্রবাহকে আটকে খাল কেটে পবিত্র গঙ্গা মাইয়া আখ্যা দিয়ে ধর্মীয় শহরের মধ্যে দিয়ে জল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উত্তরাখণ্ডে পউরি, হরিদ্বার সহ বিভিন্ন স্থানে গঙ্গার বুকে ছোট বড় এক গুচ্ছ সেতু নির্মাণের পর উত্তরপ্রদেশে ৩৩ টি, বিহারে চারটি, পশ্চিমবঙ্গে ১৩টি এবং বাংলাদেশে তিনটি বৃহৎ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গঙ্গা – পদ্মা – ভাগীরথীর উপর। আরও কয়েকটি নির্মাণের পরিকল্পনা। এর উপর উত্তরপ্রদেশের বিজনৌর ও নারোরাতে দুটি ব্যারেজ করে প্রচুর খাল কেটে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষিক্ষেতগুলিতে সেচের জল সরবরাহের ব্যাবস্থা করা হয়েছে। পূর্ব উত্তরপ্রদেশের গঙ্গা – যমুনার দোয়াব অঞ্চলে মুঘল ও ব্রিটিশ আমল থেকেই গঙ্গার সেচ খালগুলি গড়ে উঠেছিল। এছাড়াও মধ্য উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারে প্রচুর খাল কেটে গঙ্গার জল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর গঙ্গার এই দীর্ঘ যাত্রায় দুই তীরের যাবতীয় প্রাকৃতিক, মনুষ্যকৃত, কৃষিজ ও শিল্প বর্জ্য সরাসরি গঙ্গায় ঢেলে দেওয়া হয়েছে। ফলে গঙ্গা যখন পশ্চিমবঙ্গে এসে উপস্থিত হয়েছে তখন তাঁর কোল শূন্য অর্থাৎ জল কম, পলি বেশি, দূষণ প্রচুর। এবার সেইটুকু জল নিয়ে দুই বাংলার ও দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব, তিক্ততা এবং জলচুক্তির নামে রাজনৈতিক খেলা। এরপর ফারাক্কা ব্যারেজ তো আছেই। কিন্তু তার আগেই ফারাক্কার উজানে বর্ষার সময় ছাড়া জলের জোগান এতই কম যে সেটাই ভাগীরথী নদী ও কলকাতা বন্দরকে মৃতপ্রায় করে তোলার (কপিল ভট্টাচার্যের মতে দামোদর ও রূপনারায়ণ নদে বাঁধ দেওয়াও)এবং পদ্মা ও তাঁর শাখা নদীগুলির জলহীনতার প্রকৃত কারণ। ফারাক্কার ফিডার ক্যানেলেরই জলপ্রবাহ এত কম যে ফারাক্কার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে বসিয়ে দিতে হয়েছে।
কে বলেরে কীর্তিনাশা কূলভাঙ্গা তোরে:- তরঙ্গায়িত সজীব নদী ভূ-প্রাকৃতিক নিয়মেই তার গতিপথ পরিবর্তন করে এবং একেবেকে যাত্রাপথে ও বাঁকগুলিতে দুই পাড়ে কিছু ভাঙ্গন সৃষ্টি করে। খুব বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া এই পরিবর্তনগুলি সাধারণত শ্লথ গতিতে হয় এবং নদীতীরের বাসিন্দারা মানিয়েও নেন। ভাঙ্গনের পরিপূরক হিসাবে পাওয়া যায় নতুন জাগা উর্বরতম চর। কিছুকিছু ক্ষেত্রে হয়তো নদীর গতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে এবং প্রকৃতির সাথে ভারসাম্য রেখে কিছু ব্যাবস্থা নিতে হয় এবং আধুনিক যোগাযোগ ব্যাবস্থার জন্যে নদীর বুকে পিলারহীন (কলকাতার রবীন্দ্র ও বিদ্যাসাগর সেতু) বা ন্যুনতম স্তম্ভের সেতু বানাতে হয়। কিন্তু লোভী ও অবিমৃশ্যকারী মানুষ যখন প্রকৃতির সন্তান নদীকেই সম্পূর্ণ বেঁধে ফেলে তার জলটুকু নিংড়ে নিতে চায় আশু লাভ ও মুনাফার জন্য তখন হাজার হাজার বছরের নদীমাতৃক ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, জলধারা, কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প, সভ্যতা, সংস্কৃতির দ্রুত পতন ঘটে।
গত শতাব্দীর ৪০ এর দশকের মাঝামাঝি স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ কৌশলে আন্দোলনের ভরকেন্দ্র চলে গেল হিন্দুস্তান – পাকিস্তান আকচা আকচিতে এবং তাকে কার্যকর করতে সুকৌশলে লাগিয়ে দেওয়া হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিশেষত বাংলা প্রদেশে। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে, ভারত ছোড়ো, আজাদ হিন্দ প্রভৃতি আন্দোলনের প্রশমনের সুযোগে ব্রিটিশ মধ্যস্থতায় নেহরু – বিড়লা এবং জিন্না – ইস্পাহানি রা ভারত – পাকিস্তান ভাগাভাগি করে ফেলেছেন লক্ষ লক্ষ দরিদ্র কৃষি ও শ্রমজীবী সাধারণ বাঙালি আর পাঞ্জাবিদের রক্তপাত, মৃত্যু, পরিবার হারানো, ভিটে হারানো, জন্মভূমি হারানো, নারীদের ইজ্জত হারানোর বীভৎস সব ঘটনাবলীর বুকের উপর দিয়ে। পূর্ববঙ্গের বর্ণহিন্দু জমিদার, ব্যাবসায়ী, পেশাজীবী, চাকরিজীবীরা ততদিনে উপস্থিত হয়েছেন নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা ও তার আশপাশের শহরতলিতে। কলকাতাকে ঘিরে ব্রিটিশ লালিত শিল্প ও বাণিজ্য কে ধরে নতুন করে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা। সেটি অনেকটাই কলকাতা বন্দর নির্ভর। কিন্তু কিছুটা প্রাকৃতিক এবং বেশিটা মানুষের কার্যকলাপের কারণে জলের অভাবে কলকাতা বন্দর যে ঝিমিয়ে পড়েছে। তাই কলকাতা বন্দর ও মহানগরীকে বাঁচাতে দুটি পদক্ষেপ নেওয়া হলঃ (১) পদ্মা – ভাগীরথীর উৎসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে মুর্শিদাবাদকে ভারতে রাখা হল এবং করিমগঞ্জ ছাড়া বাদবাকি শ্রীহট্ট কে পাকিস্তানে দেওয়া হল। (২) প্রয়োজনীয় জল জুগিয়ে ভাগীরথী ও কলকাতা বন্দরকে বাঁচাতে এবং একইসঙ্গে উত্তরবঙ্গ ও উত্তরপূর্বাঞ্চলের সাথে রেল ও সড়ক যোগাযোগ সুগম করতে (এতদিন নৌপথে এবং পাবনার ঈশ্বরদি এবং কুষ্টিয়ার ভেরামারার মধ্যে পাকশি তে অবস্থিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে যোগাযোগ হত) গঙ্গার উপর একটি ব্যারেজ নির্মাণ।
সেই সময় স্বাধীন ভারতের সর্বোচ্চ নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর কাছে বড় বাঁধগুলি হয়ে উঠেছিল দেবালয়। পাশ্চাত্যের নামী নদী বিশেষজ্ঞ ডব্লিউ. হেনসেন সমীক্ষা চালিয়ে ১৯৫৭ তে ফারাক্কায় ব্যারেজ নির্মাণের সুপারিশ করলেন। আবার এর ভবিষ্যৎ কুফলের কথা বলে বিরোধিতা করায় তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ার, বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ এবং দেশে মানবাধিকার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ কপিল ভট্টাচার্য কে পাকিস্তানের চর বলে দাগিয়ে দেওয়া হল। ১৫৬ কোটি টাকা ব্যায়ে ১৯৬২ – ’৭০ জুড়ে ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ চলল। চালু হল ১৯৭৫ থেকে। এর উজান থেকে ৩৮ কিমি. একটি ফিডার ক্যানেল কেটে ভাগীরথীতে যুক্ত করা হল। এর মাধ্যমে শুখা মরশুমে কলকাতা বন্দরকে বাঁচানোর জন্য যাতে অন্তত ৪০ হাজার কিউসেক জল পায়।
কিন্তু গঙ্গায় পর্যাপ্ত জলই নেই তো ভাগীরথীকে এই জল দেবে কোথা থেকে? আজ অবধি একদিনের জন্যেও ওই ন্যুনতম জল দেওয়া সম্ভব হয়নি। কলকাতা বন্দর মৃত্যু শয্যায়, তার কর্মকাণ্ডের অনেকটাই নিয়ে যাওয়া হয়েছে আরও দক্ষিণে হুগলী ও হলদী নদীর মোহনায় হলদিয়া বন্দরে ১৯৭৭ থেকে আর কলকাতা বন্দরের স্থান দখল করে নিয়েছে ওড়িশার পারাদ্বীপ ও অন্ধ্রের ভাইজাগ দুই সমুদ্র বন্দর। মাঝখান থেকে ব্যারেজের কারণে বাংলাদেশের দিকে জলপ্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের সাথে শুরু হয়েছে বিবাদ। সবচাইতে মারাত্মক যেটা ক্ষতি হয়েছে ব্যারেজের কারণে জলের স্বাভাবিক স্রোত স্তব্ধ হওয়ায় গঙ্গা দিয়ে বহমান বার্ষিক ৭০ টন পলির ৩০ টন ই ফারাক্কার উজানে গঙ্গায় জমে নদীখাত বুজিয়ে দিয়ে শুধু চরের সৃষ্টিই করেনি অগভীর নদীখাতে উপর্যুপরি পলি জমে মালদা জেলা ও সংলগ্ন বিহারের কাটিহারের আমদাবাদ, মনিহারি এলাকাগুলিতে এক ভয়ঙ্কর ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও বিপর্যয় ডেকে এনেছে। প্রলয়ঙ্কর বন্যা ও ভাঙ্গন। এর প্রশমনের জন্য না করা হয়েছে ড্রেজিং, না করা হয়েছে ব্যারেজের ১১২ টি স্লুইস গেটের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতি, না অন্য কোন ব্যাবস্থা। আবার বর্ষায় যখন উজানে জল ধরে রাখা যায় না তখন ছেড়ে দেওয়ায় শুখা মরশুমে জল না পেয়ে চর পরা নামনি গঙ্গা এবং পদ্মাকে ভাসিয়ে দিয়ে তারপর ভয়ানক ভাঙ্গন ঘটিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলাকে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়।
অতঃ ফারাক্কা কথা:- ফারাক্কার উজানে গঙ্গার দক্ষিণ পাড় ঝাড়খণ্ডের রাজমহল পাহাড়ের কঠিন শিলা দ্বারা গঠিত। ফলে অগভীর গঙ্গার গিরিখাতে বর্ষার প্লাবন এসে ফারাক্কা ব্যারেজে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উত্তরের মালদা জেলার মানিকচক – ইংরেজবাজার – কালিয়াচক কক্ষপথে ব্যাপক প্লাবন ও ভাঙ্গনের সৃষ্টি করে গ্রাম, শহর, উর্বর চাষের জমিকে গ্রাস করতে শুরু করল। ক্রমশ এই ভয়াল ভাঙ্গন চলতে চলতে গঙ্গার সাথে ফুলহার, কালিন্দ্রী, মহানন্দা নদীগুলির দূরত্ব কমিয়ে আনল। এরকম চলতে থাকলে আগামীদিনে গঙ্গার সাথে এই নদীখাতগুলি মিশে দক্ষিণ মালদার বিস্তীর্ণ অঞ্চল অবলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, গঙ্গাও বইতে পারে ফারাক্কা ব্যারেজকে ছাপিয়ে আরও উত্তর দিক দিয়ে। গঙ্গার উত্তর পাড়ের ভাঙ্গনের ফলে দক্ষিণ পাড়ের দিকে যে চরগুলি জেগে উঠল সেগুলি আবার ঝাড়খণ্ড দাবি করল। জমিহারা কৃষকদের মধ্যে যারা প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও চরে আশ্রয় নিলেন তাদের উপর চলল ঝারখণ্ডের পুলিশ – প্রশাসনের জুলুম এবং দিয়ারার ডাকাত ও দুষ্কৃতীদের অত্যাচার।
ফারাক্কার পর থেকে গঙ্গার ভূমিঢাল দক্ষিণ – পূর্বে। তাছাড়া পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করা ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খানের কার্যকালে (১৯৫৮ – ’৬৯) পদ্মার রাজশাহীর দিকের উত্তরের পাড়ে শক্তপোক্ত বাঁধ দেওয়া, অন্যদিকে মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রতি বর্ষায় ভাঙ্গন প্রতিরোধের নামে রাজনৈতিক নেতা – আমলা – ইঞ্জিনিয়ার – ঠিকাদার চক্রের বোল্ডার ফেলার নাটক মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা, সামসেরগঞ্জ, সুতি ১ ও ২, রাঘুনাথগঞ্জ ১ ও ২, লালগোলা, ভগবানগোলা ২, রানিনগর ২ ব্লকগুলিতে ঘটিয়ে চলেছে গঙ্গা, পদ্মা ও ভাগীরথীর ভয়ানক ভাঙ্গন।
বিস্তীর্ণ দুপাড়ের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও:- কোন কোন বিশেষজ্ঞর মতে মালদা, মুর্শিদাবাদের মাটি পলি, কাদা ও বালি মিশ্রিত ছিদ্রযুক্ত পাললিক মাটি। বর্ষার প্লাবনের সময় জল এই মাটিকে সজোরে ধাক্কা দেয়। প্লাবনের সময় এই মাটিকে ভিজিয়ে নরম করে দেয়। আর প্লাবনের শেষে জল যখন নামতে থাকে তখন তার টানে এই ভিজা ও নরম মাটি ভাঙ্গতে থাকে।
আবার বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ দেখিয়েছেন গঙ্গোত্রী থেকে হরিদ্বার গঙ্গার ঊর্ধ্বগতি (High stream), হরিদ্বার থেকে রাজমহল পাহাড় গঙ্গার মধ্যগতি এবং তারপর থেকে সাগরে মোহনা পর্যন্ত নিম্নগতি। মধ্যগতিতে নদী তার বেশিরভাগ পলি সঞ্চয় করে আর নিম্নগতিতে পলি ছাড়ে। কিন্তু ফারাক্কা ব্যারেজে পলি আটকে যাওয়ায় এবং ব্যারেজের স্লুইস গেটগুলির একাংশ দীর্ঘদিন অকেজো হয়ে পড়ে থাকায় গঙ্গার নদীখাতের নাব্যতা তলানিতে এসে পড়েছে। যখন উত্তর ভারতের বর্ষার জল গঙ্গার খাত দিয়ে হুড়মুড়িয়ে নামে তখন পশ্চিমবঙ্গের মালদা এবং মুর্শিদাবাদ প্লাবনে বিপর্যস্ত হয় এবং নদী পাড় ধরে বড় রকম ভাঙ্গন হতে থাকে।
গঙ্গা থেকে প্রতি বছর গড়ে ৪৬ হাজার কোটি ঘন মিটার জল প্রবাহিত হয় যার ৮০ % বর্ষার সময় প্রবাহিত হয়। গঙ্গা সংলগ্ন মজে যাওয়া বা মেরে ফেলা ছোট নদী এবং জলাশয় ও বিলগুলিকে যদি সংস্কার ও পুনরজাগরিত করা যায় তাহলে বন্যা ও ভাঙ্গনের প্রকোপ কমে এবং সারা বছর জলের সুরাহা হয়।
আবার প্রচলিত ধারণা এবং বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞদের মতামতের বিপরীতে গিয়ে বিশ্বাস ও সামন্ত তাঁদের পূর্বোক্ত গবেষণায় দেখিয়েছেন যে ফারাক্কার কার্যকালের আগে (১৯৩১ – ৭৮) ফারাক্কা পরবর্তী সময়ের (১৯৭৯ – ২০১১) চাইতে বেশি ভাঙ্গন ঘটেছে (যথাক্রমে ২৮,২৯০ ও ১১,২৪৯ হেক্টর) এবং পুরো ৪০ হাজার কিউসেক জল দিতে না পারলেও আনেকটা জল জুগিয়ে কলকাতা বন্দরকে এখনবধি বাঁচিয়ে রাখা গেছে।
গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা:- উত্তরবঙ্গের ধ্বস, হড়পা বান ও বন্যা; সুন্দরবনের সামুদ্রিক ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নদীপাড় ভাঙ্গা এবং মালদা ও মুর্শিদাবাদের ভয়াল নদীপাড় ভাঙ্গন – স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, কর্মসংস্থান, আইন শৃঙ্খলা ও গণপরিবহন ব্যাবস্থায় সঙ্কট; পরিবেশ দূষণ; বাল্য বিবাহ ও নারী পাচার; জনসংখ্যা বৃদ্ধি; দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি; সীমান্ত সমস্যা, চোরাচালান ও অনুপ্রবেশ; ব্যাপক দুর্নীতি ও তোলাবাজি; রাজনৈতিক হানাহানি প্রভৃতির সাথে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার, তার প্রশাসন ও পঞ্চায়েত – পৌর ব্যাবস্থা, তার জনপ্রতিনিধিবৃন্দ, কেন্দ্র ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সরকার, সামরিক বাহিনী, দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী, প্রতিবেশী দেশ সহ সমস্ত অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে দ্রুত এগুলি মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেবেন এটিই কাম্য। গঙ্গা, পদ্মা ও ভাগীরথী বাঁচলেই আমাদের দুই বাংলা এবং সেখানকার মানুষ ও সভ্যতা বাঁচবে।
০২.০৮.২০২৪