আজ ঠিক ন’মাস চব্বিশ দিন হলো মা চলে গিয়েছে। যতদিন আমাকে গর্ভে ধরে রেখেছিল, প্রায় ততদিনই আর দেখতে পাই না মাকে।
শুধু আমি নয়, মহাবলীপুরম থেকে মায়ের শখ করে আনা মার্বেলের গণেশমূর্তি, ঋষিকোণ্ডা বিচ থেকে কেনা ঘাড় নড়নড়ে পাথরের কচ্ছপ, পিপলির জগন্নাথ আঁকা দেওয়ালঝোলা — ওরাও দেখেনি। ন’মাস চব্বিশ দিন। এই ঝোরো বাদলের দিনে ওদেরও তাই আমার মতোই মনখারাপ।
মা চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে নরম করে খেত — চিবোতে কষ্ট হতো তো, তাই।
শেষের দিকে ডুবিয়ে রাখার সময়ের আন্দাজ ভুল হয়ে যেত, নরম টুকরো মূল বিস্কুটের ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডুবে যেত কাপের তলানিতে। মা অসহায় আঙুল ডুবিয়ে ডুবিয়ে গলে যাওয়া টুকরো খুঁজত গরম চায়ের মধ্যে। আমি দেখতে পেলে দৌড়ে এসে আঙুল সরিয়ে চামচে দিয়ে তুলে আনতাম নরম থকথকে ময়দার গুলিটিকে।
‘কী যে করো, মা — আঙুল পুড়ে যাবে যে!”
মা হাসত। বিষণ্ণ, বিব্রত হাসি — ‘আমার আর গরম লাগে না রে তেমন, অভ্যেস হয়ে গেছে এতদিনে — একসময় রান্নাঘরে কত গরম জিনিস ন্যাকড়া ছাড়াই ধরেছি’ —
পঞ্চান্ন বছরের প্রৌঢ়ার মাতৃবিরহ বিলাপ সক্কলের অসহ্য ঠেকছে, জানি।
চন্দ্রসূর্যের উদয়-অস্তের মতো স্বাভাবিক ঘটনার অভিঘাত এতদিনে তো ধুয়েমুছে বিলীন হয়ে যাওয়া উচিৎ অনস্তিত্বের মেঘের আড়ালে! ঠিকই।
আমিই কেবল ভুলতে পারি না কেন যে, কে জানে!
কেবলই মনে পড়ে, মা যখন ভেন্টিলেটরে লড়ছিল আর হেরে যাচ্ছিল একটু একটু করে, তখন আমি থাকতে পারিনি মায়ের পাশে। অসময়ে সরকারি ডিটেলমেন্টের নির্দেশে অন্য কোনোখানে কোনো ডেঙ্গি রোগিণীর সরু শিরায় কাঁপা, অনভ্যস্ত হাতে স্যালাইনের চ্যানেল করছিলাম। বেসরকারি বড় হাসপাতালের ধন্বন্তরি ডাক্তারবাবু যখন সব প্রোটোকল ভেঙে আমাকে দেখিয়ে জুনিয়র ডাক্তার, সিস্টারদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন — ‘পেশেন্টের মেয়েকে সবসময়, দিনে রাতে যেকোনো সময়ে আইসিইউতে ঢুকতে দেবে, দেখতে দেবে’, তখনো আমি থাকতে পারিনি।
একবুক উদ্বেগে আকুল মন আর এক হাতে মুঠোফোনের স্পর্শ নিয়ে মায়ের বিছানা থেকে বারো কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে জ্বরের রোগীর প্রেসকৃপশন লিখেছি খসখস করে। পাইনি কাঙ্খিত ছুটি — পাছে ডিটেলমেন্ট পোস্টিংয়ে হাজিরায় অনিয়ম হলে আরো কঠিন বিভাগীয় শাস্তি জোটে কপালে!
বিস্তর দৌড়ঝাঁপ করে যখন ছুটির ব্যবস্থা করতে পারলাম, তখন আর তার প্রয়োজন পড়ল না তেমন — মায়ের ছুটি হয়ে গেল।
সেই বিতাড়িত হওয়া কর্মক্ষেত্রে ছ’মাস পরে ফিরে এসে ফের কোমর বেঁধে লেগে পড়েছি পূর্বকাজে, কোনো অপমানবোধ ছাড়াই। আশ্চর্য নয়?
রক্তের স্টক, ক্যাম্প রোস্টার, রিকুইজিশন বেছে রক্ত দেওয়া, গ্রুপ আর ক্রসম্যাচ করা — ঠিক আগের মতো কাজকর্ম করছি। যেন সব ঠিকঠাকই রয়েছে। সেইরকমই রোগীর আত্মীয়দের নরমে গরমে বোঝানো, স্টাফেদের বকেঝকে বা গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কাজ উদ্ধার, স্যারেদের নির্দেশ মেনে নিত্যকার ডিউটি — ব্যত্যয় নেই কোথাও। কোনো ছাপও তো নেই কারোর আচরণে — এই যে ব্লাডব্যাঙ্কের ম্যাডাম সুকন্যা, তার পৃথিবীটাই যে বেবাক হারিয়ে গিয়েছে, কোত্থাও সে অসীম শোক, অপার শূন্যতার কোনো ছায়া তো পড়েনি কারো কথায় বা ব্যবহারে! আমার মুঠোফোন বাদে কেউই বোধহয় লক্ষ্য করে না যে, ছ’সাতঘন্টা মাথা গুঁজে খাটার সময়টুকুর মাঝে কোনো ফোন আর আসে না —
‘কী রে, কখন বেরোবি হাসপাতাল থেকে? একা একা বাড়িতে আমার ভাল্লাগে না একদম।’
অনেক আগে আমার এক পরম সুহৃদকে প্রায়ই বলতাম — ‘অন্যের জুতোয় পা না গলিয়ে তার পরিবেশ বা পরিস্থিতি বিচার করা যায় না।’
আজ যখন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবার, পুজোর কেনাকাটার গল্প করে ফোনে — কবে কোথায় যাব, কোথা থেকে কী কী কিনব, অমুক জায়গার অমুক খাবারটা স্পেশ্যালিটি, তমুক শাড়িটা এবারে পুজোয় ইন থিং, এই নেটফ্লিক্স সিরিজটা ভাল, ঐ ছবিটা মাল্টিপ্লেক্সে দেখতেই হবে রিলিজ করলে, পূজাবার্ষিকী —টা এবারে খেলো হয়েছে, তার বদলে কম নামী পত্রিকাগুলোর শারদ সংখ্যা কেনাই ভালো ইত্যাদি ইত্যাদি — তখন আমার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, জীবন। কেউ একজনও অনুভব করতে পারে না আমার দুঃসহ একাকিত্বের দুর্বহ ভার?
জীবন, শুধু আমারই মনে থাকে, মায়ের বাৎসরিক এখনো হয়নি? আর হলেই বা কী? পৃথিবী থেকে অদেখা শেষ পদচিহ্নটুকুও কি মুছে যাবে মায়ের?
বাবুঘাটের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখি গজরাতে গজরাতে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছে ৭৯ডি, মধ্যমগ্রামের বাস। হারিয়ে যাওয়ার আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাতাত্তর নম্বর বাস ধরে ধর্মতলায় নেমে যাতে উঠে বাবা তার শেষ কর্মস্থলে পৌঁছত — কাটাখাল, গঙ্গানগর।
আমি ভাবতে থাকি, ঐ বাসগুলোর কোনো কোনোটা হয়ত বা কুড়ি বছরেরও বেশি পুরোনো। অজস্রবার ধোয়ামোছার পরেও সেইরকম কোনো বুড়ো ৭৯ডি-র কাঠের মেঝের অর্বুদ, কোটি ধূলিকণার মধ্যে আমার বাবার পায়ের ধুলোও হয়ত মিশে রয়েছে।
থাকতে পারেও তো!
এই অসম্ভব, অকারণ স্মৃতিকাতরতা কাউকে বলার নেই, কেউ বোঝার নেই — এটা দিনের পর দিন নিশ্চুপে সয়ে যাওয়া বড় কঠিন হয়ে উঠছে। লক্ষ্মীর পাঁচালি, শনির পাঁচালি, নিত্যকর্ম পদ্ধতি, সন্তোষীমায়ের ব্রতকথা, রেলের সময়সারণী, স্পেনসার্স আর ওয়াও মোমোর মূল্যতালিকা, শ্রীনিকেতনের শাড়ি আর চন্দ্রাণী পার্লসের গয়নার খবর — এইসবের তবু বাজার রয়েছে আজকাল, বিষাদের বারোমাস্যা নিজের হাট বাদ দিয়ে কোথাও বিকোয় না।
তাই তো ছুটি চাই জীবন, অন্য কোনো অচেনা দিগন্তে ভোরের আলো কিংবা অন্ধকার দেখার ছুটি।
এই ইঁটকাঠের বুড়ি পৃথিবীটায় আমাকে চমকে দেবার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই যে।
‘ইয়ে মহলোঁ, ইয়ে তখতোঁ ইয়ে তাজোঁ কি দুনিয়া
ইয়ে ইনসান কে দুশমন সমাজোঁ কি দুনিয়া
ইয়ে দৌলত কে ভুখে রেওয়াজোঁ কি দুনিয়া
ইয়ে দুনিয়া অগর মিল ভি যায়ে তো কেয়া হ্যায়!’