আমরা আসলে বড় হয়ে উঠি অন্যের ইচ্ছের উপর। আমাদের মৌলিক স্বকীয় ইচ্ছের জোর আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কতটুকুই বা ছাপ ফেলতে পারে! আজ এত ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ারদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় তারা কেন ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছিল- বেশির ভাগ এরই উত্তর হবে বাবা মায়ের কথায় কিম্বা তাদের বাবা মা ডাক্তার অথবা তারা ছোট থেকে শিখেছে যে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হয়! অর্থাৎ আমাদের ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার মধ্যে আমরা আসলে কী করতে চাই! বা কী করা উচিত বা আসলে কী যে হতে চাই??এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা আমাদের সময়ে সময়ে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে! প্রত্যেকের মধ্যে এই প্রশ্নবাণ যেন গভীরভাবে প্রথিত।
সাইকিয়াট্রিস্ট ভিক্টর ফ্রাঙ্কল (Viktor Frankl) একে মানবমনের অস্তিত্বজনিত শূন্যতা (Existential Crisis) বলেছেন। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এই অস্তিত্বজনিত শূন্যতা কম-বেশি বিদ্যমান। আমাদের জীবনের উপর নিজেদের অন্তর্গত বুনিয়াদি ইচ্ছের প্রভাব বড়ই কম। বেশির ভাগ সময় আমরা জানিই না, আমরা কী করতে চাই! আমরা আসলে অন্য লোকেরা যা করেছে সেটাই করে চলি (ফ্রাঙ্কলের মতে তা হল- Conformism অর্থাৎ প্রথানুবর্তিতা) কিম্বা অন্য লোকেরা আমাদের যা বলে দিয়েছে তা করে চলি (যা হল- Totalitarianism অর্থাৎ সর্বগ্রাসীবাদ )।
ফ্রাঙ্কল ছিলেন ভিয়েনার নিউরোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট এবং সাইকোলজিস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন হিটলারে নাৎসি জার্মানির সৈন্যরা ১৯৪২ সালে তাঁকে সহ তাঁর স্ত্রী, বাবা-মা পরিবারের সবাইকে ধরে নিয়ে কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে বন্দী করে! তিনি সব মিলিয়ে চারটি কনসেনট্রেশান ক্যম্পে ছিলেন- তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ভয়াবহ,নির্মম অসউইচ ক্যাম্পে(Auschwitz) ছিলেন শেষ তিন বছর। ১৯৪৫ সালে নাৎসি বাহিনী পরাজিত হলে, তিনি তাঁর পরিবারের একমাত্র জীবিত হিসেবে বেঁচে ফেরেন, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে। বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাবার পর তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইটি লেখেন ‘ম্যান’স সার্চ ফর মিনিং’ (Man’s Search for Meaning) নামে।
প্রথম জীবনে তিনি, ফ্রয়েড (Sigmund Freud) এবং আলফ্রেড অ্যাডলার (Alfred Adler-ভিয়েনার বিখ্যাত মনোবিদ)-এর দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত ছিলেন। এনারা তিন জনেই মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক তাগিদ (Motivation) নিয়ে নিজেদের ধারণা বলে গেছেন। ফ্রয়েড বলেছিলেন- কামনাতৃপ্তির ইচ্ছেই হল (A Will to Pleasure) আমাদের বেঁচে থাকার প্রাথমিক মোটিভ(Motive)। অ্যাডলার বললেন না- ক্ষমতার ইচ্ছেই (A Will to Power) আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।
ফ্রাঙ্কাল এঁদের দুজনের থেকেই আলাদা করলেন নিজেকে এই বলে যে-
যেখানে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম (Struggle for Existence) যেখানে অবলুপ্ত সেখানে আজকের এই পৃথিবীতে আমরা কিসের জন্যে বেঁচে আছি! কী কারণে আমরা বেঁচে আছি? কেন?! তিনি বললেন যে বেঁচে থাকার মানে খুঁজে বের করাই, বেঁচে থাকার প্রকৃত ফুয়েল! অর্থাৎ A Will to Meaning তিনি বলতে চাইলেন- যার কাছে এই ‘কেন’ র উত্তর রয়েছে অর্থাৎ বেঁচে থাকার মানে(Meaning) যার কাছে খুব স্পষ্ট এবং অর্থবহ তার কাছে অস্তিত্বজনিত শূন্যতাও তত কম।
আসলে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে যাওয়ার আগেই তিনি নিজের দার্শনিক কাজকর্ম শুরু করেছিলেন, তাঁর কাজের সবটাই প্রায় নষ্ট করে দিয়েছিল- সেই নাৎসি বাহিনী। তিনি যখন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পৌঁছান তখন তাঁর পকেটে শুধুমাত্র কিছু ফুটনোট। নাৎসি শিবিরের নৃশংস অভিজ্ঞতা তাঁর নিজের কাজের কাছে, নিজের থিওরির কাছে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জিং ছি্ যেন এক অগ্নিপরীক্ষা! যে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মানুষের থেকে সব কিছু কেড়ে নেওয়া হয়ত বা মনুষ্যত্বের শেষটুকুও। বেঁচে থাকার কোনও কারণ আর সেখানে অবশিষ্ট নেই। তবুও কিছু লোক রোজ কাজ করে যেতেন বেঁচে থাকার তাগিদ নিয়ে।প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যেও মানুষ একে অপরকে সাহায্য করছিল সেসময়। এই অভিজ্ঞতা ফ্রাঙ্কালকে আরও বিশ্বাসী করে তোলে। ক্যাম্প থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিনি ৯ দিন সময় নিয়ে পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে তাঁর বই Man’s Search for Meaning লিখেছিলেন। তিনি বললেন- ‘এক জন মানুষের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নেওয়া যেতে পারে শুধুমাত্র একটি জিনিস ছাড়া তা হল যেকোনো পরিস্থিতে মানুষের নিজের স্বকীয়তা। এই স্বকীয় মনোভাব বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা মানুষের থাকবেই-এটিই হল মানুষের শেষ স্বাধীনতা।’
অর্থাৎ যে কোনও পরিস্থিতিতেই এমনকি সবচেয়ে প্রতিকূল অমানবিক পরিস্থিতিতেও আমাদের জীবনের একটা অর্থ রয়েছে (Meaning in Life), আমাদের বেঁচে থাকার প্রধান শক্তি হল এই মানেটা খুঁজে বের করার ইচ্ছে (Will to Meaning) এবং আমাদের এই স্বাধীনতা (Freedom of Will) রয়েছে আমাদের কাজ ও অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এর তাৎপর্য খুঁজে বের করার।
ফ্রাঙ্কেলের মতে আজকের পৃথিবীতে তিন রকম ভাবে অস্তিত্বজনিত শূন্যতা তৈরি হয়।
এক, অন্ধ অনুকরণ করে সামাজিক পারিবারিক ধার্মিক রীতি আচার মেনে চলা। প্রথাগত শিক্ষালাভ, চাকরি সংসার, বাচ্চা বড় করা যন্ত্রের মত করে যাওয়া।
দুই, খুব বেশিরকম ভাবে সঞ্চয়ের দিকে ঝুঁকে থাকা- অনেক বেশি টাকাপয়সা গাড়ি বাড়ি ক্ষমতা প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে নিজের জীবন গড়ে তোলা।
তিন, দৈনন্দিন জীবনে নিরর্থক কাজকর্মে ব্যস্ত থাকা, ভাট বকা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিভি দেখে যাওয়া, ক্রমাগত ইন্সটাগ্রাম স্ক্রল করে যাওয়া, ফেসবুক সোশ্যাল মিডিয়ার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের দিনের শেষে শূন্যতা তৈরি করে।
প্রত্যেকেরই কাছেই এই মানে খুঁজে পাওয়ার একটি নিজস্ব নিজস্ব উপায় রয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে এই মানে কী কী ভাবে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে-
এক, কোনও ভালো লাগার কাজ করে বা সৃষ্টিশীল এক কাজের মাধ্যমে- এখানে কাজটা কত বড় তার উপর কিছুই নির্ভর করে না- কাজটা কী করে কতটা গুরুত্ব আর ভালোবাসা দিয়ে আর দায়িত্ব নিয়ে করা হয়েছে তার উপর এর মর্মার্থ লুকিয়ে থাকে।
দুই, জীবনের সবকিছুর উপর এক মসৃণ গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা। সমস্ত অনুভুতিকেই সাদরে আমন্ত্রণ জানানো, কোনও কিছুকেই পাশ কাটিয়ে না যাওয়া। প্রতিটি অনুভূতি আমাদের গভীরভাবে স্পর্শ করুক। কোনও মানুষের সাথে গভীর সম্পর্ক, সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়য়ের সৌন্দর্য, কোনও শিশুর অনাবিল হাসির আনন্দ আমাদের এই অন্বেষণে সাহায্য করবে।
তিন, যে কোনও যন্ত্রণা বা কষ্টকে সাহসে ভর করে গ্রহণ করা। আজকের এই পৃথিবীতে যন্ত্রণা বা কষ্ট থাকবে না এটা মানা অসম্ভব। সুতরাং প্রত্যেকে নিজের মতন করে এই কষ্টকে সহ্য করার মধ্যে দিয়েই আমাদের জীবন পূর্ণ অর্থবহ হয়ে উঠবে।
ভিক্টর ফ্রাঙ্কেল প্রবর্তিত এই থেরাপির নাম লোগোথেরাপি (Logotherapy)। Logo শব্দটি এসছে গ্রিক শব্দ Logos থেকে যার অর্থ Meaning (মানে)। মানসিক অবসাদ (Depression) থেকে অনেক বিভিন্ন মানসিক রোগের ক্ষেত্রে লোগোথেরাপি এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী আধুনিক সাইকোথেরাপির একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
কয়েক দশক পরেও Man’s Search for Meaning ধারাবাহিকভাবে অ্যামাজনের “সেরা ১০০ টি বই” এর তালিকায় রয়েছে। বইটি আজ অবধি ২৪ টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নির্মম, পৈশাচিক,অমানবিক কষ্টের মধ্যেও মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছের এক অসাধারণ জবানবন্দী এই বই।