১৯৭৭ সাল অবধি সারা ভারতে আভ্যন্তরীণ জরুরী অবস্থা (Internal Emergency) চলেছিল। জরুরী অবস্থায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র-পরিষদের বিরোধী পক্ষ বলে কিছু ছিল না। মেডিকেল কলেজেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ফলে ওখানে ছাত্র-পরিষদ দাপিয়ে বেড়াতো। তাদের সাথে কংগ্রেসের গুন্ডাবাহিনী মেডিকেল কলেজে ঘুরে বেড়াতো। যারা কোন ব্যাপারে প্রতিবাদ করতো তাদের উপর ওরা অনেক অত্যাচার চালাতো। সেই অত্যাচারের পর্যায় এমন ছিল যে জীবন দে-এর কিডনি ইনজুরি হয়ে গেছিল, স্বরূপ সরকারের মাথার মধ্যে রক্তক্ষরণ (intracranial haemorrhage) হয়ে খিঁচুনি হয়েছিল। কলেজের মধ্যে অত্যাচার ও মারধর নিয়ে তখন মেডিকেলের ছাত্ররা গুমরে মরছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেসকে সরিয়ে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে বিভিন্ন কলেজগুলোতে ছাত্র পরিষদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে ছাত্র-ছাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীন ছাত্র সংগঠন তৈরি করেছিল। মেডিকেল কলেজেও ছাত্র-ছাত্রীরা ছাত্র-পরিষদের প্রভাব থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মেডিকেল কলেজে MCDSA, প্রেসিডেন্সিতে Presidency College Students’ Steering Committee, যাদবপুরে DSF -এই সংগঠনগুলো তৈরি হয়েছিল অনেকটা পুঞ্জীভূত রাগ আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জায়গায় হিসেবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে কোন মুভমেন্ট বা চলন সব সময় দুটো ফ্যাক্টরেরর ওপর নির্ভর করে। একট ইন্টারনাল ফ্যাক্টর ও অপরটি এক্সটারনাল ফ্যাক্টর। ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেও এই ফ্যাক্টরগুলো আছে এবং তাদের মধ্যে সংঘাত আছে। রাজনীতি বা ব্যক্তিগত জীবনেও এই দ্বন্দ্ব বর্তমান। এই দ্বন্দ্বটা ঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে পারাটাই হলো একটা শেখার বিষয়।
১৯৭৭ সালে একটা গণজাগরণ এলো। মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাস এল। দম বন্ধ করা পরিবেশের বাইরে মানুষ নিঃশ্বাস ফেলতে পারল। সে নিঃশ্বাসের দমকা হাওয়াতেই কলেজে কলেজে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে এলো। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অত্যাচার মারধর বন্ধ হয়ে গেল। আবার ছাত্র নির্বাচন শুরু হল। মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে MCDSA বিপুলভাবে এল। প্রায় ৯০% ছাত্র-ছাত্রী মিলে তখন MCDSA করতো। এক্সটারনাল ফ্যাক্টর হিসেবে ছাত্র-পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসা কাজ করেছিল এবং ইন্টারনাল ফ্যাক্টর হিসেবে কিছু সচেতন ফোর্স তো ছিলই। এখনকার সময়ের মতো কিছু লোক চুপ করে ছিল। তারা নিজেদের খুব প্রকাশ্যে আনত না। কখনো কখনো এরকম সময় আসে যখন চুপ করে থাকতে হয়। বাকিদের পালস বুঝে এই চুপ করে থাকা কিছু লোকজন সচেতন ভাবে ডাক দিল। সাধারণ লোকজনের মধ্যে সব সময় একটা ভাল কাজ করার ইচ্ছে থাকে। বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে এই ব্যাপারটা বরাবর থেকেছে। বাঙালিরা ওইভাবে ব্যবসা করেনি। ফলে তারা চর্চা করেছে,পড়াশুনা করেছে। ফলে বাঙালিদের একটু টোকা দিলেই তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। এটা বাংলার চরিত্র। বাঙালিরা অন্যায় থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে না। সেই সময় আওয়াজ উঠল যে ছাত্র পরিষদের যারা অত্যাচার করেছে তাদের শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু শাস্তি সেভাবে দেওয়া হয়নি, ক্ষমাপ্রদর্শন করা হয়েছিল। এইভাবে MCDSA চলতে শুরু করল।
তখন সিপিআইএম-এর ছাত্র সংগঠন SFI, SUCI-এর ছাত্র সংগঠন DSO, সবাই MCDSA-এর মধ্যে ছিল। কিছুদিন পর SFI-এর মধ্যে সীমাবদ্ধতা এসে গেল। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় পরীক্ষা ব্যবস্থায় গন্ডগোল দেখা দিচ্ছিল। সেই বিষয়ে ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু SFI- নিয়ন্ত্রিত ছাত্ররা, বামফ্রন্ট সমর্থকের বাড়ির ছাত্র-ছাত্রীরা এর মধ্যে থাকেনি। আন্দোলন দমনে সরকার যখন কড়া কথা বলল, প্রতিবাদ করলে শাস্তি দেওয়া হবে– এমন কথা বলল, তখন SFI সরকারের সাথে তাল মিলালো। এইভাবে SFI আইসোলেট হয়ে গেল। তারা MCDSA থেকে বেরিয়ে গেল। মেডিকেল কলেজে SFI কখনো সেভাবে দাঁত ফোটাতে পারেনি। SUCI-এর ছাত্র সংগঠন DSO কে বরাবরই আমার সংকীর্ণ মনে হয়েছে। ওদের নিজস্ব ভাবনাচিন্তা আছে। ওরা মনে করত ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক বিকাশ ঘটেছে। ভারতবর্ষের সিস্টেমগুলি প্রকৃত গণতন্ত্রের নিদর্শন। এখানে রেনেসাঁ হয়েছে। ভারতবর্ষের চরিত্র গণতান্ত্রিক। ওরা মনে করত না ভারতবর্ষে এখনো সামন্ততন্ত্র রয়েছে, এখনো চাষীরা মহাজনের কাছ থেকে অত্যাচারিত হয়। তার ফলে তারাও এগোতে পারল না। ওরা MCDSA সাথে মিশে নিজেদের ভাবনাগুলো চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো। ফলে তারাও আইসোলেট হয়ে গেল।
ছাত্র পরিষদ যেমন কংগ্রেসের ভাবশধারা নিয়ে চলে, SFI যেমন সিপিএমের ভাবধারা নিয়ে চলে, সেরকম MCDSA কাদের ভাব ধারা নিয়ে চলবে? শুধু স্বতঃস্ফূর্ত বললেই তো হবে না। স্বতঃস্ফূর্ত, গণতান্ত্রিকের পাশাপাশি একটা সচেতন অংশ সমাজের সাথে যুক্ত আছে। যেহেতু একটা ইউনিফর্ম পার্টি ছিল না, নকশালরাও বহুধা বিভক্ত ছিল। তার বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলো ছন্নছাড়া হয়ে আছে, তাদের মতামত মিলছে না। কেউ কেউ মনে করছে যে আমাদের সংগঠন করাই উচিত নয়, গোপন থাকা উচিত। যেমন MCC, 2nd CC, CT—এরা তো কখনোই গণসংগঠন করার মধ্যে ছিল না। ওদের ভাবধারার দু একজন DSA-এর মধ্যে এলেও ওরা প্রকৃতপক্ষে DSA-এর মধ্যে ছিল না। তারা DSA-এর মধ্যে থাকার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি। কিন্তু এই মেডিকেল কলেজের ডাক্তারি পড়ুয়াদেরও তো কাজে লাগানো যায়। এরা হয়তো ওই অর্থে বিপ্লবী হবে না, কিন্তু এদেরকেও তো জুড়ে নিতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের কোন শ্রেণীচরিত্র থাকে না। তার না আছে চাকরি, না বুঝেছে সে তার জায়গা। ফলে তার কোন পিছুটান থাকে না। ছাত্র আন্দোলন সব সময় প্রগতিশীল হয়।
DSA-এর মধ্যে বিভিন্ন সংগঠনের অনুগত অনেকগুলি গোষ্ঠী ছিল- যেমন নিশান পত্রিকা, ছাত্র ঐক্য, ইত্যাদি। তারা কাজ করতো তাদের ভাবধারায় কিছু ছাত্রকে দীক্ষিত করার জন্য। ফলে DSA-এর মধ্যে এগিয়ে আসা সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা দেখল যে তাদের সিনিয়র দাদাদের মধ্যে মত পার্থক্য আছে। তবুও প্রথমদিকে এই ধরনের সংগঠনগুলো আমাদের মেডিকেল কলেজে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং রেখে চলত। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সংগঠনগুলির মতপার্থক্য যতটা কম আসে ততই ভালো এটা সংগঠকরা বুঝতো।
যে ছাত্র সচেতন তার কাছে আমরা এই মত পার্থক্য নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু সব ছাত্রের কাছে বলে লাভ নেই। পরের দিকে এই বোঝাপড়ার কাজ ঠিকভাবে না করার জন্য এবং সিনিয়রদের মধ্যে এত মত পার্থক্য দেখে জুনিয়ররা আবারও প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রভাবে পড়ল। এই সমস্যা ঠিক করে হ্যান্ডেল করতে না পারার জন্য (ইন্টারনাল ফোর্স ইউনাইটেড না থাকার জন্য) MCDSA-এর এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তা কিছু স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল। যদিও তার মধ্যে অনেক বীজ থাকার ফলে ছাত্ররা সমাজকে ও রাজনীতিটাকে বুঝতে চেষ্টা করল। তারা কিন্তু পরবর্তীকালে সমাজে অনেক পজেটিভ পদক্ষেপ রাখতে পেরেছে। তারা যতই ছাত্র থেকে ডাক্তার হয়ে যাক না কেন তাদের একটা বড় অংশের ভেতরে আজও কিন্তু যন্ত্রণা আছে। তারা হয়তো অনেক কারণে এগিয়ে আসতে পারে না, কিন্তু তারা নিজেদের পরিসরে কিছু না কিছু করার চেষ্টা করছে। একজন ছাত্রের জায়গা থেকে দেখলে হয়তো মনে হবে এরা কি এমন করছে। সমাজ পাল্টাতে গেলেও কিন্তু এই লোকগুলোকে সাথে নিতে হবে। মেজরিটি অংশকে নিজের পক্ষে না আনতে পারলে শত্রুপক্ষকে দুর্বল করা কঠিন। শ্ত্রুদের মধ্যে যে দ্বন্দ্বটা আছে সেটাকেও তো হ্যান্ডেল করতে হবে।
এই ব্যাপারটায় আমাদের বোঝার অনেক সময় গলদ থেকে যায়। ভুল বোঝাবুঝির জায়গা থেকে অনেকে চুপ করে থাকে। MCDSA তখন এসে অনেকগুলো ভালো কাজ করেছিল। সেই কাজের সুবাদে MCDSA মেডিকেলের সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে এটা এক্সপোজ করতে পেরেছিল যে ক্ষমতায় গেলেও তথাকথিত বামফ্রন্ট সরকার কিছু করতে পারে না। তারপর অনেকগুলো জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে সাংঘাতিকভাবে হয়েছিল। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় গিয়ে যে বামপন্থা থেকে সরে গিয়েছিল তা ছাত্রছাত্রীরা বুঝতে পেরেছিল।
CPM-ই কিন্তু প্রথম বেসরকারিকরণ শুরু করে। আগে মেডিকেল কলেজ বলতে সরকারি কয়েকটা কলেজ ছিল। ১৯৯০-এর আগে কয়েকটা প্রাইভেট হাসপাতাল ছিল বড়লোকদের জন্য, যেমন—বেলভিউ, উডল্যান্ডস, ক্যালকাটা হসপিটাল। আর কিছু কিছু নার্সিংহোম ছিল। যাদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো তারা ওখানে যাবে। তখন আমাদের মত পরিবারের লোকজনও কিন্তু মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা করাতো। আমার মায়ের অপারেশনও মেডিকেল কলেজে হয়েছে। আজ আমি আমার বাড়িতে যিনি হেল্প করতে আসেন তাঁকে যখন মেডিকেল কলেজে ব্যবস্থা করে দিলাম তিনি রিফিউজ করলেন। বললেন ওই পরিবেশে থাকতে পারবে্ন না, তার বদলে কিছু আর্থিক সাহায্য করার কথা বললেন। মানুষের ভাবনা-চিন্তার মধ্যে বদল এসেছে। এটার জন্য এত প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে তোলা হলো। KPC, AMRI,দেবী শেট্টির হাসপাতালের জন্য কার্যত বিনা পয়সায় জমি তুলে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে জ্যোতি বসুর এক আত্মীয় অম্লান দত্ত (CPM-এর একজন MP) একটি ভাষণ দিয়েছিলেন B. M. Birla-র অনুষ্ঠানে। ভাষণে তিনি বলেছিলেন কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা থেকে আমাদের সরে আসতে হবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা- এগুলোর দায়িত্ব সরকার পেরে উঠবে না। এই সব ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে সমাজের জন্য। ফলে CPM-ই কিন্তু বেসরকারিকরণের বীজটা পুঁতলো। তখনই সরকারের সাথে প্রাইভেটের পার্টনারশিপ তৈরি হলো এবং আস্তে আস্তে বেসরকারি হাসপাতালগুলো গড়ে উঠলো। আর সরকার তার নিজের খরচায় human resources তৈরি করল। তখন তো এখনকার মতন বেসরকারি কলেজ গড়ে ওঠেনি। সরকারি খরচে পড়া ডাক্তার-নার্স সব ওই বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চলে গেল। ফলে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে শুরু করল। CPM-এর সময় টাকা নিয়ে পোস্টিং দেওয়া, ডাক্তারি সিট দেওয়া প্রচুর হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী কোটাতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছেলেদেরকে ডাক্তারিতে ভর্তি করার নাম করে বহু স্বজনপোষণ CPM-এর আমলে ঘটেছে।
বামফ্রন্ট সরকার টাকা দিয়ে মেডিকেল কলেজগুলোতে আউটডোর চালু করলো। আমরা এটার প্রতিবাদ করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম এটা একটা পলিসির প্রশ্ন। এক টাকাটা বড় ব্যাপার নয়। আজ এক টাকা আছে কাল দু টাকা হবে। সরকার যেন এটা একটা পরীক্ষা করে দেখছে। আস্তে আস্তে এরকম সবই অর্থের বিনিময় হবে। আমরা দেখলাম আমাদের কলেজে থাকার সময়ের প্রথমদিকে যে সমস্ত ওষুধগুলো সরকার সরবরাহ করত আস্তে আস্তে সেগুলোর সরবরাহ বন্ধ হতে শুরু করলো, টাকা নেই এই যুক্তিতে। ফলে পেশেন্টরা ওষুধগুলো কিনে নিয়ে আসতো। আমরাও অনেক সময় যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো তাদের দিয়ে একজনের জায়গায় দুজনের ওষুধ কেনাতাম। আমরা সেগুলো বিক্রি করতাম না। কিন্তু খুব গরিব লোক যারা ওষুধ কিনতে পারবে না তাদের দিয়ে দিতাম। এভাবেও আমরা অনেক সময় কাজ করেছি। কিন্তু এই ব্যাপারটা তো সরকারই করতে পারত। বদলে সরকার ওটা থেকে হাত ধুয়ে ফেলল। সেই সময় কেন্দ্রে মনমোহন সিং নিউ ইকনোমিক পলিসি নিয়ে আসছে। ফলে কেন্দ্র সরকার যা করে রাজ্য সরকারও তাই করে। ভাবখানা দেখায় ওরা ওই করছে আর আমরা এই করলাম। কিন্তু একই পলিসি তো চলছে সর্বত্র।
যত দিন গেছে MCDSA-এর বহুবিভক্ত সচেতন অংশের মধ্যেও হঠকারিতা এসেছে। যারা 2nd CC থেকে হয়তো বা জেলে গিয়েছিল বা বসে গিয়েছিল তারা ফিরে এসেছে। ফিরে এলেও তাদের নিজেদের মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। নিজেকে তো উত্তর দিতে হবে। তারা নিজেদের অনেক বেশি এগিয়ে থাকা বলে প্রমাণ করতে চাইলো। তারা অনেকে কলেজের ভোটে অংশগ্রহণ করতে চায়নি। কলেজে পড়েছে সিস্টেমে ফিরেছে কিন্তু কেন ভোটে অংশগ্রহণ করেনি তা আমরা জানি না। কিন্তু তারা কলেজ ভোট বয়কট করার কথা বলেছে।
মেডিকেল কলেজে আমাদের ব্যাচ বা আমাদের পরের পরের ব্যাচে অনেকজনকে আমরা জড়ো করেছিলাম। আমরা কলেজে ঢোকার এক-দুই বছরে দাদাদের মধ্যে ওই দ্বন্দ্বগুলো বড্ড প্রকট হয়ে ওঠে। এই দ্বন্দ্বগুলো প্রকাশ্যে বলার কারণে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। সেই ফাঁকে ছাত্র পরিষদ আবার উঠতে শুরু করলো। মেডিকেল কলেজে ছাত্র পরিষদ ফিরে এলো। তাতেও আমরা খুব হেলদোল দেখলাম না। ১৯৮৪ সালের ব্যাচটায় যারা ঢুকেছিল তাদের নিয়ে আমরা সংগঠন গোছানোর চেষ্টা করেছিলাম। সেই কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা কাজ করে যখন শক্তি সঞ্চয় করছি তখন 2nd CC-র প্রভাবে থাকা লোকেরা কলেজ রাজনীতি বয়কট করে এদের বাইরে নিয়ে গিয়ে NDCC নামক সংগঠন তৈরি করেছিল। ঢাকুরিয়া ব্রিজের পাশে বড়লোকের বাড়িতে NDCC-র খাওয়া দাওয়া (মদ্য সহযোগে), গণসংগীত চলেছে ধনী ব্যবস্থাপনাতে। তারা কলেজে আসত না। কলেজে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের সাথে থেকে তাদের সমস্যাগুলোকে বোঝার চেষ্টাই করেনি। সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের সামনে সরকারের ভুলদিকগুলো এক্সপোজ করেনি। ছাত্র পরিষদও খুশি হল। ভোটে ৫-০ করে নিল যেটা আমাদের করার কথা ছিল। এতে আমাদের ক্ষতি হয়েছে।
ছাত্র রাজনীতি করতে গেলে ছাত্রদের সাথে থাকতে হবে। তাদের মধ্যে এগিয়ে থাকা অংশকে তোমার কথাগুলো বল। যে অংশ এগিয়ে আসেনি তাদের বড় বড় শব্দ বলে লাভ কি? তার সাথে তার মতো করে মেশো। তার দৈনন্দিন সমস্যাগুলোকে ফেস করো। কত গরীব, মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে এসেছে। তাদের পারিবারিক পরিস্থিতিতে তার সমাজটাকে বোঝার চেষ্টা করা উচিত। তা না করে কেবল বড় বড় কথা বলে তাদের মধ্যে penitrate করা যায় না। তোমাকে আঁতেল বলে দাগিয়ে দেবে। আমরা কিন্তু সেটা পেরেছিলাম।
আমাদের ব্যাচের বেশ কিছু ডাক্তার CMOH হয়ে গেছে বা বিদেশে চলে গেছে অথবা কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি করছে। আজও এত বছর পরে আমরা যখন একসঙ্গে বসি তখন আলোচনা চলে যে আমাদের DSA-র মত মানসিকতার ছেলেমেয়ে কত কম পাওয়া যায়। আলোচনার মধ্যে DSA শব্দটা বলতে আমরা গর্ব অনুভব করি। আমাদের ব্যাচের প্রণব এখন বর্ধমানে CMOH। সেও তো আমাদের DSA। প্রণব সেফ হোমের দায়িত্ব যাদের দিয়েছিল তারা জানে না যে প্রণব DSA। এখনকার DSA-র ছেলেমেয়েরা যারা ওখানে কাজে যায় প্রণব তাদের ঠিক খোঁজ নিয়ে নেয়। তাদেরকে দায়িত্ব দেয় ও ভরসা করে। বলে আমাদের DSA-র ছেলেরা ঠিকঠাক আছে। এটাই বা কম কিসের। এই যে সাহায্য করা, নিজের মতো করে ভাবনাচিন্তা করে কিছু করার চেষ্টা, এটা কিন্তু আমাদের রাজনীতি করার সুফল। DSA করেই এটা হয়েছে। DSA যারা করেছে তাদের মেজরিটি ওষুধ কোম্পানির কাছে টাকা বা সাহায্য নেয় না। একজন রোগীকে অহেতুক বেশি খরচ করিয়ে ওষুধ কেনায় না বা পরীক্ষা করায় না। এটা আমাদের ব্যাচেও দেখেছি। এটা জীবন দর্শন।
DSA-এর মধ্যকার কন্ট্রাডিকশন (ইন্টারনাল ফ্যাক্টর) আমাদের এত পিছিয়ে দিয়েছে যে এখন এক্সটারনাল ফ্যাক্টর যতই ফেভারেবল হোক না কেন (মানে শত্রুরা খুব দুর্বল, নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে) সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কিছু করার প্রচেষ্টা নেই। সমাজেও এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর মত একটা ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি নেই। যেটার খুবই দরকার। স্বতঃস্ফূর্ততায় হয়তো এই সরকার চলে যাবে। কিন্তু তারপর কি হবে? আবার কিছু একটা তৈরি হবে। কংগ্রেস থেকে সিপিএম, সিপিএম থেকে তৃণমূল, তৃণমূল থেকে বিজেপি,একই ভাবনাগুলি চলতে থাকছে।
শুধু ছাত্র আন্দোলন নয়, আমরা জুনিয়র ডাক্তারদেরও বড় বড় বেশ কয়েকটা আন্দোলন করতে পেরেছি। ১৯৮৩ তে যখন রামনারায়ণ গোস্বামী বা পরে অম্বরীশ মুখার্জী যখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন প্রত্যেককে কঠিন পরিস্থিতি ফেস করতে হয়েছে। ১৯৮৮-৮৯ সালে মেডিকেল কলেজে পাশের আরপুলি লেন থেকে তুঁতে খেয়ে একজন রোগী ভর্তি হয়। সরকার তখন যেহেতু ওষুধ সাপ্লাই বন্ধ করে রেখেছে, আমরা রোগীকে বাইরে থেকে ওষুধ কিনতে দিই। যখন রোগী মারা গেল তখন জনগণ তো বুঝতে পারেনি যে কে ওষুধ সাপ্লাই বন্ধ রেখেছে। তারা তখন ভেবেছে ডাক্তাররাই ওষুধগুলো হয়তো বিক্রি করে দিয়েছে। ডাক্তারদের ওপর আঘাত নেমে এসেছিল। এই অবস্থার জন্য তো ডাক্তাররা দায়ী নয়। ফলে ডাক্তাররাও পাল্টা প্রতিবাদ করেছিল। কাজ বন্ধ করার কথা আমরা ভাবিনি। এমার্জেন্সি চালু রেখেছিলাম। এমনকি বাইরের রোগীদের জন্য আউটডোর চালু ছিল। এই আউটডোর চলেছিল খোলা আকাশের নীচে, সরকারি বিল্ডিং-এ নয়।
এখনকার আন্দোলনের ধরনটা একটু আলাদা। আন্দোলনগুলো অনেকটা জনগণ বনাম ডাক্তার হয়ে যাচ্ছে। সরকার মজা নিচ্ছে এই দুই অংশকে একে অপরের সঙ্গে লড়িয়ে দিয়ে। ডাক্তারের অনেক পয়সা আছে, গাড়ি আছে, এই ধারণা জনগণের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আর ডাক্তাররাও তেমন মিছিল করে জনগণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। বড় বড় ডাক্তাররা অ্যাপেলো, মেডিকা থেকে আওয়াজ তুলছে যে সরকার ঠিক করছে না অন্যায় করছে। সরকার বিরোধী কথা উঠছে ভালো কথা, কিন্তু কোথাও অভিমুখটা ঠিক নেই। অভিমুখটা জনগণের বিরুদ্ধে হয়ে যাচ্ছে। জনগণ ও ডাক্তারদের মধ্যেকার যে দ্বন্দ্বগুলো হাইলাইট করা উচিত নয় তা আমরা করছি। ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই দ্বন্দ্ব তো থাকে, সেটাকে তো কমাতে হবে। বাড়ালে তো নিজের পরিবারের ভাঙ্গন হবে। এটা আমরা বুঝতে পারিনা। রোগী ও চিকিৎসক অনেকটা একসঙ্গে পরিবারের মত। যতক্ষণ না আমরা এটা বুঝব ততক্ষণ সমস্যা থাকবে। কর্পোরেটরা এটাই চায় -আমরা যেন রোগীর সাথে দূরত্ব তৈরি করি। ডাক্তার রোগীর মধ্যে সহজ সম্পর্কটা ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। আগেকার দিনে ডাক্তাররা রোগীর বাড়ি যেত। ডাক্তারবাবু রোগীর ভালো চান এটা মানুষ বুঝত। রোগী মারা গেলেও মানুষ বিশ্বাস করত ডাক্তারবাবু তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। এই বিশ্বাসকে কর্পোরেট ভাঙবে, সরকারও ভাঙতে সাহায্য করবে- এটাই স্বাভাবিক। কর্পোরেট ডাক্তারকে বলল- তোমার কাছে রোগী আসবে, তোমাকে ভাবতে হবে না। আর রোগীদের বলল- তোমাদের জন্য ঝাঁ চকচকে বাড়ি বানাচ্ছি, এ সি ঘর, সুন্দর রিসেপশন, বসে আরাম। যেখান থেকে বেশ বড় চেম্বারে কোর্ট-প্যান্ট পরা ডাক্তার দেখলে প্রাণে ভক্তি হয়। সেখানে রোগীর দেখানো অভ্যেস হয়ে গেল শপিংমলে বাজার করার মত। ফলে ডাক্তার ও রোগী ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। রোগী তো ডাক্তারকে ফোন করে না, হাসপাতালে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়। রোগীর সমস্ত ডাটা হাসপাতালের হাতে। রোগী যখন ভর্তি হচ্ছে নামে কেবল একজন ডাক্তারের অধীনে ভর্তি হচ্ছে। আসলে কোন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে সেটাই প্রধান।
ডাক্তারদের কিন্তু সরকারি চাকরি আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি চাকরি আর হয় না। বেশিরভাগই কন্ট্র্যাকচুয়াল চাকরি এবং তাও আবার ৬০-৭০ হাজার টাকার। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রেও তাই । এটা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ESI-তে আশি শতাংশ ডাক্তার বা অফিসার কন্ট্র্যাকচুয়াল. ডাক্তার কর্পোরেটে গেলে মাসে দু লাখ টাকা পাবে। সে সরকারি চাকরিতে আসতে পারছে না বা তাকে আসতে দেওয়া হচ্ছে না। কর্পোরেটও ধীরে ধীরে স্যাচুরেটেড হয়ে যাচ্ছে।
রোগী দেখছে যে তার বিল পাঁচ লাখ টাকা হয়েছে। তার মধ্যে ১৫ হাজার টাকা যে ডাক্তার পাচ্ছে তাতো রোগী বুঝছে না। আর ডাক্তারও এটা বাইরে তেমনভাবে বলতে পারছে না। বললেই পরের দিন তাকে বের করে দেবে। কর্পোরেট বলবে- তোমায় আমি ২০ টা রোগী দিয়ে মোট ৩ লাখ টাকা আয় করার সুযোগ করে দিচ্ছি, কাজেই বেশি বাড়াবাড়ি করো না। আস্তে আস্তে বেশিরভাগ ডাক্তাররা কর্পোরেটের খপ্পরে পড়ে গেছে। কিন্তু এই জিনিসটা ডাক্তাররা এক্সপোজ করতে পারছে না। রোগীদের সাথে যে সংঘাত তার মূল কারণ এই ব্যাপারটা। রোগীর পকেট থেকে খরচ এত বেশি কেন সেটার কারণ রোগীরাও খতিয়ে দেখছে না। কেউ দেখানোরও নেই। সরকার যখন স্বাস্থ্যকে কনজিউমার প্রটেকশন এক্টের আওতায় আনল তখন কোনও প্রগতিশীল লোকেরা বা কোনও পার্টি তো প্রতিবাদ করেনি। তারা ভেবেছিল এতে ভালো হল, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জায়গা পেল রোগীরা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে লাভ হল কর্পোরেটদের। স্বাস্থ্য পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে ডাক্তার ও রোগীর সম্পর্ক আরো খারাপ হলো। সরকার একদিকে প্রচার করলো ডাক্তার কাজ করছে না, গ্রামে যেতে যায় না। উল্টোদিকে কর্পোরেট বলল রোগী ডাক্তারের অধীনে ভর্তি উনি কি করবেন, উনি দেখবেন। এদিকে কনজিউমার কোর্ট ডাক্তারকে ফাইন করছে কারণ শেষমেষ রোগীর রেস্পন্সিবিলিটি ডাক্তারের। ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ফাইন করা হচ্ছে। ১ কোটি টাকা একজন ডাক্তার কিভাবে দেবে! সারাটা জীবন ধরে সঞ্চয় করে সে যে বাড়ি বানিয়েছে সেটাকে হয়তো তখন বেচতে হবে। একদিকে চিকিৎসক অপরদিকে রোগীরা আতঙ্কে ভুগছে। সরকার এবং কর্পোরেট যথাযথভাবে এটা করতে পেরেছে। সরকার ও কর্পোরেট কিন্তু একজোট হয়ে আছে। অপরদিকে ডাক্তার ও রোগী যারা সমাজের বৃহদংশ তারা ইউনাইটেড থাকার মত পরিকল্পনা করছে না, তাদের কেউ একসঙ্গে বাঁধছে না, কেউ বলছে না যে- আমরা চাই সমস্ত পরিষেবা সরকার দিক, সরকার সমস্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিগ্রহণ করুক, কোভিডের সময় সরকার যেমন প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে অধিগ্রহণ করল।
NHS (National Health Service)-এর সুবিধে পাওয়ার জন্য ইংল্যান্ডে সাধারণ জনগণকে চিকিৎসা খাতে পকেট থেকে টাকা খরচ করতে হয় না। আজ আমি যে অসুস্থ হয়েছি আমার ওষুধ কিনতে হচ্ছে ৫০০০ টাকা দিয়ে, একটা অক্সিজেন কনসেনট্রেটর কিনতে হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে, হুইল চেয়ার কিনতে হচ্ছে ২৫ হাজার টাকা দিয়ে। এই যে সব এক একটা করে কিনতে হচ্ছে, NHS-এ তো সেটা নেই। ইংল্যান্ডের সরকার তো কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত নয়! সেখানে রাষ্ট্র যখন এসবের যোগান দিতে পারছে সরকার চাইলে এখানেও দিতে পারে।
আজকে ESI-তে শ্রমিকরা যে টাকা দেয় সেই অর্থের পরিমাণ কিন্তু কম নয়। সমস্ত শ্রমিক তাদের মাইনের ১.৫% টাকা দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২০ লক্ষ ESI কার্ড হোল্ডার আছে, হিসেব অনুযায়ী প্রায় ১ কোটি জনগণ। পশ্চিমবঙ্গে ৯ কোটির মধ্যে ১ কোটি জনগণ, যারা কিন্তু নিম্নবিত্ত সেই অংশকে ESI কভার করছে। এদের বার্ষিক অনুদান প্রায় ১০০০ কোটি টাকা। এই ১০০০ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ESI কর্পোরেশনে জমা হয়। ডাক্তারদের মাইনে, ঔষধ, বাড়ি তৈরি, সব মিলে ৬০০-৭০০ কোটি টাকা খরচ হয়। ৩০০-৪০০ কোটি টাকা প্রতিবছর জমছে। সরকারি বীমা ব্যবস্থা যে লাভজনক ESI তার উদাহরণ। এখন ESI কর্পোরেশন এর মোট ফান্ড এক লক্ষ কোটি টাকার উপরে। রোগী আউটডোরে ওষুধও পাচ্ছে, এক্সরে – এমআরআই করাতে পারছে, অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করাতে পারছে, ভর্তি হলে পেসমেকার থেকে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে।
কিছুদিন আগে অনিল আম্বানি যখন ডুবতে চলেছে তখন ESI কর্পোরেশন ৪০০০০ কোটি টাকা আম্বানির কোম্পানিতে লগ্নি করেছে। তাদের যুক্তি এই টাকা ব্যবহার করে ESI কর্পোরেশন ফান্ডকে আরো বাড়াবে, ব্যাংকে রেখে ঠিকমতো বাড়ছে না। তারপর অনিল আম্বানি দেউলিয়া হয়ে গেল। সেই টাকা কি আর ফেরত আসবে?! এটাতো শ্রমিকদের টাকা। তারা তো কেউ প্রশ্ন তুলছে না! বরং ESI রোগীরা ডাক্তারদের কাছে অনুরোধ করে তাদেরকে টাই-আপ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। সরকারের দেওয়া ৫০০ কোটির মধ্যে ১০০ কোটি টাকা এই টাই-আপ হাসপাতালের পেছনে চলে যায়। এটার কোন দরকারই ছিল না। একটা অর্শ অপারেশনের প্যাকেজ যেখানে ১৬ হাজার টাকা সেখানে সাধারণ অর্শ অপারেশনকে সংক্রমণ হয়েছে, সিসিইউ-তে রোগীকে রাখতে হয়েছে এই সমস্ত মিথ্যে দেখিয়ে সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা বিল হয়েছে। অনেক অন্ধকারে থাকা হাসপাতাল আজ বিশাল হাসপাতালে পরিণত হয়েছে ESI এর টাকা চুরি করে। আমরা যখন সরকারকে এগুলো দেখাচ্ছি তখন সরকার তেমনভাবে সাপোর্ট দিচ্ছে না। হয়তো দেখা যাবে এই কর্পোরেট হাসপাতালগুলিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের পার্টনারশিপ আছে। কিছু ডাক্তার কিন্তু এই চক্রকে জনগণের সামনে এনেছে পিছুটানকে অতিক্রম করে। ESI মডেলে সরকার চাইলে সমস্ত জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। রোগীদের দাবি তোলা উচিত তাদের টাকা ESI-এর নিজস্ব ফান্ডেই রাখতে হবে। সেটার অডিট প্রকাশ্যে টাঙাতে হবে। নতুন হাসপাতাল তৈরি করা, এখনকার হাসপাতালগুলোর পরিকাঠামো উন্নয়ন করার দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত। AMRI হাসপাতালে আগুন লাগার এত বছর পরেও বারোটা ESI হাসপা্তালে ফায়ার লাইসেন্স নেই। ইচ্ছে করে হাসপাতালগুলোকে যেন গরিব করে রাখা হয়েছে। সরকার চায় এখান থেকে রোগীরা প্রাইভেটে চলে যাক। কিছু চিকিৎসক মিলে আপ্রাণ চেষ্টা করছে টাই-আপ কমাতে। শ্রমিকদের থেকে এই দাবিটা না এলে এই পরিবর্তন সম্ভব হবে না। শ্রমিকদের দাবি তোলা উচিত তাদের টাকায় টাই-আপ-এর বদলে ESI হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নতি করে সেখানেই চিকিৎসা হোক। হাসপাতালে রোগীর বাড়ির লোকের থাকার, নিদেন পক্ষে বসার ব্যবস্থা তো করা যায়। কর্পোরেটের থেকে গুণগত মানের হাসপাতাল তৈরি করার ক্ষমতা ESI রাখে। ESI দেখিয়েছে সরকার চাইলে ট্যাক্সের টাকার অংশ দিয়ে লাভজনক স্বাস্থ্যপরিষেবা চালানো যায়। লাভের ক্ষেত্র বলেই সরকার এটা করবে না। কর্পোরেটের হাতে তুলে দেবে মেডিক্লেমগুলো। ধরা যাক একজনের অপারেশন করতে ১ লাখ টাকা লাগলো। বেসরকারি বীমা কোম্পানি দেবে ৪০ হাজার টাকা। অথচ প্রত্যেক মাসে কিন্তু পলিসির টাকা দিয়ে দিতে হয়। এক একটি পরিবারের এত বছর ধরে পলিসির টাকা হিসেব করলে তা শেষ করা যাবে না। তার ওপর আছে ওই টাকার ইন্টারেস্ট। সরকারই এই বেসরকারি মেডিক্লেমগুলিকে মদত দিচ্ছে।
আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যে প্রাথমিক জিনিসগুলো দরকার, যেমন- স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য—এগুলি সরকারি তত্ত্বাবধানে হওয়া উচিত। এটা কিন্তু জাপানও করেছে, অস্ট্রেলিয়াও করেছে, জার্মানি করেছে, নরওয়েও করেছে। কেবলমাত্র কিউবা বা চীন করেছে এমনটা নয়। Universal Health Care না করার তো কোন কারণ নেই। অনেকে আজে বাজে যুক্তি দেয় যে শ্রীলঙ্কার মত অবস্থা হবে। শ্রীলঙ্কার এই অবস্থার পেছনে অন্য অনেক কারণ আছে। ওরা কৃষিকে প্রাধান্যই দেয়নি। সাধারণ মানুষ এটা নিয়ে ভাবছে না। চিন্তার আরো বিষয় প্রগ্রেসিভ অর্গানাইজেশনগুলো ও এটা ভাবছে না। তারা ডাক্তারকে ধনীর গোষ্ঠীতে ফেলে দিচ্ছে। ডাক্তাররা এখন আর ধনী নেই। এত মেডিকেল কলেজ তৈরি হয়ে গেল, এত হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ হয়ে গেল, বেসরকারি কলেজগুলোকে এত টাকা তোলার ক্ষমতা দেওয়া হলো! ৮০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা দিয়ে ডাক্তারি পড়ানো হচ্ছে! ব্যাংকের লোন নিয়ে, জমি বিক্রি করে ডাক্তারি পড়াটা একটা ট্রেন্ড হয়ে যাচ্ছে। এত ডাক্তার তৈরি হচ্ছে কিন্তু চাকরির জায়গা নেই। আমি ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে দেখি ৮টা পোষ্টের জন্য ৭৮ জন ডাক্তার এসেছে। মাইনে মাত্র ৬০ হাজার টাকা। তাদের আকুতি যেখানে খুশি একটা চাকরি দেওয়ার জন্য। রাজনৈতিক কন্টাক্ট ছাড়া হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে চাকরিও এখন মুশকিল।
Clinical Establishment Act-এর নিয়ম এমন করে দিয়েছে যে ডাক্তাররা নিজের মতো করে চেম্বারে বসতে পারছে না। CPM কিন্তু এটা করে দিয়ে গেছে অমল দত্তের সময় থেকে। আগে ডাক্তার বাড়িতে বা ওষুধ দোকানে চেয়ার টেবিল নিয়ে রোগী দেখতে পারত। Clinical Establishment Act-এ তাতে বাধা পড়ল। রোগী দেখতে গেলে এখন ছেলে ও মেয়েদের দুটো আলাদা বাথরুম করতে হয়, রেকর্ডগুলো রাখার ঘর করতে হয়। এত নিয়ম কানুন মানতে গেলে তো প্রচুর খরচা হবে। এই সুযোগ নিয়ে অ্যাপেলোর মত ক্লিনিকগুলো গড়ে উঠলো। শোনা যায় Clinical Establishment Act চালু করার জন্য অ্যাপেলোরা নাকি সরকারকে অনেক টাকা ঘুষ দিয়েছিল। বাড়িতে, ওষুধ দোকানের পিছনে ডাক্তারদের চেম্বার ছিল। হয়তো রোগীরা ওই ওষুধের দোকান থেকেই ডাক্তার দেখিয়ে বেশিরভাগ সময় ওষুধ নিত। সরকার তা আটকাতে চাইলে সমস্ত বেসরকারি ওষুধের দোকানকে বন্ধ করে দিতে পারতো। তা কিন্তু সরকার করেনি। সরকারি ব্যবস্থায় আপামর জনগণকে সমস্ত ওষুধের সরবরাহ করতে পারত। ডাক্তারদের ঝাঁ-চকচকে ক্লিনিকে বসতে একপ্রকার বাধ্যই করা হলো। আর রোগী একটা মার্কেটিং-এর বিষয়ে পরিণত হলো।
বেশ কয়েকদিন আগে Justdial থেকে লোক এসেছিল আমার সাথে দেখা করতে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এখন আমি সপ্তাহে একদিন দশ জন রোগী দেখি, যাদের অন্য কোন উপায় নেই কেবল তারাই আমাকে দেখাবে। অনেক বেশি রোগী আমায় দেখাতে চাইছে অথচ আমি দেখতে পারছি না। আগে যেমন বর্ধমানে ট্রেন থেকে রোগীরা নামলে রিক্সাওয়ালা তাদের ঠিক করা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। পরিচিত ডাক্তারের চেম্বারে রোগীকে ঢুকিয়ে তার কাছ থেকে ১০ টাকা বা ৫০ টাকা নিত। এর বর্তমান রূপ Justdial. রোগী Justdial-এ সবচেয়ে ভালো ডাক্তার কে, তা সার্চ করছে। ডাক্তারের রেটিং দেখছে। Justdial আমাকে প্রপোজাল দিয়েছিল আমার রেটিং ৫ এ ৪.৯ করে দেবে। ৮০ জন রোগী আমার সম্বন্ধে যাতে ভালো ভালো কমেন্ট করে তারও ব্যবস্থা করে দেবে। তার বদলে আমাকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা দিতে হবে। তাদের বক্তব্য এই ৩০ হাজার টাকা লগ্নি করলে আমি বছরে এক লাখ টাকার ব্যবসা করতে পারব। প্রত্যুত্তরে আমি জানিয়েছিলাম যে আমার ব্যবসা করার ক্ষমতা নেই। তার থেকেও বড় কথা আপনারা এটা কি করছেন? সরকার চোখ বুজে সমাজকে এই ধরনের দালালের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। কেন আইন থাকবে না যে- কোন ডাক্তারের নাম এই ধরনের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া যাবে না। রোগী ডাক্তারকে সরাসরি না চিনে দালালের মাধ্যমে আসছে, এই দালাল কখনো ওয়েবসাইট হতে পারে বা কোন কর্পোরেট হাসপাতাল।
কিছু জেনারেল ফিজিশিয়ান তৈরি হয়েছিল, যারা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে রেফারের জন্য কমিশন নিতো। ধরা যাক একজন রোগীকে সার্জেনের কাছে রেফার করা হলো। সার্জেন রোগীর কাছে আশি হাজার টাকা নিলে, তার মধ্যে কুড়ি হাজার টাকা ওই জেনারেল ফিজিশিয়ান এর কমিশন। এই প্রক্রিয়ায় রোগীর বিশ্বাস ডাক্তারের উপর থাকবে? এই সিস্টেমগুলো সরকার কি পাল্টাতে পারে না!?
(অসুস্থতার সময় ডা দেবাশিস হালদার ও সৌম্য় চট্টোপাধ্যায়ের নেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রচিত। ডা মৃন্ময় বেরার সম্পাদনা।)
১২ই আগস্ট ২০২৩ সুব্রত গোস্বামীর স্মরণসভায় প্রকাশিত এম সি ডি এস এ-র পত্রিকা “আমাদের কথা”-এ প্রথম প্রকাশিত।
পরিণত ও বাস্তববোধসম্পনন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনায় ঋদ্ধ বক্তব্য।ব্যাপক প্রচার হওয়া দরকার।