যে কোনো ধরনের শল্যচিকিৎসার কথা উঠলেই মনে বিপদের আশঙ্কা জেগে ওঠে। বুকটা দুরুদুরু করতে থাকে। আর সেটা যদি কারো নিজের ক্ষেত্রে হয়- তাহলে তো কথাই নেই। অমনি নানা জটিলতার সম্ভাবনা মনে ভীড় করে আসে। রাতের ঘুম উড়ে যায়। দৈনন্দিন জীবন যায় ওলট-পালট হয়ে।
কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। কখনো কখনো শল্যচিকিৎসা বা সার্জিক্যাল অপারেশন একান্তই প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দেয়। পছন্দ-অপছন্দের উপর নির্ভর করে না। সার্জারি এড়ানোর কোনো উপায় থাকে না। তখন বাধ্য হয়ে সেই তেতো বড়িটা গিলতেই হয়।
এরপর যদি সেই সার্জারি মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র বা মেরুদন্ডে হয় তাহলে তো কথাই নেই। তখন ডাক্তার (সার্জেন)- এর পরামর্শ যেন নিদান হয়ে দেখা দেয়। রোগীর এবং তার পরিবারের মনে হয় যেন ভাগ্যবিপর্যয় বা নীল আকাশ থেকে বজ্রপাত হল।
মেরুদন্ডের অপারেশনের কথা শুনলেই আমরা সবাই ভয় পেয়ে যাই। ভয়টা অস্বাভাবিক নয়। কারণ মেরুদন্ডের আশেপাশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, টিস্যু, নার্ভ, স্পাইনাল কর্ড, রক্তনালী, শিরা-উপশিরা প্রভৃতি থাকে। যাদের অনেক গুলোই মানুষের বেঁচে থাকা এবং সুস্থভাবে চলাফেরার করার জন্য একেবারে অপরিহার্য। সামান্য একচুল এদিক-ওদিক হলেই জটিলতা। ঠিক যেন সরু বাঁশের সাঁকো বেয়ে কুমীর ভর্তি খাল পেরোনো। একবার পা পিছলেছে কি তক্ষুণি কুমীরের খাদ্য। তাই বলে কি মেরুদন্ডে, মস্তিষ্কে, হৃদযন্ত্রে শল্য চিকিৎসা হয় না ? হয়।
যেমন ধরুন, বিমান যাত্রা। গোটা বিমান যাত্রাই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে অবতরনের সময়কালটা খুবই জটিল ও বিপজ্জনক। একচুল এদিক-ওদিক হলেই শত-শত বিমানযাত্রী সহ বিমানটি মুহুর্তে ভস্মে পরিণত হতে পারে। অথচ প্রতিদিন সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার বিমান উঠছে এবং নামছে। কিন্তু প্রতিদিন কি দুর্ঘটনা ঘটছে? তা তো নয়। আবার এমনও নয় যে, বিমানযাত্রায় দুর্ঘটনা কোনোদিন কখনো ঘটেই নি। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যথাসম্ভব কড়া প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেন বিমান সংস্থা, নিয়ন্ত্রক মন্ত্রণালয় ও নিয়ামক এজেন্সী। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চমানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। কোনো রকম আপোষ করা হয় না। প্রতি উড়ানের আগে বিমানের বাধ্যতামূলক নিরীক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। পাইলট ও ক্রু-দের সর্বোচ্চ মানের প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। নিয়মিত তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়। তবেই উড়ানের অনুমতি মেলে। তাও উড্ডয়ন এবং অবতরণের সময় যাত্রীরা কানে আঙুল দিয়ে, নয়তো বিড়বিড় করে- কেউ মা-কালীর নাম জপে, কেউ আল্লাহ, কেউ যীশুখ্রীষ্টকে স্মরণ করে।
যাদের দরকার তারা বিমানে চড়ছে, দেশবিদেশে যাচ্ছে। মনে আশঙ্কা নিয়েই বিমানের পেটে বসে আকাশে উঠছে, নামছে। বিরল এক-দু’জন অবশ্য মরে যাওয়ার ভয়ে জীবনে বিমানে চড়েন না। প্রয়োজন থাকলেও না। তারা ট্রেনে যাতায়াত করেন। যেমন, উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন।
এখন কথা হল, বিমানযাত্রায় আশঙ্কা কি শুধু যাত্রীদেরই থাকে? পাইলট, ক্রু, বিমানসেবিকাদের আশঙ্কা থাকে না? বস্তুতঃ,গবেষণায় দেখা গেছে সমস্ত পেশার মধ্যে যুদ্ধবিমানের পাইলটদের দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ সবচেয়ে বেশী। বানিজ্যিক বিমানচালকরাও পিছিয়ে নেই।
এই তালিকায় উপরের দিকেই হয়তো আছেন সার্জেন ও অ্যানাস্থেটিষ্টরা। উচ্চমানের নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা, প্রশিক্ষন, উন্নত চিকিৎসাবিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এই চাপ ও জটিলতার ঝুঁকি অনেকাংশে কমায়। তাই বলে শল্যচিকিৎসা কি সম্পূর্ণ ঝুঁকিবিহীন হয়ে গেছে আজকাল? না, তা হয় নি। পুরোপুরি কোনোদিন হয়তো হবেও না। ঝুঁকি থাকবে- বিশেষতঃ মস্তিস্ক, হৃদযন্ত্র, মেরুদন্ড, লিভার, কিডনি, মূল ধমনী-শিরা এসবের শল্যচিকিৎসায় থাকবে বাড়তি ঝুঁকি। বয়স্ক, শিশু, হৃদরোগী, ডায়াবেটিসের রোগী, উচ্চ রক্তচাপের রোগী,অ্যাজমা, কিডনি, লিভারের রোগীদের কোনো কারনে অপারেশনের দরকার হলে বাড়তি ঝুঁকি থাকে।
কিন্তু অন্য কোনো উপায় না থাকলে উপযুক্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে, উপযোগী ব্যবস্থা আছে এমন হাসপাতালে, যোগ্য এবং অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রেও শল্যচিকিৎসা করা হয়। এমনকি মস্তিষ্ক, মেরুদন্ড এবং হৃদযন্ত্রের রোগের ক্ষেত্রেও একই পন্থা।
হাত গুটিয়ে বসে থেকে তিলে তিলে রোগীর অবস্থার অবনতি এবং ক্রমশঃ মৃত্যু বা পক্ষাঘাতগ্রস্ততা দেখার থেকে কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে অপারেশন করানোই ভালো। রোগী এবং তার ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজনরা চিকিৎসকের সাথে আলোচনা করে ঝুঁকি ও আশঙ্কার পরিমাপ বুঝে সম্মতি দিলে তবেই শল্যচিকিৎসা করা হয়।