বিংশ শতাব্দীর নয়ের দশকের প্রথমার্ধের কথা। রাঁচিতে মানসিক রোগ চিকিৎসার কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতালে কর্মরত কনিষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে একজন ছাত্রের কাছে রোগীর রোগেতিহাস শুনছিলাম। বছর বাইশের ছেলেটাকে নিয়ে এসেছে তার বাবা, কাকা, দাদা, খুড়তুতো ভাই, গ্রাম সম্পর্কে আরও চার পাঁচজন ষণ্ডামার্কা ভাই, কাকা, জ্যাঠা… সবাই চেম্বারে ভীড় করে গাদাগাদি দাঁড়িয়ে – সে কেবল রোগীর রোগ সম্বন্ধে জানার জন্য নয়, ছোটোখাটো প্যাংলা ছেলেটার গায়ে এমন অদম্য শক্তি, যে তাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে রাখতেই তিনজন পালোয়ান লাগছে এবং আর একজন তার মুখে একটা গামছা ধরে রেখেছে, যাতে অনবরত ছেটানো থুতু সামনে বসা সম্মানিত ডাক্তারের গায়ে না পড়ে। যেটা অবশ্য আটকানো যাচ্ছে না, তা হল গালাগালি…, না, খিস্তির ফোয়ারা। আগের দিন সকালে বিহারের কোন প্রত্যন্ত প্রান্ত থেকে ট্রেনে উঠে এই রোগীকে সামলে এতজন মিলে সারারাত ট্রেনে কাটিয়ে এসে পৌঁছেছে রাঁচিতে আজ ভোরবেলা।
এমতাবস্থায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ সেরে রোগীকে ভর্তি করে ইনজেকশন দিয়ে শান্ত করে ঘুম পাড়ানোই শ্রেয়ঃ, কিন্তু ইতিহাস শুনতে শুনতে ফ্যামিলি হিস্ট্রি অংশে এসে আমার শিক্ষকসত্ত্বা চাগাড় দিল। “নো সিগনিফিক্যান্ট ফ্যামিলি হিস্ট্রি” শুনে নড়েচড়ে বসে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, পরিবারে কারও কোনও রকম মানসিক রোগের ইতিহাস নেই?
ছাত্র কনফিডেন্টলি মাথা নেড়ে বলল, নো স্যার।
আমি রোগীর বাবার দিকে চেয়ে বললাম, খানদান মে কিসিকা অ্যায়সা বিমারি নেহি হ্যায়?
সে বলল, নেহি জী।
বললাম, কিসি কিসিম-কা মেন্টাল কা বিমারি?
আবার বলল, নেহি।
বললাম, আপ কা ফেমিলি মে নেহি, ইসকা নানীহাল মে…?
ছেলের মায়ের দিকের পরিবারের খোঁজে একটু বাবা অবাক হল, কিন্তু আপত্তির প্রকাশ না করে বলল, নেহি সাব।
বললাম, আপ কেয়া করতে হো?
খেতি বাড়ি করতা হুঁ।
জানি উত্তর কী হবে – গ্রামের মহিলা ঘরের কাজ করবে, মাঠের কাজ করবে, গরু দুইবে, জাবনা দেবে – তা-ও বললাম, ঔর ইসকা মা?
বাবা উত্তর দিল, ও তো ডেড কর গিয়া।
বিহার ছাড়া মৃত্যুর খবর এভাবে আর কোথাও শুনিনি। সদ্যমৃত হলে “ডেড হো গিয়া”, আর ও তো মরে গেছে-র হিন্দি ছিল “ও তো ডেড কর গিয়া।”
মৃত্যুর খবর পেয়ে জানতে চাইলাম, কেয়া বিমারি থা?
অবাক করা উত্তর এল, বিমার উমার নেহি থা। অ্যয়সে হি ডেড হো গিয়া।
এবারে ঘরে বসা অন্য ডাক্তাররা অবাক হয়ে বলল, অ্যয়সে কেউ মরে নাকি? অ্যাকসিডেন্ট হুয়া থা? খুদকুশি কিয়া থা?
সামনে বসা রোগীর অসুখ সম্পূর্ণ বুঝতে এ তথ্য জরুরি বইকি।
তখন যে খবরটা পেলাম তা এ রকম।
এই ছেলেটির মায়ের কোনও অসুখ ছিল না। কেবল কিছুদিন বাদে বাদে কথাবার্তা বন্ধ করে দিত, কোনও কাজ করত না, এবং চারপাইয়ের ওপরে শুয়ে থাকত। খেত না, চান করত না, বস্তুত কিছুই করত না। কেবল দু-চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। আবার কিছু দিন পরে সব ঠিক হয়ে যেত, উঠে কাজ-কর্ম করত।
বললাম, কতদিন এরকম চলত?
উত্তর এল, তা কখনও সাত দিন, কখনও পনেরো দিন, কখনও বা তিন সপ্তাহ।
তিন সপ্তাহ কিছু না খেয়ে থাকত? আপনারা কী করতেন?
ঘরের বউ-মেয়েরা কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করত – বেশিরভাগ সময়েই কিছু খাওয়ানো যেত না। তাই পরের দিকে আর…
কে জানতে চাইল, কিন্তু মারা গেলেন কী করে?
ওই তো, একবার ওরকম হল, চুপ করে শুয়ে থেকে থেকে, না-খেয়ে না-দেয়ে দুর্বল হয়ে গেল, একদিন সকালে দেখা গেল ওই চারপাইয়েই শরীর নিথর হয়ে গেছে।
ঘরে আলপিন-পড়া-স্তব্ধতা। আমি কোনও রকমে সামলে নিয়ে বললাম, কখনও ডাক্তার-টাক্তার দেখাননি? হাসপাতালে নিয়ে গেলে ওরা নস্-মে সুঁই দেকে খিলানে কা বন্দোবস্ত হো সকতা থা…
দেহাতি বিহারিরা কাঁধ ঝাঁকিয়ে দেহাতি সাহেবদের মতো শ্রাগ করে না, কিন্তু মুখে চোখে শ্রাগতুল্য ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তুলতে পারে। সেটাই দেখলাম।
ডাক্-সাব, দূর গাঁও মে কোথায় ডাক্তার, কোথায় হাসপাতাল? এই তো দেখুন না, এখানে এসে পৌঁছতেই কত সময় লাগল। ঘর কা ঔরত কে লিয়ে ইতনা করনা পুসাতা নেহি (পোষায় না)…
গত সপ্তাহে একজন মাঝবয়সী মহিলার জোয়ান ছেলের ব্যবস্থাপত্র লিখে দিলাম, মা ছেলের দিকে ফিরে বলল, তুই বাইরে যা, আমি ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দুটো কথা বলব।
ছেলে বলল, যা বলার আমার সামনেই বলো না…
মা ঝাঁঝিয়ে বলল, আঃ, তোর সম্বন্ধে না, আমার সম্বন্ধে… যা বলছি।
ছেলে মায়ের কথা বিশ্বাস করল না (আমিও করিনি) সন্দিহান দৃষ্টিনিক্ষেপ করতে করতে ঘর থেকে বেরোল, মা চেঁচিয়ে বলল, দরজাটা টেনে দে, বাইরে আড়ি পাতবি না, একেবারে বাইরের ঘরে গিয়ে বোস।
তারপর মা সন্দিহান চোখে বন্ধ দরজা নিরীক্ষণ শেষ করে বলল, ডাক্তারবাবু, আপনি আগের দিন জিগেস করছিলেন না, ফেমিলিতে কারও এমন আছে কি না… আমি সেদিন ওর বাবার সামনে বলিনি, ওর বাবার ফেমিলিতে অসুখ আছে। আমার স্বামীর দিদিমার থেকে ওদের মধ্যে এই অসুখ এসেছে। ওদের ফেমিলিতে আরও দুজনের অসুখের কথা আমি জানি। আমার ছেলের জ্যাঠতুতো দাদা আর পিসতুতো ভাই… ঠিক আমার ছেলের মতো।
বাবার দিদিমার থেকে অসুখ আসা আশ্চর্য নয়, এবং তাঁর কী সমস্যা ছিল এখন কেউ বলতেও পারবে না, তবু জিজ্ঞেস করলাম, আপনার স্বামীর দিদিমারও কি একই অসুখ ছিল?
মাথা নেড়ে বলল, না, দিদিমার ছিল না। দিদিমার দেওরের এই অসুখ ছিল। সেখান থেকেই এদের সবার মধ্যে ছড়িয়েছে।
আমি বললাম, মানে? দিদিমার দেওরের অসুখ ছিল? তা হলে দিদিমার থেকে অসুখ এসেছে বললেন কেন?
ততোধিক অবাক হয়ে বলল, তবে, না তো কী? দিদিমারই তো দেওর।
আমি বললাম, এ কথা আপনাকে কে বলেছে – যে দিদিমার দেওরের অসুখ ছিল?
কেন? আমি তো বিয়ে হয়ে থেকে শুনছি – দিদিমার থেকেই বংশে পাগলামি এসেছে। দিদিমার দেওরের অসুখ ছিল।
আবার চেষ্টা করলাম। দিদিমার দেওর আপনার স্বামীর দাদামশাইয়ের কে?
একটু ভাবতে হল। বলল, ভাই।
তাহলে আপনার স্বামীর দাদামশাইয়ের বংশ থেকে অসুখ এসেছে, তাই না?
তিনি মাথা নেড়ে বললেন, না। দিদিমার থেকে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এদিক ওদিক তাকাতাম। রাঁচি হলে আমার ‘শিক্ষকের কক্ষে’ আরও দু-চারজন ডাক্তার থাকত। তাদের কাউকে বলতাম, বোঝাও একে… কিন্তু এখানে আমি একা।
বললাম, দিদিমার দেওরের অসুখের দায় দিদিমার?
হ্যাঁ। ওনার থেকেই অসুখ এসেছে বংশে।
বললাম, ঠিক আছে, আমি ফাইলে লিখে রাখছি সে কথা। ছেলেকে ওষুধ খাওয়ান, তিন মাস পরে আসবেন। চিকিৎসায় গাফিলতি করবেন না। শ্বশুরবাড়ির কারও কথায় চিকিৎসা বন্ধ করবেন না। করলে ছেলের ক্ষতি হবে, তার দায় চাপবে আপনারই ঘাড়ে। আসুন।
ডাইনী দিদিমা বোঝাই যাচ্ছে। নইলে দেওরের অসুখ বংশে আসে!