সন্দেশখালি নিয়ে এই লেখাটা আগে লিখেছিলাম। আপনাদের পড়ানো হয়নি। মনে হলো, বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনাদের পড়ানো যায়।
বিশেষত এই সময়ে, যখন পাব্লিক ক্ষেপে উঠেছে এবং প্রশাসন/পুলিশ যারপরনাই বিচলিত ‘আইন-শৃঙখলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতিতে’ (অর্থাৎ শেখ শাহজাহানের আমলে যে চমৎকার শৃঙ্খলা ওখানে চালু ছিল, তা মায়ের ভোগে চলে যাওয়ায় পুলিশ-প্রশাসন ভারি চিন্তিত)। অর্থাৎ, যখন আমরা বুঝতে পারছি, যে, পুলিশ এবারে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামবেন (এবং সেই সুবাদে প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে কিছু মামলাটামলা এমন করে সাজাবেন, যাতে চট করে আর কেউ প্রতিবাদ করতে এগিয়ে এসে পুলিশের শীতঘুমে ব্যাঘাত ঘটানোর সাহস না পায়)।
তো যাক গে! লেখাটা এখানে রইল।
____________________
.
সন্দেশখালির ঘটনা বিষয়ে প্রায় সবাই জানেন। কেউ বিশদে জানেন, কেউ সংক্ষিপ্ত আকারে। কেউ কেউ হয়ত সে নিয়ে বিচলিত, আবার কেউ হয়ত দেশ ও রাজ্যের কোনও ঘটনাতেই আর নতুন করে অবাক বা বিচলিত হন না, আবার আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর মতো কেউ কেউ এ বিষয়ে ‘মন্তব্যে নারাজ’। তবে আমরা সকলেই জানি, এদেশে ‘আইন আইনের পথে চলবে’, তবে আইনের ক্ষেত্রেও শুধু ওই পথ চলাতেই আনন্দ ব্যাপারটা ভালো কিনা, এককথায় বলা মুশকিল। আবার দেশের বিবিধ তদন্তকারী সংস্থা, তাঁরা ব্রিগেডে জড়ো হয়ে গীতাপাঠ করেছিলেন বলে এখনও খবর নেই, কিন্তু তাঁরা যে গীতার ওই ‘কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মফলে নহে’ অংশটি একেবারে মর্মে মর্মে আত্মস্থ করতে সক্ষম হয়েছেন, এ নিয়ে তো তিলমাত্র সংশয়ের সুযোগ নেই – কেননা, তাঁদের ক্রিয়াকলাপ থেকে আমরা জানি, স্রেফ শোরগোলসহ তদন্তই তাঁদের মুখ্য কর্তব্য তথা কর্ম – সে কর্ম-ও আবার কর্তার ইচ্ছেয় – ফাইনাল রিপোর্ট বা চার্জশিট জমা দিয়ে ফল অবধি যাত্রায় তাঁদের রুচি নেই।
সুতরাং এই মায়াবী পরিবেশে অনুব্রত-শাহজাহানের মতো শত ফুল যে অবাধে বিকশিত হবেন, চিটিংবাজির দায়ে অভিযুক্ত আসামী সময়ে চার্জশিট জমা না পড়ায় জামিন পেয়ে অবাধে বাইরে ঘোরাঘুরি করবেন এবং বুক ফুলিয়ে রাজা-উজির মারবেন, উপরন্তু নীতিকথার বাণীও শোনাবেন, বিচারপতি আদালতের চেয়ারে বসে বা বাইরে মিডিয়ার উপস্থিতিতে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে আড্ডা দেওয়ার মতো করে আলটপকা মন্তব্য করবেন, মাঝেমধ্যে দলীয় কর্মী-সুলভ নরমগরম কথাবার্তা বলবেন, এবং জামিনে-মুক্ত চিটিংবাজির আসামী বিষয়ে কখনও আক্রমণাত্মক কখনও বা বন্ধুত্বমূলক মন্তব্য করবেন – আর আমরা টেনিস খেলার দর্শকের মতো একবার ডাইনে তো একবার বাঁয়ে দেখতে থাকব, একটি গেম শেষ হতে না হতেই প্রকৃতপ্রস্তাবেই ‘লাভ অল’ বলে খেলা আবার শুরু হয়ে যাবে, আর আমরা নিজেদের মধ্যে মাঝেমধ্যে বলাবলি করব, চাপা স্বরে, দেখেছ কী অবস্থা – এর বেশি আর হওয়ারই বা আছে কী!!
তবে হ্যাঁ, এর মধ্যে যেটা আশা জাগায়, তা হলো পুলিশের ভূমিকা। টুকটাক অভিযোগ না নেওয়া মারধর পিটিয়ে মারা তাড়া করে ছাদ থেকে ফেলে মেরে ফেলা জাতীয় ঘটনা বাদে পুলিশ মানুষের পাশেই থাকত – বেড়াল-কুকুর কোলে তুলে রাস্তা পার করিয়ে দেওয়াই হোক বা উৎসব-পার্বণে থানায় গান চালিয়ে নাচা ইত্যাদি সামাজিক ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে পুলিশ প্রকৃত মানবিক। তবু এতদিনে পুলিশ সত্যিসত্যি নিম্নবর্গের মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারল। নইলে, দেখুনই না, অফিসার গোত্রের লোকজন যখন মার খাচ্ছে, তখন পুলিশ ঘাপটি মেরে বসেছিল – কিন্তু বাড়ির গরীব কেয়ারটেকার যখন অভিযোগ জানাতে এলো, তখন পুলিশ লাফিয়ে পড়ে এফআইআর তো নিলই, উপরন্তু মার-খাওয়া অফিসারদের বিরুদ্ধে একেবারে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করে দিল। ব্যাপারটার সাব-অল্টার্ন ইয়ের দিকটা মহামান্য আদালত সেভাবে ধরতে পারলেন না, সে বড় পরিতাপের বিষয়।
এবং ইডি। ‘তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি’ এই রামপ্রসাদী তাঁদের গাড়িতে লুপে চলতে থাকে কিনা জানি না, কিন্তু এমত অনুভবের এমন বাস্তবায়ন বড় একটা দেখা যায় না। কেন্দ্রে ক্ষমতায় যাঁরা আছেন, তাঁদের হয়ে বিরোধীদের ধরা-ই যে ইডি-র কর্তব্য, এটা হয়ত ইতিমধ্যে তাঁদের সার্ভিস-রুলে ঢুকে গিয়েছে। অবশ্য বিরোধী যখন চালুনি, তখন ছূঁচের বিরুদ্ধে অভিযোগ অবান্তর। আবার যে রাজ্যে একটি অতিবৃহৎ আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্ত শুরু হতেই স্বয়ং পুলিশ-অধিনায়ক দায়িত্ব নিয়ে যাবতীয় প্রমাণাদি মেথডিকালি নষ্ট করার দায়িত্ব নেন, সেখানে ইডি-কে যে পুলিশের থেকে লুকিয়েই তদন্ত চালাতে হবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু যেহেতু তাঁরাও জানেন, যে, এ শুধুই তদন্ত-তদন্ত খেলা যার চূড়ান্ত রিপোর্ট বা চার্জশিট দেওয়াটা তাঁদের দায়িত্বের আওতায় আসে না, সুতরাং তাঁরা ‘গোপন অভিযান’-এ সঙ্গী হিসেবে নেন ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে, ‘গোপন অভিযান’ প্রকাশ্য করাটাই যাঁদের কাজ। অতএব, তদন্তের অভীষ্ট কী বলা মুশকিল – তবে নেট রেজাল্ট বলতে, আদালতে দোষী সাব্যস্ত করার চাইতেও, ‘নেমিং অ্যান্ড শেমিং’।
এমন পরিস্থিতিতে কি, তারপরও, সদর্থক কিছু নেই? আছে বইকি!! স্বয়ং শেখ শাহজাহান! সাচ্চা বাঘের বাচ্চা। মনে করুন বর্তমানে জেলবন্দী এক মন্ত্রীর কথা। নির্বাচন কমিশনের কাছে সম্পত্তির ঘোষণা করার সময় তিনি নিজের নামে যা যা ছিল, তার পাশাপাশি নিজের মেয়ের নামেও কয়েক কোটির সম্পত্তি দেখিয়েছিলেন। জানা গিয়েছিল, মেয়ে মাত্র বছরদেড়েকের মধ্যে স্রেফ প্রাইভেট টিউশনি করে ওই অঙ্ক উপার্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। অবশ্য এমন অলৌকিক গৃহশিক্ষকতা বিষয়ে সে সময়ে কেউই তদন্ত করতে আসেননি। কিন্তু সে যা-ই হোক, ওসব ছিঁচকেমো আপনি শেখ শাহজাহানের মধ্যে পাবেন না। ব্যাঙ্কে নগদ প্রায় দু’কোটি টাকার পাশাপাশি গাড়ি-বাড়ি-জমি-ইত্যাদি-প্রভৃতি মিলিয়ে কয়েক কোটির ঘোষিত সম্পদ – আয় বলতে কী একটা ব্যবসা, যাতে বার্ষিক লেনদেন কুড়ি লক্ষের কাছাকাছি (এই আয়ে অমন সম্পদ হওয়া সম্ভব কিনা, সে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এতদিন কেউই ভাবেননি, আমরাও আর ভাবছি না) – কিন্তু পুরোটা নিজের নামে! শেখ শাহজাহান যা করেন, বুক ফুলিয়ে নিজের নামে করেন – পরিজনকে সমস্যায় ফেলেন না। মহত্ত্ব ছাড়া আর কী!!
\তবে এতদিন ধরে জানা ছিল, নেতা-মন্ত্রীরা গুণ্ডা-বদমাইশ-চিটিংবাজ পোষেন, কিন্তু কাজ ফুরোলেই তাঁদের, টয়লেট পেপারের মতোই, পরিত্যাগ করেন। সে নিয়মের দিন বোধহয় ফুরলো। অনুব্রত জেলে, কিন্তু তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা বহাল তবিয়তে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। বিনয় মিশ্র কোথায় একটা দ্বীপ কিনে দিব্যি রেলায় আছেন, কিন্তু তাঁর নেতা আদালতে ঘুরছেন তদন্ত বন্ধ করানোর আশায়। মন্ত্রী জেলে, থুড়ি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে, আছেন, কিন্তু তাঁর স্নেহধন্য শেখ শাহজাহানের টিকির ডগা ছোঁয়া গেল না। অবশ্য রামগোপাল বর্মা-র ‘শিবা’ দেখলে এমন পরিণতি অতখানি বিস্ময়কর নয়। সেখানে নেতা (পরেশ রাওয়াল অভিনয় করেছিলেন) ভবানীকে (রঘুবরণ) ঝেড়ে ফেলতে পারেননি – গল্পটা নয়ের দশকের হলেও, এখনকার পরিস্থিতিতে বেশ মানানসই। সিনেমা প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ওই নব্বইয়ের আশেপাশেই তদানীন্তন বাংলা ছবির হাল নিয়ে কিছু বলতে বলার অনুরোধ আসায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় উত্তর দিয়েছিলেন – এখনকার বাংলা সিনেমার যা অবস্থা, তাতে কিছুই বলার নেই। তো, যদিও সন্দেশখালির ঘটনা নিয়েই লিখতে বসেছিলাম, কিন্তু, সন্দেশখালি নিয়ে কিছুই বলার নেই। সত্যি বলতে কী, বর্তমানে দেশ ও রাজ্যের অবস্থা – এবং এই দু’জায়গায় সরকার যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁদের নীতি (সব অর্থেই) – এই সবকিছু নিয়েই কিছুই বলার নেই।