দ্বিতীয়বার করোনায় ভুগলাম। মে-র পর ডিসেম্বর।। প্রথম চার পাঁচ দিন বেশ অসুস্থ ছিলাম। শ্বাসকষ্ট। মাথা ঘুরে পতন। অঘ্রাণতা (Anosmia), ক্ষুধাহীনতা, জ্বর ইত্যাদি। এখন ভালো আছি।। আগামী সপ্তাহে রণাঙ্গন (হাসপাতাল)-এ ফিরবো।
৩১ তারিখ রাত্রে অসুখের মধ্যে নীচের লেখাটি কলমজাত করি। বন্ধুরা পড়লে ভালো লাগবে।।
স্মৃতি সততই—
ছোটবেলায় খিদিরপুর ডক থেকে বছরের শেষ রাত্রে বারোটার জাহাজের ভোঁ শুনতে পেতাম। গভীর ভাবে ঘুমন্ত বাপি আর মা-এর মাঝখানে লেপের তলায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে। আমার চোখে ঘুম নেই, কখন সকাল হবে।
২৫ তারিখ রাত্রে সান্তা মোজার মতো থলির মধ্যে করে উপহার দিয়ে গেছে ঘরের দরজায়। মা বলত “ঘুমিয়ে পড়ো, নাহলে সান্তা ক্লজ আসবে না।” সকালে অপার বিস্ময় ও আনন্দ। ঝোলায় ছোট্ট খাতা, পেন, টর্চ, প্লাস্টিকের ব্যাডমিন্টন র্যাকেট আর কক বা ক্রিকেট ব্যাট, কেক, লজেন্স, ওয়াটার বোতল।।
এর মধ্যে আগের দিন বা সকালে বেশ কয়েকটা চেয়েছিলাম। সান্তা সব জানতে পারে। তিন বছরের বড় মামাতো দাদা ঠাট্টা করে বলেছিল “ওরে হাঁদারাম, পিসি পিসেই ওইসব রেখে দেয় তোদের জন্য।” বিশ্বাস করিনি।
মাকে জিজ্ঞেস করলাম। মুচকি হেসে বলল “কই না তো!” এই তো, প্রমাণ হয়ে গেল দাদাটা কী মিথ্যুক!!
এক তারিখের দেদার মজা। চিড়িয়াখানা। বাবুঘাট। জাদুঘর। ফ্লুরী, নাহুম ছোটবেলায় কখনো খাইনি। মধ্যবিত্ত পাড়ার মুদির দোকানের কেক। প্লাম, ফ্রুট ওসব বুঝতাম না। পাড়ায় ভালো কেক বানাতো কপিলা আশ্রম। সঙ্গে কমলালেবু। তাও দার্জিলিং, নাগপুর জানা ছিল না। কামড়ে কামড়ে পাটালি গুড়। ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লে নকুড়ের নতুন গুড়ের জলভরা।
ইডেনের সবুজ ঘাসে লাল বিদ্যুৎ। আম্মার (ঠাকুমার) ঘরে একটাই ফিলিপস-এর ভালভ সেট রেডিও। নব ঘোরালে আস্তে আস্তে ভিতরটা লাল হয়ে উঠত সকাল ১০ টায়। তারপর সেই মনমাতানো কলার্স টিউন। অজয় বসু, পুষ্পেন সরকার আর কমলদা। ক্রিকেটের টেকনিক থোড়াই বুঝতাম। শুধু ভীষণ দেশপ্রেমিক। ভারত যেন জেতে। “ভারত জিতছে না হারছে রে”– মা মাঝে মাঝেই জেনে যেত।
সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন পতৌদি, দুরানী, জয়সীমা, বিশ্বনাথ, সোলকার, আবিদ আলী, ইঞ্জিনিয়ার আর হ্যাঁ এক জাদুকর। চন্দ্রশেখর। মতি নন্দী পরের দিন আনন্দবাজারে লিখতেন “পায়রার খাঁচায় (ইংল্যান্ড ব্যাটিং) বেড়াল ঢুকে পড়েছে,” চন্দ্রের বোলিং নিয়ে! বঙ্গলিপি খাতা ভরে উঠতো নায়কদের খবর কাগজ কাটা ছবিতে।
ট্রিনকাসে বর্ষ বরণ ছিল না, ব্লাডি মেরি, রোস্টেড ডাক, মাস্ক ডান্স ছিলো না। রাত্রের পার্ক স্ট্রিট, বো ব্যারাক-এ কখনও যাই নি, কেউ নিয়ে যায়নি। অতি সাধারণ, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। কিন্তু যা পেয়েছি, যা দেখেছি তুলনা তার নাই।
তারপর শহরটা পাল্টে গেছে, বিশ্বায়িত হয়েছে, আমি পাল্টে গেছি চিরতরে। যাঁরা পৃথিবীতে এনেছিলেন, তাঁরা নেই। দেওয়াল থেকে শুকনো মালা গলায় দিয়ে তাকিয়ে আছেন সারি সারি। হাসিমুখে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার লোক দুই আঙুলে গোনা যায়। আমারও দেওয়ালে ঝোলার সময় হয়ে গেল যে।
পর্ণমোচী গাছের মতো মানুষের শৈশব, কৈশোর তো ফিরে আসে না আর একবার। এ সব কী তবে গত জন্মের স্মৃতি? এ জীবনে এসব কিছুই ঘটে নি?
বাপি মা-র আদরের মুন্না, বাবুসোনা, বন্ধুদের প্রিয় সিদ্ধার্থ— তুমি কেন এতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলে?