আপনার বা আমাদের সবার মস্তিষ্ক কি ঠিকঠাক কাজ করে সবসময়? উত্তরটা হ্যাঁ বা না যাই হোক না কেন তার ব্যাখ্যা কিন্তু একটাই।
আমাদের সবার ভিতরেই একটা পাগল বাস করে। আর সবার পরিবারেই কিছু না কিছু মানুষ থাকেন, যাদের মাথায় গন্ডগোল খুঁজে পাই আমরা, যারা কিনা নিজেদের স্বাভাবিক বলে জাহির করি।
আমাদের বাড়িতে আমার জ্যাঠা ছিলেন সেইরকমই একজন লোক। তরুণ বয়সের চাকুরিজীবী জ্যাঠামশাইকে নাকি সিলেটে থাকাকালীন, তার বন্ধু স্থানীয় কিছু লোক যত্ন করে কিছু একটা ‘ওষুধ’ খাবারে মিশিয়ে দেয়। সেই থেকেই যারে সিলেটি ভাষায় কয় ‘মাথার দুষ’, তাই হয়ে যায় ভদ্রলোকের।
যবে থেকে আমার জ্ঞানচক্ষু খুলেছে আর চারপাশের ঘটনাগুলিকে অনুধাবন করতে শুরু করেছি, তবে থেকেই দেখেছি জ্যাঠামশাই খুব প্রয়োজন না হলে তাঁর নিজের ঘর থেকে বাইরে বেরোতে চান না। আর ছাদের ওপরের সেই চিলতে ঘরে বসেই নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত উনি কথা বলে চলেন। সবাই বলে সেটাই নাকি উনার রোগ। তবে এই সংলাপ পর্বের মধ্যে যদি আমাদের মত অর্বাচীনেরা এসে আচমকা বাধা দেয় এটা সেটা বলে, তৎক্ষণাৎ উনি কিন্তু স্বাভাবিক হয়ে যান।
সেটা জেনেই কোন কোন দিন এই কথকতার বাড়াবাড়ি হতে শুরু করলে, আমার মা ছাদের ঠাকুর ঘরে পুজো করতে করতে গলা উঁচু করে বলতেন, “ধনদা, হাইকোর্ট শ্যাষ হইসে নি?” আর মুহূর্তেই স্বাভাবিক হয়ে যেতেন জ্যাঠামশাই।
আমিও বুঝে গিয়েছিলাম সেটা। ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে যখন দেখতাম ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে জ্যাঠামশাই নিজের সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন, তখন এক ফাঁকে উনার পাঞ্জাবীর খুঁট টেনে বলতাম “ও জ্যাঠা, কি এত কও?” বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই চুপ করে যেতেন উনি।
জীবনে কোনদিন পয়সা রোজগার করার মত কোন কাজ না করলেও বাড়ির টুকটাক দোকান বাজার থেকে শুরু করে আমাদের ভাইবোনদের স্কুল থেকে নিয়ে আসা বা স্কুল বাসে তুলে দেওয়া সব কাজই করতে পারতেন ঠিকঠাক। হিসেবেও ভুল হতো না কখনোই।
সালটা ঠিক মনে নেই এখন। খুব সম্ভবত আশির দশকের শেষ দিক। বিধানসভা নির্বাচন এসেছে। আমরা যখন তরুণ তুর্কি, বামপন্থায় হাত পাকাচ্ছি ধীরে ধীরে। ভোটে বালিগঞ্জ বিধানসভায় আমাদের ক্যান্ডিডেট পুরনো এমএলএ শচীন সেন। আমাদের বাড়ি তখন যাকে বলে কট্টর কংগ্রেসী। কিন্তু জ্যাঠার ভোটটি ছিল পার্টির হিসেব মতো ‘ফ্লোটিং’। সেটাকে আমাদের খাতায় নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে বেশ কিছুদিন ধরে জ্যাঠাকে আমি তাঁর প্রিয় লাল সুতোর বিড়ি সাপ্লাই করতাম। আর দিয়ে বলতাম “এবারে আমাদের ক্যান্ডিডেট আর তোমার নাম কিন্তু এক। উনি শচীন সেন আর তুমি শচীন গুপ্ত। দেখে শুনে ভোট দেবে।”
ভোটের প্রচার আর কি! হুইসপারিং ক্যাম্পেন?।
ভোট দেবার দিনও উনাকে একেবারে সাথে নিয়ে পোলিং বুথে পৌঁছে দিয়েছিলাম। সারাদিন পর ভোট মিটলে বাড়ি ফিরে এলাম।
মা জিজ্ঞাসা করলেন, “তর জ্যাঠা কারে ভুট দিল? কইসে নি?” আমি বুঝতে পারলাম আমার সব ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়ে, জ্যাঠা কংগ্রেসকেই ভোট দিয়েছে। মায়ের কথামতো। এখন বুঝি সেটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। আমার মা সারা জীবন তাঁর পাগল ভাসুরকে দেখাশোনা করেছেন। তাঁর নির্দেশ অমান্য করে আদরের ভাইপোর অনুরোধ রাখা জ্যাঠার পক্ষে সম্ভব ছিল না কখনোই। তারপর থেকে আমি জ্যাঠাকে আর কোনদিন ভোট দেওয়ার কথা বলিনি।
__________________________________________
সব এলাকায় যেমন একটা না একটা পাগল থাকে আমাদের পাড়াতেও তার কোন অভাব পড়ে নি কোনদিন। একজন চলে গেলে তার জায়গা নিতে অন্যজন চলে আসতো ঠিক।
আমরা যখন বেদিয়াডাঙার পালবাড়ির রোয়াকে বসতে শুরু করেছি নিয়ম করে তখন পায়জামা আর শার্ট পরা উদাসী চেহারার একটি লোক প্রায়ই ঘুরে বেড়াতো উদ্দেশ্যহীন ভাবে। পাড়ার ছেলেরা ওকে ডাকতো ‘মোঙলা’ বলে। শার্টের বোতাম লাগানো থাকলে সেদিন নিপাট ভদ্রলোক। বুকের বোতাম দুটো খোলা মানে আজ বিগড়ে গেছে ‘উপরতলা’।
একদিন আমি কলেজফেরৎ সিগারেট ধরাচ্ছি লক্ষীদার পানের দোকানের পাশে ঝুলন্ত দড়ির আগুনে, হঠাৎ একটা প্রশ্ন ভেসে এলো পিছন থেকে। “রাশিয়া কিভাবে যাওয়া যায় কোন ধারণা আছে কি?” ভরদুপুরে এমন একটা প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গেলাম আমি।
আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই উত্তরটা দিয়ে দিলো প্রশ্নকর্তা মোঙলা। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললে,”বলতে পারলে না তো! বেশি পড়াশোনা করলে কমন সেন্স কমে যায়! হাঁটতে হাঁটতে সোজা ঢুকে পরো মোড়ের মাথার ওই ল্যাম্পপোস্টের মধ্যে, লোকাল ট্রেন ধরে ঝুলতে ঝুলতে সোনারপুর আর হাবরা হয়ে চলে যাবে মস্কো।”
মোঙলার এই বক্তব্য কিন্তু ‘হ্যারি পটার’-পূর্ব যুগের। রাউলিঙের তখনো লেখা হয়নি, যে দেওয়াল সরে গিয়ে কিংস ক্রশ স্টেশনে পৌঁছে, ধরা যায় হগওয়ার্টস এক্সপ্রেস। যা অনেকদিন আগে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় বলে দিয়ে গিয়েছিল মোঙলা।
সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন ছিল বামপন্থার পীঠস্থান। কলকাতার রোয়াকে ঝড় উঠতো স্ট্যালিন, লেনিন, কিউবা আর ভিয়েতনাম নিয়ে। তাই রাশিয়া ছিল সেইসময় ভবঘুরে মোঙলার কাছে ‘অটোমেটিক চয়েস।’
আমি হতভম্ব হয়ে মোঙলার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলাম। মোঙলা গম্ভীরমুখে তার নিভে যাওয়া আধপোড়া বিড়িটা আবার ধরিয়ে নিয়ে টান মারতে মারতে চলে গেল।
আমি লক্ষ্য করলাম আজ ওর শার্টের উপরের বোতাম দুটো খোলা।