গিয়ারটা রিভার্সে না পড়ে পাশের খাপে পড়েছিল। অ্যাক্সিলারেটরেও পা পড়ে গেছে। পাহাড়ি ঘূর্ণিপথ। পেছনে সরে আসার বদলে, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দেখলাম, বিদ্যুৎবেগে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আমার গাড়ি। সামনে গভীর খাদ। অনেক নিচে জলঢাকা নদী রিমঝিম আওয়াজ করে পাথর, টিলা টপকে ছুটে নেমে যাচ্ছে সমতলের দিকে। পাশে ড্রাইভার তামাংদাজু নির্বিকার মুখে বসে আছে। পথের ধারের ঝোপঝাড় পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা – নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। আমরা? নাকি শুধু আমি? দত্তসাহেবের কথা মনে পড়ে গেল।
ট্রান্সফার হয়ে আসার পর প্রায় একবছর হয়ে গেছে জলঢাকায়। যথারীতি দুর্বোধ্য কারণে কিছু অফিসারের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছি। আরো একজন চিকিৎসক এখানে পোস্টেড। তিনি কেন আমার ওপর খাপ্পা তাও বোঝা দায়। আমার এন্ট্রান্স পরীক্ষাগুলোর আগে আগে তাঁর কলকাতার বাড়িতে জরুরি কাজ পড়ে যায়। অল ইন্ডিয়া এন্ট্রান্স দিতে যেতে পারিনি। দাঁতে দাঁত চেপে পড়াশোনা করছি। একটা মাঠের ধারে আমার কোয়ার্টার। কাঠের বাড়ি। শীতের সময় কাঠের ফাঁকগুলো দিয়ে কি করে যেন ঠান্ডা গুঁড়িশুঁড়ি মেরে ঢুকে আসে। ঘরে রাখা থার্মোমিটার জানান দেয় তাপমাত্রা চার ডিগ্রি। হ্যারিসন, লাভবেলির টেক্সটবুকে ঢুকে পড়েও উষ্ণতা আসেনা। রুমহিটার বেচারি নিজেই ঠকঠক করে কাঁপছে। আমি বই দেখে দেখে ফ্লো-চার্ট লিখে দেওয়ালে আটকাই। একটু একটু করে কাঠের ফাঁক দিয়ে হাওয়া আসা বন্ধ হয়ে আসে। শীতও নিজের নিয়মে বিদায় নেয়। আমার দেওয়াল লিখন রয়ে যায়। আমি প্রতিদিন সকালবেলায় ব্রাশ করতে করতে সেগুলো পড়তাম। সংখ্যায় সেগুলো এতো হয়ে গিয়েছিল যে আমার ব্রাশ করা শেষ করতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগতো। কাজের মহিলা এসে বলতো “দাদাগো, এবার দাঁতগুলো ঘষা খেয়ে খুলে পড়ে যাবে।” আমি হাসতাম,- “যতো দিন যাচ্ছে ততোই এমসিকিউগুলোয় দাঁত ফোটানো শক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই দাঁতগুলো শার্প করে রাখছি।” আমার রসিকতায় সেই দিদি ‘সব বুঝেছি’ মার্কা হাসি দিতো।
এরমধ্যে একদিন প্রজেক্ট চিফ দত্তসাহেবের তুমুল জ্বর। অফিস ফেরতা মেডিক্যাল ইউনিট ঘুরে গেলেন। আমার ডিউটি ছিল। ফ্যারিঞ্জিয়াল ওয়াল ভয়ানক ইনফ্লেমড্। চেস্ট ক্লিয়ার। যা যা ওষুধ এবং উপদেশ দেওয়ার দিয়ে তাঁকে রেস্ট নিতে বললাম। রাতে আমার কলিগ ডাক্তারবাবু দত্তসাহেবের কোয়ার্টারে গেলেন। উনি আমার ডায়াগনোসিস নিয়ে বেশ সন্দিহান। চিকিৎসা নিয়েও অখুশি। সবথেকে মারাত্মক ব্যাপার, তিনি সিমস নামের একটি ওষুধের নাম সম্বলিত বইয়ের পাতা খুলে দেখিয়ে দিলেন আমার ওষুধ খেলে কি কি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। দত্তসাহেব সমস্ত কিছু মন দিয়ে দেখে শয্যা নিলেন। প্রায় কেঁদে ফেলে জানালেন খান দুয়েক ডোজ পেটে পড়ে গেছে। ঘটঘট করে মাথা নেড়ে আমার কলিগ জানালেন সব ওষুধ বন্ধ করতে হবে, পরের দিন রক্ত পরীক্ষা করে তিনি ঠিকঠাক ওষুধ দেবেন। দত্তসাহেব আর অপেক্ষা করেননি, পরদিন কাকভোরে তাঁর গাড়ি ছুটলো মালবাজার। প্রজেক্ট জুড়ে সবাই আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে – আমি যেন অমরিশ পুরি, কাদের খান, শক্তি কাপুর, ইত্যাদি সমস্ত নামজাদা ভিলেনদের কম্বোপ্যাক। একে তামাং নামের সেই ড্রাইভারের সাথে মজা করাটা অনেকে ভালোভাবে নেয়নি। জলঢাকা ঢোকার আধঘন্টা আগে তাকে জানিয়েছিলাম আমিই তার ডাক্তারসাহেব। সে বেচারি ভয়ে আর জলঢাকায় ঢুকতেই চাইছিল না। শেষ পর্যন্ত কথা দিয়েছিলাম আমি আর সে ছাড়া ঘটনাটা কেউ জানবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সে নিজেই পরের দিন মদ খেয়ে তার কৃতকর্মের জন্য খোদ প্রজেক্ট চিফের কাছে ক্ষমা চেয়ে এসেছিলো। অবশ্য তামাং-এর সহকর্মীরা ঈষৎ ঠোঁট উল্টে বলেছিল -“এসব তো হয়েই থাকে।”
সে যাকগে, আমার পিতৃদেবের সৌভাগ্য, মালবাজারের সেই ডাক্তারবাবু মৃদু হেসে সিমস খুলে দত্তসাহেবকে দেখিয়েছেন যে সমস্ত ওষুধেরই অল্পবিস্তর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। আর আমার দিক থেকে আরো সৌভাগ্যের ব্যাপার যে তিনি আমার দেওয়া ওষুধগুলো চালিয়ে যেতে বলেছেন।
এরপর থেকে দত্তসাহেব সন্ধ্যার দিকে প্রায়শই আমাকে চা খাওয়ার জন্য ডেকে পাঠাতেন। সেখানে একদিন গল্পের ছলে আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে আমি যেন তামাংকে এড়িয়ে চলি। এরা নাকি খুব প্রতিহিংসাপরায়ণ। এমন হতে পারে গাড়ি খাদে ফেলে দিয়ে খুনও করতে পারে। শেষ মুহূর্তে নিজেরা গাড়ি থেকে লাফ মেরে বেঁচে যাবে। তামাংকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু আমার কপালটায় না সেলাই দেওয়া একটা ফাটল আছে। তামাংদাজুর বাবা এক রাতদুপুরে প্রস্রাব আটকে হাজির। অন্য ডাক্তার ছুটিতে, অগত্যা আমার কাছে আসতে হয়েছে। তার আগে আমার ফার্মাসিস্ট একটু খোঁচাখুঁচি করেছেন। ফলে একটা তুমুল সম্ভাবনা ছিল ক্যাথেটার না ঢোকার। অনেকটা লিগনোকেন জেলি ও প্রস্টাটিক ম্যাসেজ দেওয়ায় সে যাত্রায় কোনো অশান্তি ছাড়াই ক্যাথেটার ঢোকানো গিয়েছিল। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমার তখনকার ড্রাইভার মোক্তানের সাথে নিজের ডিউটি চেঞ্জ করে নিলো তামাং। এমনিতে হাসপাতালের ডিউটিতে কোনো উপরি নেই বলে কোনো ড্রাইভার এই ডিউটি নিতে চায় না। মোক্তান তো ভীষণ খুশি। অস্বীকার করবো না, প্রথম প্রথম তামাংকে ভয়ই পেতাম। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ভয়ের ওপর একটা স্নেহ, ভালবাসার আস্তরণ পড়ে যাচ্ছিল। প্রায়ই তামাং বউজু( দাজু মানে দাদা আর বউজু মানে বৌদি) এই একলা, অল্পবয়সী ডাক্তারটির জন্য চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় পাঠিয়ে দিতেন। আর কে না জানে, বাঙালীদের হৃদয়টা পেটের কাছাকাছি থাকে। ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেলো তামাং আমার অলিখিত পিএ হয়ে গেছে। এমনকি ছুটির পর আমাকে টুকটুক করে ড্রাইভিংটাও শিখিয়ে দিতে লাগলো। একদিন তামাংকে পাশে বসিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে মালবাজারও গেলাম। দাজু অবশ্য পাহাড়ের ওপর আমাকে গাড়ি ছাড়তো না।
সমতলে তো সবাই গাড়ি চালাতে পারে। একদিন গোঁ ধরলাম পাহাড়ে চালাবো। পাশে তামাংদাজু থাকলে ভয় কিসের? শুনে মৃদু হেসেছিল তামাং। প্যারেন থেকে ঝালং নামার সময় একরকম জোর করে ড্রাইভিং সিটে বসেছিলাম। বাঁকের মুখ থেকে গাড়িটা সরিয়ে আনতে গিয়েই বিপত্তি। তুমুল বেগে গাড়ি ছুটে গেল খাদের দিকে।
প্রথমেই মায়ের মুখ মনে পড়ে গেল। অনেক দূরে আমার আধাশহর দেশের বাড়িতে হয়তো আমার জন্য সোয়েটার বুনছে মা। বগনভেলিয়া গাছটা হয়তো বাড়ির ছেলে ঘরে ফেরার অপেক্ষায় গেটে ঠেসান দিয়ে বাতাসে একটু করে ভালবাসার অক্সিজেন মিশিয়ে দিচ্ছিল। নীল আকাশ মানানসই হওয়ার জন্য নিজের গায়ে একটু সাদা মেঘ আটকে নিচ্ছিল। পৃথিবীর অল্প ওই অংশটুকু একান্তভাবে আমার। জীবিত বা মৃত, সব অবস্থাতেই আমার ফেরার জন্য কোল পেতে দাঁড়িয়ে আছে সে। কান্না পায়না, নির্ভার লাগে। অনুভূতি থেকে আতঙ্ক মুছে যায়। কোলে ঝাঁপ দিই আমি।
তবে সে যাত্রায় মরা হলনা। তামাংদাজু প্রায় আমার কোলের ওপর দিয়ে পা বাড়িয়ে ব্রেক কষে দেয়। অদ্ভুত অ্যাক্রোব্যাটিক দখ্যতায় হ্যান্ডব্রেকও টেনে ধরে।
নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র অমান্য করে প্রায় মহাশূন্যে দুলতে থাকে আমাদের গাড়িটা।
আপনি বিপজ্জনকভাবে লেখা থামিয়েছেন । ধন্যবাদ ।
ধন্যবাদ❤
কি চিন্তায় ফেলেছিলেন বলেন তো, গল্পটা(ঘটনাটা)খুব টেনশনের, যাইহোক ভগবান সবসময় আপনার সাথে আছে আর আমরাও(আমারা যারা আপনার গল্পের পাঠক) , খুব ভালো হয়েছে লেখাটা, আবার নতুন গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম ?।
গল্পগুলো একসময় ঘটনা ছিল। লেখার স্বার্থে ঘটনার গায়ে কিছুটা কল্পনার রঙ মিশিয়েছি। আসলে আমাদের জীবন বোধহয় রোজ ঘটে যাওয়া গল্পের মালা।
ভালো থেকো।
☺
লেখা তো বাস্তবের সাথে কল্পনার anastomosis. You have very eloquently pen down your practical experiences with your imaginations n emotion. Well done ????❤❤
মারাত্মক লেখার হাত তো মশায় আপ্নার ! আপ্নাকে তো কাল্টিভেট কর্তে হচ্চে