শতকরা পঁচানব্বই ভাগ বাঙালিই দুর্গাপুজোর ঐ চারটে দিনের (মতান্তরে দশদিনের) চাইতে ‘পুজো আসছে, পুজো আসছে’ এই ব্যাপারটাই উপভোগ করে বেশি।
গলদঘর্ম হয়ে মার্কেটিং, লাস্ট মোমেন্টের অ্যাকসেসরিজ, জুতো, সেজমাসিশাশুড়ির পুজোর নমস্কারিটি কেনা, বাইরে বেড়াতে যাওয়ার itinerary, ট্রেনের টিকিট, অনলাইনে পঞ্চাশটা সাইট ঘেঁটে, মাথাফাথা ধরিয়ে হোটেল বুকিং, বাড়িতেই থাকলে পুজোর ক’দিনের খাওয়াদাওয়ার প্ল্যান, ঘোরাঘুরির রুটিন ঠিক করা, অফিসে ছুটিছাটাগুলো ঠিকঠাক ম্যানেজ করা (সকলেই তো আর নাকের বদলে নরুন পাওয়া পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী নয়, যে পুজোর মাসে ক্যালেন্ডারের তারিখের রঙ দেখে ‘মায়ের পায়ের জবার মতো’ মনটি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে), পুজোর দিনগুলো ‘ডোমেস্টিক হেলপ’দের ছুটির কারণে মধ্যবিত্ত ঘরণীদের ‘মাল্টিটাস্কিং’-এর মানচিত্র প্রস্তুত করা, পুজো উদ্যোক্তাদের মান আর ‘মানি’র টানাপোড়েনে নানা ‘পুরস্কারশ্রীর’ প্রলোভনে নিত্য মাথার চুল ছিঁড়ে টাক ফেলার জোগাড় হওয়া, ছেলেপুলেদের পাঠ্য বইপত্র শিকেয় তুলে পূজাবার্ষিকীগুলোর গন্ধ শোঁকা (সব নয় যদিও, নামজাদা শারদীয় পত্রিকা এখন বর্ষাবার্ষিকীতে রূপান্তরিত), প্রবাসী তথা হোস্টেলবাসীদের বাড়ি ফেরার টান — সব মিলিয়ে ‘পুজো আসছে’ ভাবটা অল্পবিস্তর সকলেরই মনে ভালরকম দোলা দিয়ে যায়।
পুজো নিয়ে আমার যথেষ্ট আদিখ্যেতা এবং ব্যক্তিগত উন্মাদনা থাকলেও গত কয়েক বছর আমার গৃহপরিস্থিতি আমাকে এতখানি আত্মহারা হওয়ার সুযোগ দেয়নি। এই বছর তো মা জুলাই মাস থেকেই শয্যাশায়ী। তাই নমো নমো করে নামকাওয়াস্তে পুজোর বাজারটুকু সেরেই আমার প্রাক পূজা সেলিব্রেশন শেষ হয়ে গিয়েছিল। কর্মক্ষেত্রেও গতানুগতিক ‘পূজা রোস্টারে’ বাঁধাধরা ডিউটি রেখেছিলাম — আমার তো সপ্তমী অষ্টমী নবমী দশমী সবই সমান — আলাদা করে কিছু প্রোগ্রামের অবকাশ তো নেই সেখানে। অতএব সেই একঘেয়েমি ভরা দিনগত পাপক্ষয়। আমার আবার উৎসব কিসের? তা, আবহাওয়ার দেবতা এবারে আমার সহমর্মী হয়ে যোগ্য সঙ্গত করছিলেন এই নিরাশাভরা যাপনের। বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টি। ভরা আশ্বিনেও ঠিকানাহীন মেঘগুলো অনবরত জল ঝরিয়ে ঝরিয়ে আমার মতোই ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছিল।
বিশ্বকর্মা পুজোর হপ্তাখানেক পরে মায়ের শরীর বাড়াবাড়ি রকমের খারাপ হলো। ভর্তি হলো হাসপাতালে।
যেদিন মা ভর্তি হলো, দিতে হলো ভেন্টিলেটরে, তার পরের দিন সন্ধেবেলা শুকনো মুখে হাসপাতালের পেশেন্ট পার্টি এনক্লোজারে বসে ছিলাম ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলব বলে। এমন সময় মোবাইলে অচেনা নম্বর থেকে একটা ফোন এলো। ওপারে এক বয়স্ক মহিলাকন্ঠ, একটু উদ্বিগ্ন —- “সুকন্যা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন?”
“বলছি। কে বলছেন?”
“আপনার তো ট্রান্সফার হয়ে গেছে — স্বাস্থ্যভবন থেকে — ডিমড টু বি রিলিজড — আপনাকে আপনার ডিপার্টমেন্ট থেকে কেউ জানায়নি?”
হঠাৎ কেউ প্রবল ধাক্কা মেরে গভীর খাদে ফেলে দিলে ঠিক কেমন লাগে, এতদিন জানিনি নিজে, পড়েছি আলঙ্কারিক ভাষায় — সেই এক মুহূর্তে মর্মে মর্মে বুঝে গেলাম। বিধাতা আমার শান্ত, নিরুপদ্রব, ঘটনাবিহীন দুনিয়াটাকে একটা মুড়ির টিনের মধ্যে পুরে ঝাঁকিয়ে দিলেন কষে।
শহরজুড়ে ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গির চোখরাঙানির পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা পুরসভা পরিচালিত খিদিরপুর আরবান কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে আমার পোস্টিং হলো বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের আরো কয়েকজন সিনিয়র চিকিৎসকের সঙ্গে।
পরের কয়েকদিন কাটল কাজে আপৎকালীন যোগদান আর নিজের পারিবারিক অবস্থার বিশদ বিবরণ দিয়ে ছুটির দরখাস্ত করে তা মঞ্জুর করানোর জন্য দৌড়োদৌড়িতে।
এরই মধ্যে চলছিল হাসপাতালে ছোটাছুটি — উৎকন্ঠার পালে লেগেছিল হতাশার হাওয়া, মায়ের অবস্থার অবনতি হচ্ছিল উত্তরোত্তর।
আমার কাজের ছুটি মঞ্জুর হলো বটে, কিন্তু মা আমার চিরতরে ছুটি নিয়ে চলে গেল অনন্তযাত্রায়। তারিখটা অক্টোবরের ছয়, শুক্রবার।
মহালয়ার পরের দিন ঘাটকাজ মিটল। আর আশ্বিনের দ্বিতীয়া তিথিতে মিটে গেল শ্রাদ্ধশান্তি। এইবার তো খুকুর অখন্ড অবসর। আর ছুটি বাড়িয়ে করব কি? তাই, দেরি না করে গুটিগুটি রওনা দিলাম নতুন কর্মক্ষেত্রে। পিছনে পড়ে রইল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ব্লাডব্যাঙ্কের ষোলো বছরের কর্মজীবনের স্মৃতির ঝাঁপি। এক ঝটকায় ঈশ্বর একই সঙ্গে কেড়ে নিলেন জন্মদাত্রীকে আর জন্মস্থানের পুণ্যভূমিতে কাজ করার আনন্দটুকু।
খিদিরপুরের হাসপাতালটি ছোট, ছিমছাম। মূলত ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড বা অন্যান্য সংক্রমণজনিত জ্বরজারি বা পাতলা পায়খানা, বমি ইত্যাদির চিকিৎসা হয় এখানে। রোগী সংকটজনক হলে প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু করে পাঠিয়ে দিতে হয় নিকটবর্তী ‘বড় হাসপাতালে’। পুলকিতচিত্তে জানতে পারলাম স্ত্রীরোগের চিকিৎসা এখানে হয় না, তার জন্য কাছেই পুরসভার অন্য হাসপাতাল রয়েছে। এখানে ষোলো বছরের নিচে কোনো রোগীকে ভর্তিরও নিয়ম নেই — একেবারে স্ট্রিক্টলি ‘প্রাপ্তে তু ষোড়শ বর্ষে’ কেস — অ্যাডাল্ট নইলে হেথায় প্রবেশ নিষেধ।
আমার ডিউটি সাব্যস্ত হলো জেনারেল ইমার্জেন্সিতে। মেডিক্যাল অফিসার ইনচার্জটি অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি — তাঁকে জানালাম, যে ষোলো বছর ব্লাড ব্যাঙ্কে কাজ করেছি, সরাসরি পেশেন্ট হ্যান্ডল করার ন্যূনতম সম্ভাবনাও সেখানে ছিল না। ইমার্জেন্সিতে কাটা ছেঁড়া, স্যালাইন চালানো দরকার এমন রোগী তো এন্তার আসবে, করবটা কি?
উনি সহাস্যে সান্ত্বনা দিলেন — আরে ডাক্তারি হচ্ছে সাঁতার আর সাইকেল চালানোর মতো, একবার শিখলে কেউ ভোলে না, বুঝলেন?
আমার ঝট করে মন্দার বোসকে মনে পড়ে গেল।
ছুটির প্রয়োজন না থাকায় অষ্টমী বাদে প্রতিদিনই ডিউটি নিলাম পুজোয়। অষ্টমী রবিবার। উনি ডে অফ দিলেন। আর লক্ষ্মীপুজোয় যেহেতু ডিউটি নিয়েছি তাই দশমীতেও আসতে বারণ করলেন।
এই হাসপাতালে নিয়ম হচ্ছে, ইমার্জেন্সি অথবা আউটডোর, যেখানেই দেখাবে রোগী, টিকিট করতে গেলে আধার কার্ড দেখাতেই হবে।
টিকিট কাউন্টারের ছোট্ট চৌখুপির ভিতরের বড় ইমার্জেন্সি রুম। তার এক কোণে আমার বসার জায়গা। জ্বরের রোগী এসেছে শুনতে পেলাম। হিন্দিতে কথা বলছে। এখানকার অনেক রোগীই খিদিরপুর ডকের শ্রমিক বা তার পরিবারের লোক — ভিনরাজ্যের এবং হিন্দিভাষী। কাউন্টারের অল্পবয়সী মেয়েটি নিয়মমাফিক আধার কার্ড চাইল।
ওপাশ থেকে প্রতিপ্রশ্ন এলো — “কৌন সা আধার কার্ড দিখাউঁ, ইঁহা কা ইয়া বিহার কা?”
এর পরে এলো একটি ডায়েরিয়ার রোগী — দেখলাম জলশূন্যতা রয়েছে ভালই। ভর্তি করে ড্রিপ দেওয়ার নির্দেশ দিলাম। ইমার্জেন্সির নার্সিং স্টাফ কাঁচুমাচু মুখে জানাল, পুজোয় ওয়ার্ডে সিস্টারের সংখ্যা অপ্রতুল, তাই আমি যদি এখান থেকেই স্যালাইন চালিয়ে পাঠাই, ওদের একটু সুবিধে হবে।
জয় মা বলে ষোলো বছরের অনভ্যাসের ভয়কে পিছনে ফেলে দিলাম জেলকো চালিয়ে — দেখলাম মন্দার বোস ভুল বলেননি। সত্যিই যা একবার শিখেছি, যদিও অ্যাক্সিডেন্টালি, তা ভুলিনি কিছুই।
নবমীর দিন সন্ধেরাতে যখন বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাগ গুছোচ্ছি, একটি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার রোগী এলো। হাতে লেগেছে। ক্ষতস্থান রুমালে জড়িয়ে এসেছে। খুলে দেখি, থেঁতলে গিয়েছে কনুইএর নিচে, অকুতোভয় রোগী নিজেই দন্তবিকশিত করে ঘোষণা করল —“টাঁকা পড়েগা তো ম্যাডাম? কর দিজিয়ে সিলাই, কোই প্রবলেম নেহি”।
এবার আর ‘জয় মা’ তে কুলোলো না, আমার প্লাস্টিক সার্জারির অবিসংবাদী স্যারকে স্মরণ করে কাটিং নিডলে সিল্কের সুতো পরালাম কাঁপা হাতে — ষোলো সতেরো বছর পরে। প্রথম দুটো সেলাই নির্ঝঞ্ঝাটে করলাম। তৃতীয়টি করার পর দেখলাম রক্তপাত বন্ধ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেলাইএর লাইন কিঞ্চিৎ বেঁকে গিয়েছে। অতীব সহ্যশীল রোগী আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল — “থোড়া টেড়া হো গয়া তো কোই বাত নহী ম্যাডাম, জুড় যায়েগা তো?”
তাকে আশ্বস্ত করে বললাম — “হাঁ হাঁ, জুড়েগা জরুর।”
লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন একটি অল্পবয়সী ছেলে এলো ইমারজেন্সিতে। চারদিন ধরে জ্বর। তেমন কোনো ওষুধপত্রও পড়েনি। আজ বাড়াবাড়ি হতে চলে এসেছে। ধমক দিলাম— “এতদিন আসোনি কেন?”
ছেলে নিরুত্তর। সঙ্গে যে এসেছে, সেও এরই মতো রোগাভোগা একটি যুবক, রোগী ছেলেটির চেয়ে বয়সে সামান্য বড়। সে হাত কচলিয়ে বলল — “আমরা এখানে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে এসেছি। সবাই মিলে একসঙ্গে ঘর ভাড়া করে থাকি। একদিন কাজে না গেলে ঠিকাদার তো মজুরি কাটবে, তাই অসুখ লুকিয়ে এতদিন কাজ করেছে ও। আজ আর পারেনি। আমাকে বলল তাই এখানে নিয়ে চলে এলাম।”
“তুমি কে হও ওর?”
উত্তরে যুবকটি বলে — “কেউ না। আমাদের এক জায়গায় বাড়ি। গরিব ঘরের ছেলে, গ্রামে কাজ পাচ্ছিল না, তাই আমিই ওকে এনে কাজে লাগিয়েছি আমার সঙ্গে।”
আমি ইমার্জেন্সি বেডে শোয়া ছেলেটার কাছে যাই। জ্বর ১০৩, চোখটা ছলছল করছে। জিজ্ঞাসা করি —“বাড়ি কোথায় তোমার?”
উত্তর দেয় সঙ্গী যুবক — “পাকুড়ের নাম শুনেছেন ম্যাডাম? ঝাড়খন্ডের পাকুড়? আমাদের বাড়ি ওখানে।”
রোগীর মণিবন্ধে হাত রেখে পালস দেখতে দেখতে কেজো গলায় বলি, “কে আছে বাড়িতে?”
এইবার অস্ফুটে বলে ছেলেটা —“দিদিদের বিয়েশাদি হয়ে গেছে। শুধু মা আছে।” চোখের কোল বেয়ে একফোঁটা জল বুঝি গড়িয়ে পড়ে — ভিজিয়ে দেয় শহুরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এজমালি বালিশ। আমি মুখ ফিরিয়ে নিই।
টেবিলে ফিরে প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে ভাবি, ওই যে মলিন কিশোর আজ অসুস্থতায় মাতৃসান্নিধ্যবঞ্চিত হয়ে অসহায় চোখের জল ফেলছে, ও জানতেও পারল না যে ওর চেয়ে শতগুণ অভাগা, চিরতরে নিঃস্ব এক ডাক্তারনী ওর জন্য প্রেসক্রিপশন লিখছে —
ট্যাবলেট প্যারাসিটামল ৬৫০ — ওয়ান ট্যাবলেট থ্রাইস ডেইলি আফটার ফুড।
অ্যাডভাইজড ব্লাড টেস্ট ফর ডেঙ্গু এন এস ওয়ান, প্লেটলেট কাউন্ট অ্যান্ড ম্যালেরিয়া ডুয়াল অ্যান্টিজেন —-