১.
একদা বুদ্ধদেব (ভট্টাচার্য নন, মাথায় উষ্ণীষ-ওয়ালা বুদ্ধ) পরিভ্রমণ করতে করতে গাঙ্গেয় মোহনায় এসে পড়লেন। মনুষ্যজীবনের যে দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করে তিনি রাজত্ব ত্যাগ করে সাধনায় মন দিয়েছিলেন, তার কোনো ছাপ তিনি দেখতে পেলেন না এদেশে। রাস্তার পাশে উন্নয়ন দাঁড়িয়ে, কয়লা-গরু-চাকরি-রেশনের চাল সব কিছুরই প্রাচুর্য। বুদ্ধদেব ভাবলেন, তবে কি এদেশে জরা-ব্যধিও নেই! কপিলাবস্তুর এমন হালহকিকত হলে তিনি কোনোমতেই রাজকার্য ছেড়ে আসতেন না, এসব হিজিবিজি চিন্তাভাবনা করছেন…
এমন সময় এক প্রৌঢ়া নীল-পাড় সাদা শাড়ি পরিহিতা মহিলা কাঁদতে কাঁদতে এসে বললেন, “হে গৌতম বুদ্ধ, আপনি আমাকে রক্ষা করুন, দেখুন এদেশের চিকিৎসকরা আমার হাঁটুর কী অবস্থা করেছেন! আমি হাঁটতে পারছিনা, অফিস যেতে পারছিনা, পুজো উদ্বোধন করতে পারছি না। এমতাবস্থায় আপনাকে দেখে আমি আশ্বস্ত হয়েছি, আপনি আমাকে উদ্ধার করুন“
বুদ্ধদেবের মাথার শামুকগুলো নড়ে উঠলো এই কাতর আবেদনে, বুদ্ধদেব নড়লেন না। মানসচক্ষে সবই দেখতে পান বুদ্ধ। বললেন, “হে মাতঃ, আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো আপনাকে সাহায্য করার। কিন্তু তার জন্যে আপনাকে সেই পুরাতন নিয়মানুযায়ী সরিষা নিয়ে আসতে হবে, এমন বাড়ি থেকে যেখানে কারো ভুল চিকিৎসা হয়নি”
“কিন্তু ভগবন, আমার পায়ের অবস্থা ভালো নয়- আমি কীভাবে যাবো মানুষের বাড়ি বাড়ি?”
“হে মাতঃ, একথা পূর্ববিদিত যে আপনার একটি হুইলচেয়ার রয়েছে এবং একজন সমর্থ বাহকও রয়েছেন, তা সত্ত্বেও একথা আপনি কেন বলছেন?”
রেডিমেড চিকিৎসা না পেয়ে কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ন হয়েই মহিলা হুইলচেয়ার সহযোগে সরিষা সন্ধানে বেরোলেন।
২.
বছরখানেক কেটে গেছে। গঙ্গার তট থেকে মালভূমি পেরিয়ে বুদ্ধদেব পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ইতিমধ্যে কয়েক হাজার লোক ভুল চিকিৎসার উপশম চেয়ে তাঁর কাছে এসেছে, সবাই সরিষার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে- এ এক অনন্ত সন্ধান।
সকলেই মনে করছে তার বাড়ির মানুষটি ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন। এমনকি চিকিৎসকেরাও মনে করছেন তাঁর আত্মীয় অন্য একজন চিকিৎসককে দেখিয়েছিলেন, কিন্তু সঠিক চিকিৎসা পাননি। বরং তিনি চিকিৎসা করলে অনেক ভালো কিছু হতে পারতো। তাই কোনো বাড়ি থেকেই সরিষা সংগ্রহ করা যাচ্ছে না।
বুদ্ধদেবের অবশ্য এতে অসুবিধা নেই, তিনি কখনো নিজবেশে, কখনো বা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একই মানুষ দ্বিতীয়বার ওনার সান্নিধ্য পাচ্ছে না।
৩.
এমনি একদিন সন্ধ্যাবেলা দামোদরের তীরে কিছু শিষ্যকে নিয়ে বুদ্ধ গল্প করছিলেন। জাতকের গল্প। এমন সময় কে একজন এসে খবর দিলো এখানে একজন উদ্ভট দেবতার পুজো হচ্ছে, বিশাল ভিড়। যদিও পৌত্তলিকতায় বিশ্বাসী নন, তবুও বুদ্ধের ইচ্ছা হল একবার গিয়ে দেখা এত উদ্দীপনা কাকে নিয়ে!
অকুস্থলে গিয়ে দেখা গেল লোকে লোকারণ্য। শ্রীবিষ্ণু মোহিনী বেশে ভস্মাসুর নিধন করেছিলেন, সেই মূর্তির পুজো হচ্ছে, নাম ‘বিষ্ণুমাতা’! বুদ্ধের মাথার শামুকগুলো কেঁপে উঠলো, বছরখানেক আগে এরকম হয়েছিল না! অস্বস্তি লাগছিলো, ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসতে যাবেন, এমন সময়ে পুরোহিতের সাথে দেখা- তিনি আর কেউ নন, সেই মহিলা!!
কৌতূহল মানুষের বিপদ ডেকে আনে, একথা ইডিপাস প্রমাণ করেছেন, বুদ্ধও তার ফল পেলেন। মুহূর্তের মধ্যে এতদিনের সব ভুল চিকিৎসা রোগের চিকিৎসাপ্রার্থী রোগীরা ভিড় করলেন আর বুদ্ধকে ঘেরাও করে ফেললেন।
৪.
বুদ্ধ আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে আপনারা সরিষা পেয়েছেন?”
সবাই সমস্বরে বললেন, “না, তবে আমাদের ভুল চিকিৎসা সাথী কার্ড আছে, সেই দিয়ে চিকিৎসা হবে, ওসব সরিষার ভাওতাবাজি চলবে না”
বুদ্ধ বুঝলেন, এদের অন্ধকার থেকে বাইরে না আনলে গতি নেই। দুঃখের পত্রপত্রিকা পড়ে এদের জীবন তমসাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। বললেন, “আপনারা একটু শান্ত হন, আপনি এগিয়ে আসুন”, বলে মহিলাকে ডেকে নিলেন।
“আপনার পায়ে কী হয়েছে?”
“মাইক্রোসার্জারী করে সেপটিক হয়ে গেছে”
“কোথায় হয়েছে?”
“হাসপাতালে, ওটি-তে”
“যন্ত্রপাতি কোথাকার?”
“হাসপাতালের”
“গ্লাভস ইত্যাদি কোথাকার?”
“হাসপাতালের”
“তাহলে ইনফেকশন হলে চিকিৎসকের ভুল কোথায়? হয় গ্লাভসের থেকে ইনফেকশন হয়েছে, নয়তো যন্ত্রপাতি থেকে, নয়তো আশপাশের পরিবেশ থেকে। চিকিৎসক কি ইচ্ছা করে আপনার হাঁটুতে জীবাণু ঢুকিয়ে দিয়েছেন?”
“কিন্তু আমার তো ক্ষতি হয়ে গেল!”
“তার জন্য সমবেদনা অবশ্যই আছে, কিন্তু সব কিছুর পেছনে ‘ভুল চিকিৎসা’ শব্দবন্ধ বসানোর অভ্যাস আপনাদের- সকলেরই একই ধারণা, সেটা আপনারা নিশ্চয়ই বুঝেছেন”
বুদ্ধ আরো বললেন, “আপনাদের সকলের উদ্দেশ্যেই বলছি, আপনারা চিকিৎসকদের ঈশ্বর জ্ঞানে কষ্টের সময়ে ওনাদের শরণাপন্ন হন। তখন রোগের ইতিবৃত্ত, কতটা জটিল চিকিৎসা ইত্যাদি শুনেও না শোনার ভান করেন- এটা থেকে বেরিয়ে আসুন। রোগের প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করুন, তার থেকে কী কী জটিলতা আসতে পারে জানার চেষ্টা করুন। চিকিৎসার কী কী উপায় রয়েছে তার থেকে কী কী জটিলতা উদ্ভব হতে পারে সেগুলো আলোচনা করুন। সকল রোগের এবং সকল চিকিৎসা প্রণালীর কিছু পূর্ববিদিত জটিলতা আছে, সেগুলো জানুন- এগুলো কিন্তু কখনোই ‘ভুল চিকিৎসা’ নয়।
যে যত বড় চিকিৎসকই হন, তাঁর জীবনে জটিলতা হয়নি এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রবাদ রয়েছে, “শত মারি ভবেৎ বৈদ্য সহস্র মারি চিকিৎসকঃ”- এটা যিনি অস্বীকার করেন, তিনি প্রতারক ব্যতীত কিছু নন। কিন্তু কোনো চিকিৎসকই জ্ঞানত রোগীর ক্ষতি চান না। রোগ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের যুদ্ধে জয়ী দুই পক্ষই হতে পারে, এটা মেনে নেওয়ার মানসিকতা আপনাদের নেই।
তবু ‘ভুল চিকিৎসা’ হয়, হয়না তা নয়। সব মানুষের ভুল হয়, চিকিৎসকেরও হতে পারে। তাতে মানুষের চরম ক্ষতিও হয়, এটা সত্য। কিন্তু আমি-আপনি বিচার করে বলতে পারিনা কোন চিকিৎসা ঠিক, কোনটা ভুল। একই রোগীর একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন চিকিৎসক তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ এবং অবশ্যই চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা করলেও ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থাপত্রের উদ্রেক হয়। সকলের চিকিৎসা প্রণালী সমান নয়, সকলে সকল প্রণালীতে বিশ্বাসী বা স্বচ্ছন্দ না-ই হতে পারেন। কিন্তু এটা ঠিক, অন্যটা ভুল- এই কথা বলার অভ্যাস রোগী বা চিকিৎসক কোনো পক্ষ থেকেই অনুচিত। এই বিচার করার জন্য আদালত আছে, এই বিচার তাঁদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া কাম্য- আপনাদের এই খাপ পঞ্চায়েতের বিচারে বিজ্ঞানের শ্বাসরোধ হচ্ছে”
এই বলে বিষ্ণুমাতার পায়ে অপরাজিতা ফুল দিয়ে বুদ্ধদেব কপিলাবস্তুর পানে রওনা হলেন।