কয়েকমাস আগের একটা অন কলের রাত। থিয়েটার থেকে একটা অপারেশন সেরে বেরোবার পরে জুনিয়র ডাক্তারটি জানালো আরো একটা অপারেশন হয়ত করতে হবে।
ভিক্টর ব্রুকস স্থানীয় চার্চের প্রিস্ট। বয়স উনসত্তর। পেটে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। পাঁচ দিন হল ভিক্টর মলত্যাগ করেনি। পেটটা অসম্ভব রকম ফুলে গেছে। ভিক্টরের পেটের এক্সরেতে দেখা গেছে যে নাড়ির কোন একটা অংশ বন্ধ হয়ে গিয়েই এই বিপত্তি। ওর রক্তেও সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এমন অবস্থায় অপারেশন করার প্রয়োজন। আমি গেলাম ভিক্টরকে দেখতে।
জুনিয়র ডাক্তারটি একদম ঠিকই ভেবেছে। অপারেশন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। পেটটা ফুলে তো আছেই, সামান্য হাত দিলেও ভিক্টর ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছে। আমি যখন ভিক্টরকে পরীক্ষা করছিলাম তখন ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন ও কোন কারণে অসন্তুষ্ট। ওকে বললাম,- মিস্টার ব্রুকস আপনার অপারেশন করতে হবে।
ভিক্টর আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, বলেছিল,- ওকে ডক্টর, কখন?
-এখনই, কয়েক ঘন্টার মধ্যেই।
-ওহ, কে করবে অপারেশন?
-আমি, আমার সঙ্গে আরো একজন সার্জেন থাকবেন, যিনি আপনাকে প্রথমে দেখেছিলেন।
এবারে ভিক্টরের ভুঁরু কুঁচকোল,- আপনার সিনিয়র কোথায়?
-আছেন, অন্য একটা বড় অপারেশনে ব্যস্ত। আরো ঘন্টা চারেক লাগবেই সেটা শেষ হতে।
-আপনি কোয়ালিফায়েড?
এবারে আমি সামান্য অবাক হলাম, এমন প্রশ্নের মুখোমুখি আগে হইনি আমি। বললাম,- ইয়াপ।
-হোয়ার হ্যাভ ইউ বিন ট্রেইন্ড?
-ইন ইন্ডিয়া।
-ইন্ডিয়া। বলে মুখ দিয়ে একটা গরগরে আওয়াজ করল ভিক্টর। তারপর বলল,- ডু দে টিচ ইউ দিস অপারেশন ইন ইন্ডিয়া?
-ইয়াপ।
-আই ডোন্ট হ্যাভ মাচ ফেথ ইন ইউ, উড র্যাদার ওয়েট।
-সরি, সেটা পসিবল নয়, আপনার শরীরের অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে পারে। আই কান্ট লেট দ্যাট হ্যাপেন।
একপ্রকার নিমরাজী হয়েই ভিক্টরকে কনসেন্ট ফর্মে সই করতে হল। যতক্ষণ আমি ওর সঙ্গে ছিলাম ততক্ষণ ওর দৃষ্টি আটকে ছিল আমার ওপরে। সেই দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্যের ভাব আমার চোখ এড়ায়নি। অপারেশন থিয়েটারে ভিক্টরের পেট কাটার পরে দেখলাম কোলনের একটা অংশে একটা বড় টিউমার। সেই টিউমারটাই মল যাওয়ার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আকারে বাড়তে বাড়তে আশেপাশের নাড়িগুলোকেও টেনে ধরে রেখেছে টিউমারটা। ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে লিভারেও। ভিক্টরের ক্যান্সার যে স্টেজে তাতে অপারেশন করেও সারানো আর সম্ভব নয়। টিউমারের যতটা সম্ভব কেটে বাদ দিলাম। ভিক্টরের পেটের ওপরে একটা নাড়িকে আটকে রাখতে হল। একে বলা হয় স্টোমা, এইখান দিয়ে মল পেটের ওপরে আটকানো একটা ব্যাগে জমা হয়।
পরদিন সকালের রাউন্ডে যখন ভিক্টরকে দেখতে গেলাম তখন ও বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওকে পরীক্ষা করার পর বললাম অপারেশনের সময় আমরা যা পেয়েছি তার কথা। ভিক্টরকে আমরা কেমোথেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা করব, কিন্তু তাতে ক্যান্সার নির্মূল হবে না৷ আরো কয়েকমাস বেশি হয়ত বাঁচতে পারবে ভিক্টর। রুগীর কাছে মিথ্যা বলতে নেই। আমাকেও সবটা ভিক্টরকে জানাতেই হল। ও সবটা শুনল, কিন্তু কিছু বলল না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল।
তারপর দিনের রাউন্ডে আবার ভিক্টরকে দেখতে গেলাম। আগের দিনের থেকে সামান্য ভাল আছে। বিছানায় উঠে বসেছে। স্টোমা কাজ করা শুরু করেছেন। নার্স হালকা খাবার খেতে দিয়েছে ওকে। আমি ওকে পরীক্ষা করার পর ভিক্টর বলল,- হাউ মাচ টাইম ডু আই হ্যাভ ডক্টর।
আগের দিন বলেছিলাম। আবার বললাম। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমন একটা কঠিন সত্যিকে মেনে নিতে সময় লাগে মানুষের৷ তাই রুগী বারবার একই প্রশ্ন করে।
-আ ফিউ মান্থস। উইথ প্যালিয়েটিভ কেমোথেরাপি উই মে বি এবল টু ইনক্রিস ইট আ বিট।
-ওহ, ওকে। সেদিনও আর কিছু বলেনি ভিক্টর।
তারপর আরো দিন তিনেক কাটল। ভিক্টর বিছানা ছেড়ে চেয়ারে বসা শুরু করল। নিজের স্টোমা ব্যাগ নিজেই বদলায়। একদিন আমি ওকে চেক করার পরে আচমকাই বলল,- আই অ্যাম সরি ডক্টর।ভিক্টরের গলার স্বরে অনুতাপ স্পষ্ট ছিল।
আমি বললাম,- ফর হোয়াট?
-আই ওয়াজ বিয়িং আ রেসিস্ট দ্যাট ডে।
-ইয়েস ইউ ওয়্যার।
-আমি সরি। খুব খারাপ লাগছে এখন। আই শুডন্ট হ্যাভ জাজড ইওর স্কিলস বেসড অন দ্য কান্ট্রি ইউ বিলং টু।
-মাই কান্ট্রি হ্যাজ টট মি ওয়েল মিস্টার ব্রুকস। হেসে বললাম।
-সেদিন কেমন আপনাকে কষ্ট দিলাম আমি। খুব খারাপ লাগছে আমার। আমি নিজে একজন প্রিস্ট হয়ে কী করে এভাবে ভাবতে পারলাম! আই হ্যাভ সিনড। যে কটা দিন বাঁচব এই পাপটাকে নিয়ে আমাকে বাঁচতে হবে।
-এমনটা ভাবার কোন দরকার নেই। ইটস ওকে। আই অ্যাম অ্যাকসেপ্টিং ইওর অ্যাপলজি। উই আর গুড নাও।
এবার ভিক্টর এমন কিছু বলল যার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। ও বলল,- ক্যান আই আস্ক ইউ ফর আ ফেভার?
-শিওর।
-ক্যান ইউ প্লিজ প্রে টু ইওর গড ফর মি? তাঁকে বলো আমাকে ক্ষমা করে দিতে। আমার ঈশ্বর যে আমাকে ক্ষমা করবেন না তা আমি জানি।
আমি বললাম,- হ্যাঁ করব। অ্যান্ড আই অ্যাম শিওর দ্যাট ইওর গড উইল ফরগিভ ইউ টু।
এই জীবনের অমোঘ সত্যি জীবনের শেষে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া। এই কথাটা আমি আগেও অনেকবার বলেছি। এই ভাবনাকে খুব ‘মরবিড’ বলে মনে হতে পারে কিন্তু এটা মনের মধ্যে আসতে সময় লাগে। দ্রুতগতির জীবনে ছুটতে ছুটতে আমরা নিজেদের মধ্যেই এতটা হারিয়ে যাই যে মনে হয় যা করছি ঠিক করছি, নিজের সব কাজকে যথার্থ বলে মনে হয়। এমন সময়ই মানুষ একদিন মৃত্যুকে দেখলে থমকে দাঁড়ায়, তা সে যতদূরেই থাকুক না কেন। তখন সে ভাবতে থাকে তার ভুলগুলোকে, হয়ত অনেক দেরী হয়ে যায়, তবু শোধরাতে চেষ্টা করে। অকারণে অন্যকে আঘাত করার মধ্যে একটা নেশা আছে। মৃত্যুর কাছাকাছি এসে সেই নেশার ঘোর কেটে যায়। মানুষ হয়ত তখন সেই মুখগুলোকে মনে করে যাদের সে কোন কারণ ছাড়াই কষ্ট দিয়েছিল। মৃত্যু মানুষকে নরম করে, নিজের মধ্যে দেখতে শেখায়। আস্তিকেরা তখন আবার ঈশ্বরের কাছে ফিরতে শুরু করে। চরম নাস্তিক হয়ত তখন নিজের ঈশ্বরকে খুঁজে পায়।