বছরের এইসব দিনগুলোতে রোদ্দুর হয় জিরেন কাঠের গুড়ের মতো। হলুদ ঝকঝকে, স্বচ্ছ ফিনফিনে আর মোলায়েম রকমের ঝাঁঝালো।
বছরের এইসব দিনগুলোতে, হাওয়া হয় দুঃখী। আচমকা পাগলাটে, রুখুসুখু ধুলোটে আর মনকেমনীয়া এলোমেলো।
এইসব মেখেমুখেই আমি পড়ন্ত দুপুরবেলা, আউটডোর থেকে ইনডোরের পথে পা বাড়াই হররোজ। পায়ে পায়ে মাড়িয়ে যাই অজস্র শুকনো পাতা। গায়ে গায়ে মাখিয়ে নিই আসন্ন বৈশাখী-তাপস। বছরের… এইসব দিনগুলোতে।
তদুপরে, এই বৎসরে আবার কার্যকারী হয়েছে গৃহবন্দীর রাজ আদেশ। চারপাশটা দেখতে এখন তাই কেমন জানি অতীন্দ্রীয় লাগে।মড়ক মড়ক আতঙ্কে খাঁ খাঁ করছে চত্ত্বর। ভোমরা ঘুরে বেড়াচ্ছে ভনভনিয়ে। অলক্ষ্যে চড়া গলায় একটানা ডেকে যাচ্ছে বেনে বউ। পরিত্যক্ত গোবর নাদিতে বিজকুড়ি তুলছে কীট পতঙ্গ। ঠিক যেন নিঝুমপুরীতে একলা রাজপুত্র আমি। ঠিক যেন সব্বাই অন্তরালে দাঁড়িয়ে আছে চোখ চেয়ে। দেখে যাচ্ছে আমাকে জোড়া জোড়া দৃষ্টিতে। অথচ…নিঃস্পন্দ। অথচ… অলক্ষ্যে।
অলক্ষ্যেই বটে। ঝিম ধরানোর এসব সময়ে অন্যান্য বছর অন্তত ইনডোরের পেশেন্টগুলো আমার, বাইরের মাঠটাতে রোদ্দুর পোহায় পিঠ ঝুঁকিয়ে। ধুলোতে ছক কেটে বাঘ-ছাগল খেলতে থাকে, একমনা। দুই বিনুনির প্যাঁচ জড়াতে থাকে একে অপরের শীর্ণ পিঠে। মুখ কুঁচকে ক্ষার সাবানে কাচা প্যান্ট হাওয়ায় ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে আসে সদ্য স্নাতা । বাতাসে ওড়ে সেসবেরই সূক্ষ্ম জলকণা। হাওয়ায় ভাসে সেইসব গার্হস্থেরই গুনগুন।
তারপর সহসা, শুকনো পাতায় আমার খচমচ শুনতে পায় যেই, ওমনি মুখ তুলে, ঘাড় ঘুরিয়ে হাসে। পায়ে পায়ে ধীরে লয়ে চলে যায় নিজ নিজ কক্ষে। বিছানায় উঠে, গায়ে টেনে নেয় আমাজের কম্বল। এটা, রাউন্ডের সময়। এ সময়ে ঘরে থাকাটাই দস্তুর।
এইসব দেখতে আমার বড় ভালো লাগে। আমার বড্ডো আরাম হয় ওদের এই স্বাভাবিক জীবন যাপনের প্রাণপণ প্রচেষ্টাগুলোকে চলচ্ছবির মতো দেখে যেতে। বস্তুত, আমার এই সাদামাটা ডাক্তারি জীবনে, এই রাউন্ড পূর্ববর্তী মুহূর্তটাই একমাত্র চাকচিক্য। একমাত্র খুশিয়াল। অথচ ওরা জানে, ওদের জীবিত থাকার সম্ভাবনা মেরে কেটে ষাট শতাংশ। অথচ ওরা জানে, ওদের বেমারির নাম মরণান্তক ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি।
এসব সময়ে, তাই আমি তরল থাকি মৃদু। প্রথাগত রাউন্ড দেওয়ার কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছি সেই কবেই! এরা যে প্রথাগত রোগীই নয় কেউ। এরা যে আমার হাতের তালুর মতো পরিচিত জন সক্কলে। এদের প্রত্যেকের সাথে আমার যোগাযোগ বজায় থাকে মাসের পর মাস। ততদিন অবশ্য এখানে ভর্তি থাকে না খুব একটা কেউই। ওষুধ শুরু হওয়ার দিন দশেকের মাথাতেই বাড়ি চলে যায় ছুটির কাগজ নিয়ে। তবুও… যোগাযোগটা থেকে যায়। থেকে যায় টেলিফোন মারফত খোঁজ খবর আর তত্ত্বতালাশ। নাগাড়ে বছরখানিক ওষুধ খাওয়ার মেয়াদ যে! কারো কারো তো আবার একটানা বছর আড়াই-তিন।
কাঁহা কাঁহা মুলুক থেকে এখানে আসে এরা। কুয়াশা মাখা দার্জিলিং, চা বাগানের আলিপুরদুয়ার, খেজুর গাছের দিনাজপুর, সীমান্ত প্রদেশের কোচবিহার। সঙ্গে করে নিয়ে আসে ছোট্ট ছোট্ট গল্প। আশ্চর্য। অনোখা। অবাক করা। প্রত্যেকটিই। আর সেইসব গল্পই আমি শুনি রাউন্ড দিতে দিতে। সেইসব গল্পই আমায় জানিয়ে দেয় ওদের মুচকি হাসির কিম্বা মুখ গোমড়া থাকার কারণ। তেমন তেমন বুঝলে আমি তাই, হাত নেড়ে বারণ করি কাউকে কাউকে। বলি–” উঠতে হবে না, উঠতে হবে না। খেলো খেলো। রোদ পোয়াও ভালো করে…।”
এই কেউ কেউ’ আদতে এতদিন শয্যাশায়ী ছিল। অবশেষে এখন এই যে এই রোদ্দুরটিতে এসে জুৎটি করে বসেছে, এইটাই জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ ওদের সুস্থতার। এখন অন্তত ওদের আর নাড়ি টিপে দেখবার প্রয়োজন নেই। এখন ওরা খাট থেকে নেমে, চলে আসতে পেরেছে আলোর বৃত্তে। এই আমার পরিতৃপ্তি। এই আমার আরাম। এই আমার রূপকথা।
এ বৎসর, সেসবের সুযোগ নেই। এ বছরে, ওদের সক্কলেরই মনখারাপ। ছুটির সময় চলে এলেও, ছুটি পায়নি একজনেও। আটকা পড়েছে সক্কলে মিলে লক-ডাউনে। অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় যদিও। তবুও… সেসবে একরকম নিষেধাজ্ঞাই জারি করেছি আমি। এমনিতেই, রোগে ভুগে ভুগে বেচারিদের সর্ব শরীর বেহাল। তার উপর আবার যাতায়াতের পথে করোনা সংক্রমণ হলেই চিত্তির। তাই কড়া নির্দেশ আমার– সব স্বাভাবিক না হওয়া অবধি এইখানেই থাকো। আপত্তি করেনি কেউই। বস্তুত, নিজেরাই এখন আর বেরোয় না ঘর ছেড়ে। রোদ্দুরে পর্যন্ত যেতে ইতস্তত করে। ভয় জেঁকে বসছে সক্কলের। আউটডের থেকে ইনডোরের পথটা তাই এখন সত্যিকারের নিঝুমপুরী বলে ভ্রম হয়।
ওইটুকু পথ পার হতে হতে তাই আমি আগডুম বাগডুম ভাবতে থাকি আনমনে। আজও যেমন ভাবছি। বিশেষ কারণে আজ দ্বিতীয়বার রাউন্ড দিতে যাচ্ছি ইনডোরে। আর ভাবছি পুনম-ঝিলমের কথা। মাথা তুললেই যাদেরকে দেখতে পাচ্ছি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে গ্রীল ধরে। পিছনে, শুষ্ক মুখে ওদের মা।
পুনম ঝিলম দুই বোন। গলাগলি।
ওদের গল্পটা ভারি অদ্ভুত। অথবা বড্ডো সাধারণ সাদামাটা জলভাত।
পুনমরা তিন বোন। এক ভাই। পুনম, ঝিলম,সোনম, বিট্টু। আর ওদের বাপ মা। এই মোটমাট ছয়জন। অন্তত তাইই ছিল। বাপ কাজ করতো চা বাগানে। পার্মানেন্ট ওয়ার্কার। আর মা করতো টেম্পুরারি পাতা তোলার দিনমজুরি। ঘর ছিল একটা। মাটি আর খাপরার। দশ ফুট বাই আট ফুট। দুইখানা খুপরি কামরা আর চুলা রসুই ওরই মধ্যে আটোসাঁটো। এবং তাই নিয়েই দিন কাটছিল দিব্যি।
তারপর যা হয়…। বাপের টিবি হলো। ওষুধ খেলো সরকারি। এবং মারাও গেল ক’দিন বাদে। মারা গেল তার ঠিক পরপরেই বিট্টুও। এসব, আজ থেকে বছর দশেক আগেকার কথা। শুনতে পেয়েছি রাউন্ড দিতে দিতে। গল্প গাছাতে। তো সে যাই হোক, বাপের চাকরিটাই মা পেলো এইবারে। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা। মাসিক বেতন চার হাজার। যদিও নো ওয়ার্ক নো পে কড়ারে, তবুও চা বাগানের নিরিখে,এ চাকরি একরকম স্বচ্ছলতাই। উপরন্তু, পেটও কমে গেছে দুই খানা। তিন বোনে তাই এইবারে পড়তে শুরু করলো ইস্কুলে। আর মা, চাকরি। দিব্যি চললো বছর আটেক গড়গড়িয়ে। তারপর ফির সে ধাক্কা।
আবার টিবি। এবার সোনমের। ততদিনে যক্ষ্মা চিকিৎসার বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে বেশ কিছুটা। ততদিনে ধরতে পারা গেছে, সোনমের টিবি রোগটা আদতে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি। সাধারণ টিবির ওষুধে সারবে না মোটেও। তড়িঘড়ি তাই ভর্তি করা হয়েছিল এইখানে আমার আন্ডারে।
সেই প্রথম পরিচয় আমার এই পরিবারটির সাথে। রোগা টিঙটিঙে ধুলোট নাইটি পরা এক মহিলা, গমছাটাকে ওড়নার মতো করে বুকে নিয়ে বসে আছে। কোলে, ততধিক শীর্ণা এক কিশোরী। ধুঁকছে খাবি খেতে খেতে। ওইটাই সোনম। সোনম ওরাঁও। পরিবারে, টিবির তৃতীয় শিকার।
ভর্তির পরপরেই চমকে উঠেছিলাম ব্লাড রিপোর্ট দেখে। হিমোগ্লোবিন– থ্রি পয়েন্ট সেভেন।
যে সময়ের কথা বলছি, সেসময় ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবির চিকিৎসার ফলাফল ছিলো আরো অনেক বেশি হতাশাজনক। খুব জোর হলে পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষেত্রে সাফল্য মিলত মেরেকেটে। তায় আবার, ওষুধগুলো ছিল তীব্র রকমের টক্সিক। হাজারো রকমের সাইড এফেক্ট তাতে। ফলত, হিমোগ্লোবিন না বাড়িয়ে, চিকিৎসা শুরু করতে ভরসা পাইনি আমি। এবং লাভ হয়নি তাতেও। চিকিৎসা শুরু করার দিন সাতেকের মধ্যেই সোনমও ধড়ফড়িয়ে মারা গেল। সোনমের মা কাঁদেনি। অভ্যস্ত হয়ে গিছলো ততদিনে। বস্তুত, অধিকাংশ চা বাগান কর্মীকেই আমি সমস্ত যন্ত্রণাতেই সতত অভ্যস্ত দেখেছি। নিশ্চুপে মা-ওরাঁও চলে গিছলো মেয়ের শবদেহ কোলে নিয়ে। সঙ্গে, বছর তের চোদ্দর আরো দুটো ফুটফুটে বাচ্চা। দিদির ডেডবডির দিকে তাকিয়ে ছিল ফ্যালফ্যাল করে আর ভাগাভাগি করে খাচ্ছিল এক প্যাকেট শস্তার ক্রিম বিস্কুট।
গল্পটা এখানে শেষ হতে পারতো। হয়নি। বরং এ গল্পের পরবর্তী ধাক্কাটা আরো জোরালো। মাস খানেক আগেই আবার এসে হাজির ওই বুকে-গামছা মহিলা। সাথে, পুনম। এবার পুনমেরও ধরা পড়েছে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি। ঝিলমকে তাই রেখে আসা হয়েছে নানীর কাছে। চিকিৎসা শুরু হলো তৎক্ষণাৎ। যদিও ফলাফল মিললো না খুব একটা। চোখের সামনে পুনম শুকিয়ে যেতে লাগলো একটু একটু করে। ওজন কমতে লাগলো বিপজ্জনক রকম। এবং ঠিক কুড়িদিন আগে, ডবল ধমাকা। ঝিলমও এসে হাজির হলো এইখানে। কাশছিল কদিন ধরেই। ঝিলমেরও মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি ধরা পড়েছে সদ্য। সাথে পাওয়া গেছে আরো একটা সংবাদ। পুনমের কফ পরীক্ষার রিপোর্ট এসেছে কোলকাতা থেকে। রিপোর্ট– মারাত্মক। এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিউবারকাউলোসিস। প্রায় কোনো ওষুধই কাজ করবে না আর ওর ওপরে।
সমগ্র বিশ্বে করোনা আতঙ্কে যখন ‘লক ডাউন’ শুরু হচ্ছে সদ্য, ঠিক তখনই আমার আন্ডারে দুইখানি কিশোরী। একজন এম.ডি.আর। আরেকজন এক্স.ডি.আর। ওরাঁও বংশের শেষ দুইজন প্রাণী।
আমি হতভম্ব হয়ে গিছলাম। চিকিৎসক হিসাবে প্রতিটি রোগীর প্রতিই সমান মনোযোগ থাকার কথা আমার সর্বদা। তবুও…কখনো কখনো দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়ে বেকায়দাতে। পুনম ঝিলম ছিলো আমার ঠিক সেই রকম দুর্বলতা।
ওদের মায়ের চোখাচুখি তাকাতেও সাহস পেতাম না আমি। বোবা, হতাশ, দাবীহীন একজোড়া চোখ আদতে বড্ডো বেশিরকমেরই দাবী করতো। দাবী, সমর্পিতার।
করোনা নিয়ে ততদিনে উত্তাল সমগ্র বিশ্ব। টিভিতে, পেপারে, লোকমুখে, ফেসবুকে হইহই রইরই অবস্থা। হঠাৎ করে মুখে মুখে ফিরতে শুরু করেছে– ড্রপলেট, এয়ারবোর্ন, পি পি ই। রাস্তা ঘাট শুনশান। ট্রেন বাস বন্ধ। বন্ধ প্রায় অধিকাংশ যোগাযোগ ব্যবস্থা।
আউটডোরে রুগী দেখতে দেখতে কেবলই ভুরু কুঁচকে যেত আমার। মড়ক মড়ক গন্ধে মাথার ভিতর হানা দিত আরেকখানি এয়ারবোর্ন মহামারীর কথা। করোনার চাইতেও বহু বহু গুণ বেশি মানুষ, যে মহামারীতে প্রত্যেকদিন মারা যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে। টিবি যার নাম। পুনম ঝিলম যে রোগে মৃত্যুর দরজাতে প্রায়। ওরাঁও পদবীর একটা গোটা বংশ সাবাড় হতে চলেছে যে বেমারিতে।
ঝিলমকে নিয়ে চিন্তা অপেক্ষাকৃত কম। মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবির সমস্ত ওষুধই মজুত ছিল আমার কাছে। চিন্তাটা, পুনমকে নিয়ে। পুনমের এক্স ডি আর। পুনমের বয়স ষোল। আঠারো বছরের নীচের এক্স ডি আর রোগের জন্য সবচাইতে কার্যকরী যে ওষুধটি, সেটি বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে পরীক্ষামূলক ভাবে। ফলাফল, তাক লাগানো। প্রায় নব্বই ভাগ সাফল্য এ যাবৎ আমার আন্ডারে।
মুশকিলটা অন্যত্র। এ ওষুধটি ‘কন্ডিশনাল অ্যাক্সেস’ / ‘শর্তসাপেক্ষ হিসাবে পাওয়া যায় বর্তমানে। খোলা বাজারে তো দূর অস্ত, সরকারি স্টোরেও রাখা থাকে কড়া তত্ত্বাবধানে। এক একটি কোর্সের মূল্য প্রায় সাড়ে তিন চার লক্ষ টাকা। লক ডাউনের বাজারে, সে ওষুধ পাবো কী করে? চিঠি অবশ্য পাঠিয়েছিলাম কেন্দ্রীয় টিবি বিভাগে তড়িঘড়ি। ওষুধ পাঠানোর প্রচেষ্টা শুরুও হয়েছিল তৎক্ষণাৎ। আচমকা,…লক ডাউন। প্লেন, ট্রেন, বাস, ট্যাক্সি সমস্ত বন্ধ। এবং ওষুধটি আসবে মুম্বাই থেকে।
ফোন করেছিলাম তাই WHOপ্রতিনিধিকে। বলেছিলাম–” অনিকেত… প্লিজ দেখো একটু।” ফোন করেছিলাম রাজ্য টিবি অধিকর্তাকেও। বলেছিলাম-” স্যার.. একটু দেখবেন যদি…।” তারপর বসে পড়েছিলাম হতাশ হয়ে। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। কিচ্ছু না। ফেসবুক, টিভি, করোনা, চটুল ভিডিও,নরম কাব্য… কিচ্ছু না। প্রতিদিন ঘরে ফিরে আসতাম ভুরু কুঁচকে। বাড়ি ভর্তি ডেটল ডেটল গন্ধ। মন ভর্তি করোনার দুশ্চিন্তা। এবং মাথার মধ্যে পুনম ঝিলম। বন্ধু বান্ধবী, আত্মীয় পরিজন বারে বারে ফোন করেছে আমায়। ফোন করেছে খবর নিতে–” ঢাল তরোয়াল ছাড়া করোনার মধ্যে বেঁচে আছি কিনা ।” একটি ফোনও ধরিনি। ধরতেই পারিনি। হোয়াটসঅ্যাপে বড়ো জোর কথা বলেছি টুকটাক। আর এড়িয়ে গেছি সমস্ত জাগতিককে।
এরই মাঝে একদিন পুনম-ঝিলমের স্থানীয় চার্চের প্যাস্টরের সাথে কথা হলো। ভদ্রলোকই ফোন করেছিলেন আমাকে। শান্ত, ধীর কন্ঠস্বরে বললেন–” সান, ইউ আর দি রিয়্যাল এঞ্জেলস ইন হিজ ওয়ার্ল্ড। দিস চাইল্ড…পুনম…দে হ্যাভ সিন আ লট অফ সাফারিং। আ লট অ্যান্ড লটস অফ।…হইচ, প্রোবাব্লি ইউ নো বাই হার্ট। প্লিজ ট্রাই টু সেভ অ্যাটলিস্ট দিজ টু…। প্লিজ ডু সামথিং…।”
সেদিনও মধ্য দুপুর। দাঁড়িয়ে ছিলাম মোবাইল কানে আউটডোর আর ইনডোরের মাঝখানের পথটাতে। ঘুঘু ডাকছে একটানা। পাতা ঝরছে নিঃশব্দে। মাঠ জুড়ে আলো ছায়া-ছায়া রোদ্দুর। প্যাস্টর ভদ্রলোকের গলায় কী জানি একটা ছিল! একলা দুপুরে আমার চোখ ভিজে গিছলো হঠাৎ। ঈশ্বর অবিশ্বাসী আমি সত্যি সত্যিই মাথা ঝুঁকিয়ে বলেছিলাম–” আই…আই ট্রায়েড ফাদার। ট্রাস্ট মি। ট্রায়েড এ লট। বাট আই কুডুন্ট। আই ফেইলড। দেয়ার ইজ নো হোপ ইন দিস লকড ডাউন স্টেট…। আই ক্যান ডু নাথিং টু সেভ হার।”
ফোনের ওপারে প্যাস্টর চুপ ছিলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলেছিলেন আশ্চর্য বিশ্বাসী স্বরে–” দেয়ার ইজ অলয়েজ হোপ মাই সন। ব্লেসড আর দোজ, হু ট্রাস্ট ইন লর্ড। ইউ উইল নট বি ডিসমেইড, ফর হি ইজ আওয়ার লর্ড।” ঘুঘুর ডাক ছাপিয়ে আমি অলৌকিক গং শুনতে পেয়েছিলাম সেইদিন। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিছলাম রাউন্ড দিতে।
তিন চার দিন পেরোলো। প্যাস্টরের বিশ্বাসী কন্ঠের রেশ ততদিনে ফিকে হয়ে গেছে আমার মনে। অলৌকিক বলে এ জগতে হয় না কিছুই। এ গোটা জগতটাই চূড়ান্তরকম ফক্কা। বকওয়াস। শেষমেশ বিরক্ত হয়েই একদিন ফোন করলাম অনিকেতকে আবার। ফোন করলাম রাজ্য টিবি আধিকারিককেও–“স্যার? ওষুধটা এলোই না? বলুন? মরেই যাবে এবার মেয়েটা। তাই তো?”
উত্তরটা ছিলো অদ্ভুত–” অ্যাঁ? কী বলছো হে? ওষুধ তো কোলকাতা অবদি এসেই গেছে। কাল পরশুই পেয়ে যাবে হাতে। মাথা ঠান্ডা করো। মাথা ঠান্ডা করো হে সব্যসাচী।”
কাল-পরশু নয়। ওষুধের পার্শেলটা হাতে পেয়ে গেলাম ফোন রাখার ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই। মুখে কাপড়ের মাস্ক আর হাতে হলেদেটে গ্লাভস পরে দিয়ে গেল অসীমাভদা। উত্তরবঙ্গ রাজ্য ড্রাগ স্টোরের ফার্মাসিস্ট। তারপর চলে গেল, বাইকে কিক মেরে। ফাঁকা আউটডোরে, তখন দুপুর বাজে প্রায় সাড়ে তিনটে। বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করছিলাম আমি আরো একবার মুখ ঝুলিয়ে। আচমকা, সবটা ঝলমলে হয়ে গেল। হাত ধুয়ে, ফোন লাগালাম অনিকেতকে। আর স্তম্ভিত হয়ে শুনলাম একটি পার্সেলের আশ্চর্য ভ্রমণ কাহিনী।
মুম্বাই থেকে বিশেষ মালগাড়িতে সে পার্সেল এসেছে কোলকাতায়। কোলকাতা থেকে বিশেষ পারমিশনের গাড়ি নিয়ে, শিলিগুড়ি। আর শিলিগুড়ি থেকে বাইকে চেপে এখানে। অর্থাৎ টিবি হাসপাতাল, জলপাইগুড়ি। পুরো বিষযটাকে চূড়ান্ত রকম ভাবে মনিটর করেছে WHO এবং কেন্দ্র ও রাজ্য টিবি দপ্তর। চূড়ান্ত লক ডাউনের মাঝেও একটি মাত্র পেশেন্টের জন্য অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছে ম্যাজিক মন্ত্রে।
সেই পার্সেল দু’হাতে নিয়েই এবার দ্বিতীয়বারের জন্য ইনডোর মুখী হলাম আমি। ঘাড় উঁচিয়ে, মুখ তুলে হাসলাম বারান্দার দিকে তাকিয়ে। ইশারায় দেখালাম– ওষুধ এসে গেছে। ওষুধ…এই যে আমার হাতের মুঠোতে।
পুনম ঝিলমের পিছনে দাঁড়ানো বুকে গামছা মহিলার মুখে হাসি ফুটলো বুঝি। অধুনা-মহামারীর দিনেই লড়াই শুরু হলো প্রাচীন এক মহামারীর বিরুদ্ধে। নিঝুমপুরীতে সত্যি হতে শুরু করলো আরেকটা রূপকথা।
আপনাকে আমি চিনি, পরিচিত বন্ধুদের মাধ্যমে ও আপনার সিনিয়র দের মাধ্যমে।আগে মনে মনে স্যালুট জানাতাম আপনার লড়াই কে, এখন এই মাধ্যমে সরাসরি স্যালুট জানাচ্ছি। ভালো থাকবেন।