চেয়ারে বসে ঘুমানোর ব্যাপারে পুলিশরা বেশ পটু।
মেডিক্যাল কলেজের এমারজেন্সিতে বসে চারদিক পর্যবেক্ষণ করছি। রাত বারোটা বেজেছে। এমারজেন্সি একটু ফাঁকা। গেটের কাছে একজন যুবক পুলিশ চেয়ারে বসে ঘুমচ্ছেন। তাঁর মেরুদণ্ড একেবারে সোজা। মাথাও ঝুঁকে পড়ছে না। তবে তিনি জেগে নেই।
তাঁর মুখটা একটু ফাঁকা। ঠোঁটের কোনা দিয়ে নাল গড়িয়ে পড়ছে। জেগে থাকা কোনো মানুষের নিশ্চয়ই নাল পড়বে না। তাছাড়া তাঁর মুখে অদ্ভুত সুন্দর একটা হাসি ফুটে উঠেছে। জাগ্রত অবস্থায় এমারজেন্সিতে একলা বসে হাসার কোনো কারণ নেই।
তবে আমার পুলিশ নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। এখনও অনেক কাজ বাকি আছে। ইডেন হাসপাতালে গাইনির দুটো কল-বুক দেখতে যেতে হবে। সে দুটো দেখে এম সি এইচ বিল্ডিংয়ে একবার যাওয়া উচিৎ। সদ্যাগত ফার্স্ট ইয়ারের পিজিটি ভাই মেডিসিনে নাইট ডিউটিতে আছে। তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা দেখে আসা উচিৎ।
এমারজেন্সির মেডিক্যাল অফিসার আর ইন্টার্নদের বললাম আমি ইডেনে কল-বুক দেখতে যাচ্ছি। তারপর মেডিসিন ওয়ার্ডে যাব। ঘণ্টাখানেক লাগবে। এর মধ্যে মেডিসিনে ভর্তির মতো কোনো রোগী এলে আমাকে ফোন করবেন।
এমারজেন্সি থেকে বেরিয়ে ইডেন হাসপাতালে যাচ্ছি। এক পাশে ক্যাজুয়ালটি ব্লক। অন্যপাশে বাগান। তার মাঝখান দিয়ে বাঁধানো রাস্তা। অন্যদিন হলে এই রাস্তার পাশেই বিছানা করে দূর থেকে আসা রোগীর বাড়ির লোকেরা দিব্যি ঘুম দেয়। আজ ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। তাই রাস্তার দুধার ফাঁকা।
কতো বছর কেটে গেল এখানে। এম বি বি এস, ইন্টার্নশিপ আর হাউজ-স্টাফ শিপ মিলে প্রায় সাত বছর। আর দ্বিতীয় ক্ষেপে এম ডি করতে এসে আরও তিন বছর। এখন এম ডি’র ফাইনাল ইয়ার চলছে। আর কদিন বাদেই কলেজ থেকে বেরিয়ে যাব। জানিনা কোথায় যাব। এতদিন কাটিয়ে এই কলেজটা যেন দ্বিতীয় বাড়ি হয়ে উঠেছে।
দুটি কল-বুকই লেবার রুম থেকে। ইডেন হাসপাতালে ঢুকে লোহার গ্রিল খুলে লিফটটায় উঠলাম। সুইচ চাপলে লিফটটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উপরে ওঠে। দুদিন আগেই লিফটটা এক আর দুই তলার মাঝামাঝি জায়গায় আটকে গেছিল। লিফটে তখন গাইনির একজন আর এম ও ম্যাডাম ছিলেন। তিনি আটকে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়েছিলেন। ইডেন হাসপাতাল ব্রিটিশ আমলের বাড়ি। একেকটা তলা এখনকার দুটো তলার চাইতেও উঁচু। কিছুতেই ম্যাডামকে উদ্ধার করা যাচ্ছিল না। শেষে একটা আলমারি টেনে তাঁর উপর উঠে পি ডব্লিউ ডি’র একজন কোনো রকমে লিফটের দরজা খুলেছিলেন। সেই উদ্ধারকার্য দেখতে বিশাল ভিড় জমে গেছিল।
আজ কোনো ঝামেলা ছাড়াই লিফট তিন তলায় উঠে গেল। লেবার রুমে ঢুকলে রাত দিন কিছু বোঝা যায় না। সব সময় এখানে চিৎকার চেঁচামেচি চলছে। একজন পিজিটি ভাইকে বললাম, মেডিসিন থেকে এস এম ও পি রেফার দেখতে এসেছি। কোন দু’জনের রেফার আছে একটু টিকিট বের করে দাও।
প্রথম রেফারটায় আমার কিছুই করার নেই। একজন গর্ভবতী মায়ের ডেক্সট্রোকার্ডিয়া আছে। মানে হার্ট বুকের বাঁদিকের বদলে ডানদিকে। এটা না জেনেই সেই মা জীবনের বাইশটি বসন্ত পার করে দিয়েছেন। কোনো সমস্যা হয়নি। ভবিষ্যতেও তেমন সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না।
দ্বিতীয় রেফারটি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। একজন সাতাশ আঠাশ বছরের যুবতী পেট ফোলা আর পেটে ব্যথা নিয়ে লেবার রুমে ভর্তি। দেখে মনে হচ্ছে আসন্নপ্রসবা। কিন্তু ভালো করে ইতিহাস নিয়ে এবং পরীক্ষা করে বুঝলাম, গণ্ডগোল আছে। ইনি মোটেই গর্ভবতী নন। এনার পেটে জল জমেছে। যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে অ্যাসাইটিস।
গাইনির পিজিটি’কে বললাম, এই রোগী লেবার রুমে ভর্তি হয়ে গেল কী করে?
ভাইটি বলল, জেনারেল এমারজেন্সি থেকে কেউ একে পেট ফোলা আর পেটে ব্যথা শুনেই স্ত্রী বিভাগে পাঠিয়ে দিয়েছে। ইডেনের এমারজেন্সিতে এক ইন্টার্ন বোন সাথে সাথে লেবার রুমে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এনাকে মেডিসিনে ট্রান্সফার নিয়ে নাও না দাদা।
পকেট থেকে বেড লিস্টের চোতাটা বার করলাম। ডিউটি শুরুর আগে ওয়ার্ডে রাউন্ড দিয়ে ফাঁকা বেড লিস্ট টুকে এনেছি। ক্রনিক ফিমেল ওয়ার্ডে দুটো বেড ফাঁকা। তাঁর মধ্যে একটা আবার পেয়িং বেড। পিজিটি ভাইটাকে বললাম, বাড়ির লোককে ডাক। কথা বলব।
লেবার রুমের দরজার সামনে মেয়েটির স্বামীর সাথে দেখা করলাম। বয়স ত্রিশের আশেপাশে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। অতিরিক্ত পরিশ্রমে দুই গাল ভেঙে গেছে। যুবকটির তালি দেওয়া প্যান্ট ধরে একটি বাচ্চা ছেলে আর বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের পোশাক আশাকের অবস্থাও ভালো না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ইনি পেয়িং বেডের খরচ চালাতে পারবেন না। বেড ভাড়া ত্রিশ টাকা হলেও সব পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওষুধ পত্রের জন্য টাকা লাগবে।
একেই ফ্রি বেডটা দেওয়া যাক। পরে ডেপুটি সুপারের বা সবুজ কালিতে লেখা ক্যাচ পেশেন্ট এলে তাকে পেয়িং বেডটা ধরিয়ে দেব। মেডিসিনে ট্রান্সফার লিখলাম। এডভাইস লিখলাম। কাল সকালে পেটের জল বার করে কী কী পরীক্ষা পাঠাতে হবে তাও লিখলাম।
বাইরে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি কমে গেছে। পায়ে হাটার রাস্তার দুপাশে পলিথিন পেতে বিছানা করে রোগীদের বাড়ির লোকজন শুয়ে পড়েছেন। আবার বৃষ্টি নামলে তল্পি তল্পা গুটিয়ে কোনো ছাউনির তলায় দাঁড়াবেন। খুব খিদে পাচ্ছিল। দু’নম্বর গেটের বাইরে গিয়ে একটা ডিম-টোস্ট, এক কাপ চা আর একটা সিগারেট খেলাম।
এম সি এইচ’এ ঢুকে দেখি অন কল রুমে কেউ নেই। মেডিসিনের অ্যাকিউট মেল ওয়ার্ডে ফার্স্ট ইয়ার পিজিটি ভাই আর ইন্টার্ন ভাইদের খুঁজে পেলাম। কিছুক্ষণ আগেই একজন সাপে কাটা রোগী ভর্তি হয়েছেন। সম্ভবত হিমাটোটক্সিক। ভর্তির পর রক্ত টেনে কুড়ি মিনিট কাঁচের টেস্ট টিউবে রাখার পরও রক্ত জমাট বাঁধেনি। তাকেই দশ ভায়াল এ ভি এস চালানোর প্রস্তুতি চলছে।
বললাম, কোনো সমস্যা নেই তো?
না দাদা, সব ঠিক আছে।
বললাম, সব নতুন রোগীদের তুইও একবার নোট দিয়ে রাখিস। আমি একেবারে ভোরে এসে আরেকবার দেখে যাব।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ল ক্রনিক মেলে একজন মোটর নিউরন ডিজিজের পেশেন্ট ভর্তি করেছি। পঁচিশ, ছাব্বিশ বছরের একটি ছেলে। শ্বাস কষ্ট নিয়ে এসেছিল। এমারজেন্সিতে নেবুলাইজেশন দিয়ে অনেকটা কমেছে। তাই ক্রনিক ওয়ার্ডে ভর্তি করেছি। এই রোগ খুব কমই পাওয়া যায়। ভর্তির সময় তাড়াহুড়োয় ভালো করে রোগের ইতিহাসও নেওয়া হয়নি। শারীরিক পরীক্ষাও বিস্তারিত করা হয়নি। এখন একবার দেখে এলে হয়।
ক্রনিক মেলের সিস্টার দিদি তখন টেবিলের আশেপাশের আলো নিভিয়ে টেবিলে মাথা নামিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। আমাকে দেখে বললেন, কী হলো ডাক্তারবাবু? আমি তো কোনো কল-বুক দিই নি?
বললাম, ঘণ্টা দেড়েক আগে যে রোগীকে ভর্তি করেছি, তাকে ভালো করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করব।
সিস্টারদিদি বিলক্ষণ অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, রোগী তো দিব্যি ভালো আছে। মনে হয় ঘুমাচ্ছে। কাল সকালে পরীক্ষা করলে হয় না।
বললাম, একবার দেখে আসি। রোগী যদি ঘুমান তাহলে আর জাগাব না।
ছেলেটি জেগেই ছিল। বললাম, কেমন আছ? আর দমের কষ্ট হচ্ছে?
ছেলেটি হাসল, বলল, এখন ঠিক আছি।
বললাম, তোমাকে কিছু জিজ্ঞাস্য আছে? কিছু শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে। তুমি কি এখন ঘুমাবে? তাহলে এখন না করে কাল ভোরে করব।
ছেলেটি বলল, এখনই করুন।
বললাম, দেখো, কোনো তাড়াহুড়ো নেই। তুমি ঘুমালে ঘুমাও। আমি সকালেও আসতে পারি।
ছেলেটি বলল, আর ঘুম। বহুদিন আমার ঘুম আসে না ডাক্তারবাবু। বাড়ির চারটে পেট যার উপর নির্ভর করে আছে, সে পঙ্গু হয়ে সারাদিন বিছানায় শুয়ে ঘুমাবে কী করে?
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মোটর নিউরন ডিজিজ রোগটি আসলেই মারাত্মক। শরীরের সব ঐচ্ছিক মাংস পেশী আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যায়। এতটাই দুর্বল যে আস্তে আস্তে রোগীর হাত পা নাড়ানোর ক্ষমতা থাকে না। এমনকি কথা বলার ক্ষমতাও ধীরে ধীরে চলে যায়। বিছানায় পাশ ফিরতে গেলেও অন্যের সাহায্য লাগে। অথচ রোগীর চিন্তা- ভাবনা করার ক্ষমতা, বিচার- বুদ্ধি একেবারেই ঠিক থাকে। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। রোগী আস্তে আস্তে খারাপ হয়। এবং এক সময় মারা যায়।
বললাম, এভাবে বলছ কেন? দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।
ছেলেটি বলল, আপনি ডাক্তার হয়ে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছেন কেন। আমি যে কিছুদিনের মধ্যে মারা যাব সেটা আমি জানি। তবে এভাবে তিলে তিলে মরে যাওয়ার থেকে, একেবারে মরে যাওয়া ভালো। কিন্তু দুর্ভাগ্য দেখুন, আত্মহত্যা করার ক্ষমতা টুকুও আমার নেই।
কী বলব? এসব কথার জবাব দেওয়া মুশকিল। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
ছেলেটি বলে চলল, আমি এথলেটিক্সে রাজ্যস্তরে দৌড়েছি। ১০০ মিটার ১১.৫ সেকেন্ডের কমে দৌড়াতে পারতাম। লেগে থাকলে আরও উন্নতি হতো। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর সব গণ্ডগোল হয়ে গেল। তখন রোজগারের জন্য কী না করেছি। তবু হার মানিনি। জানতাম ঠিক একদিন পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাব। আর আজ দেখুন সেই খেলোয়াড়ের কী অবস্থা। নিজের খাবার টুকু পর্যন্ত কেউ না খাইয়ে দিলে খেতে পারে না।
বললাম, তুমি বিশ্রাম নাও ভাই। আমি আসি।
ছেলেটি বলল, এখুনি চলে যাবেন। একটু পাশে বসুন না। আপনার সাথে কটা কথা বলি। এভাবে একা একা বিছানায় শুয়ে বাঁচা মুশকিল। ওই গানটা শুনেছেন? ‘বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না…’
বললাম, একটু জল খাবে?
ছেলেটিকে ঘাড় উঁচু করে জল খাওয়াচ্ছি, ফোনটা বেজে উঠল। এমারজেন্সি থেকে মেডিক্যাল অফিসার ফোন করেছেন। একটি মেয়ে অজানা কীটনাশক খেয়ে এসেছে। দেখে মনে হচ্ছে মৃত। আমি যেন তাড়াতাড়ি আসি।
দৌড়ে এম সি এইচ–এর সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম। ফাঁকা সিঁড়ি। দেওয়ালে পানের পিক আর গুটখার দাগ। নামতে নামতে ভাবছিলাম, আমাদের এই জীবনটা কত তুচ্ছ। তবু আমরা এই তুচ্ছ জীবনটার মোহে পড়ে থাকি। ভেবে পাইনা কী করব… কী করা উচিৎ এই জীবনটাকে নিয়ে।
কত রাগ, কত অভিমান, কত ভয়, কত সংশয় এই জীবনটাকে নিয়ে। তবে কখনো কখনো হঠাৎ কেউ চিরতরে চলে যায়… অথবা এই ছেলেটির মতো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আমাদের আমিত্বের অভিনয় এলোমেলো হয়ে যায়। আমি যদি সাহিত্যিক হতাম, তাহলে দুকলম হয়তো লিখতে পারতাম। সে ক্ষমতা আমার নেই। আমি শুধু যতটা পারি জীবনটাকে ভালোবেসে যাচ্ছি। একমাত্র ভালোবাসারই অলৌকিক ক্ষমতা আছে। যেটা এই তুচ্ছ জীবনটাকে একটা মানে দিতে পারে।