শুধু ডাক্তারী করলেই হয় না, ডাক্তারী যে করছি সেটা সারা বিশ্ব-কে জানানো দরকার।
আর শুধু ডাক্তারীই বা কেন? উচ্চশিক্ষার যে কোনো বিষয়ে, বিশেষতঃ যেখানে পঠন-পাঠন বা গবেষণা জড়িয়ে আছে- সেখানেই সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী, সহ-গবেষক বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের পঠন-পাঠন বা গবেষণার বিষয় বোঝাতে গেলে বক্তব্য রাখতে হয়। সেই বক্তব্য রাখতে সহায়তা করে কম্পিউটার এবং তার কিছু মাধ্যম। যেমন, মাইক্রোসফ্ট পাওয়ার পয়েন্ট বা অ্যাপল কী-নোট। কিন্তু চিরকাল এরকম ছিল না।
প্রথমে ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে এবং এঁকে পড়া বোঝানো হত। প্রফেসর সমর মিত্র বিভিন্ন রঙের চক দিয়ে পাশাপাশি দুটো ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে এবং এঁকে আমাদের অ্যানাটমির ক্লাস নিতেন। সেটা আশির শেষ এবং নব্বই-এর শুরু।
নব্বই-এর দশকে এল ওভারহেড প্রজেক্টর(OHP)। তাতে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের সিটে বিভিন্ন রঙের মার্কার দিয়ে লিখে তার ভিতর দিয়ে আলো দিয়ে সাদা দেওয়ালে বা সাদা পর্দায় সেই ছবি ফেলে ক্লাস নেওয়া বা সেমিনারে বক্তব্য রাখা চলত। সেইসব ওভারহেড প্রজেক্টর এখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়ে থেকে অতীতের সাক্ষ্য বহন করছে।
তারপর এল স্লাইড প্রজেক্টর। ক্যামেরায় ছবি তুলে সেই নেগেটিভ ফিল্ম (34 mm x 23 mm) সাদা চৌকো বোর্ডের ফ্রেমে মাউন্ট করে স্লাইড তৈরী হত। স্লাইডের বাইরের মাপ হত 2×2 ইঞ্চি। সেই স্লাইডগুলো পরপর স্লাইড প্রজেক্টরের লম্বা আয়তাকার বা গোলাকৃতি কারাউসেলে সাজানো হত। প্রজেক্টর চালু করলে একটা একটা করে স্লাইড প্রজেক্টরের লেন্সের সামনে আসে এবং স্লাইড প্রজেক্টরের ল্যাম্পের আলোয় লেখা ও ছবি দশগুণ বিবর্ধিত হয়ে পর্দায় প্রস্ফুটিত হয়।
ছবিগুলো তোলা হত ফিল্ম ক্যামেরায়। যার গুণমান আজকালের ফোনের ছবির থেকে অনেকগুণ ভালো। কোন মিটিং বা কনফারেন্সে বক্তৃতা বা আর্টিকল পড়ার জন্য একগুচ্ছ ফিল্ম স্লাইড তৈরী করাতে হত। কলকাতায় মূলতঃ দুটো জায়গায় এগুলো তৈরী করানো যেত। ধর্মতলায় কর্পোরেশন অফিসের কাছে ‘বোর্ন এন্ড শেফার্ড’ এবং পার্ক সার্কাসে ভানুবাবু-র দোকান ‘ল্যান্সডাউন আর্ট স্টুডিও’।
ভানুবাবু এক আশ্চর্য মানুষ। বি এন চক্রবর্তী থেকে শ্রীকুমার সরকার হয়ে ডি পি বক্সী- কলকাতার সব দেশ বিখ্যাত ডাক্তারদের ভরসার জায়গা ছিল ভানুবাবু। কারণ, ডাক্তারির ল্যাটিন শব্দগুলোর বানান ভানুবাবু ঠিকঠাক লিখত। ছবির ব্যাপারেও তার ভালো রকমের ধারণা ছিল। ভানুবাবু এমনকি মাইক্রোস্কোপে ক্যামেরা ফিট করে প্যাথোলজির স্লাইড থেকে মাইক্রো ছবি, যাকে বলে ফটোমাইক্রোগ্রাফ, তুলতে পারত।
এমন মৌচাকে বড় বড় মৌমাছির ভীড় হবে- সে আর আশ্চর্য কি! ভানুবাবুর দোকানেই অধুনা প্রয়াত প্রবাদপ্রতীম বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ প্রফেসর বি এন চক্রবর্তীকে প্রথম দর্শন করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সে ঘটনায় পরে আসছি। বরং ভানুবাবুর দোষগুণ নিয়ে কাটাছেঁড়া করি।
প্রতি কনফারেন্সের আগে ১৭ সৈয়দ আমীর আলি অ্যাভিনিউ-এ ভানুবাবুর দোকানে হত্যে দিয়ে থাকা ছিল আমার রুটিন। সেখান থেকে শেষ মূহুর্তে স্লাইড নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে শেয়ালদা বা হাওড়া ষ্টেশনে অথবা দমদম এয়ারপোর্টে হাতবদল করতাম অথবা নিজে কোনরকমে ট্রেন ধরতাম। কিন্তু কোনদিনই ছবি বা লেখা উল্টো করে মাউন্ট করে নি ভানুবাবু।
বেশীরভাগ ছবি তোলা হত আমার সিনিয়র জয়দীপ-দার জেনিথ এস এল আর ক্যামেরায়। ডিএসএলআর তখনো বোধহয় আসে নি। আমার থিসিসের আশ্চর্য সব ছবি তুলে দিয়েছিল জয়দীপদা।
১৯৯৮-এ বহরমপুরে অর্থোপেডিক কনফারেন্সে সেই থীসিসের বিষয় নিয়েই প্রতিযোগিতামূলক পর্বে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তার স্লাইড তৈরী করতে ভানুবাবুর কাছে গেছি। সেখানেই আলাপ হয়েছিল ডাঃ বি এন চক্রবর্তী স্যারের সাথে। টাইটেলে ডাঃ বক্সীর নাম দেখে উনি বললেন, ‘তুমি ডাঃ বক্সীর ছাত্র?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘কিন্তু বক্সী তো রিটায়ার করে গেছে।’
‘আমি ওনার শেষ পিজিটি।’
‘বক্সী আমার বিশেষ বন্ধু।’
‘জানি স্যার। উনি আপনার কথা বলেন।’
‘তুমি আমাকে চেনো ?’
‘হ্যাঁ।’
তারপরের একঘন্টায় উনি থিসীস, আরটিকল লেখা এবং স্লাইড তৈরীর বিষয়ে অনেক উপদেশ দিলেন- সে সব জ্ঞান জীবনের পাথেয় হয়ে আছে।
বহরমপুরের কনফারেন্সে একটুর জন্য প্রথম পুরস্কার হারিয়ে ছিলাম। তবে, সেই বিষয় নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ব্রাসেলস থেকে প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশনাল অর্থোপেডিক্স’ জার্নালে।
সেটা ২০০১ সাল। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সবে হামলা হয়েছে। আফগানিস্তানের যুদ্ধ। পৃথিবী লন্ডভন্ড। তার এক বছর আগে উত্তরবঙ্গের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চাকরি থেকে আর জি করে ফিরে এসেছি।
একদিন আর জি করে অর্থোপেডিক্স বিভাগে মুখবন্ধ খামে টাইপ করা একটা চিঠি এল ব্রাসেলস থেকে। চিঠির মূল বক্তব্য হল, আমাদের লেখাটা ‘ইন্টারন্যাশনাল অর্থোপেডিক্স’ জার্নালে প্রকাশনার জন্য গৃহীত হয়েছে। কিন্ত আমরা তাদের ইমেলের জবাব দিই নি। তাই প্রুফ দেখার কাজ করা যায় নি বলে আগামী সংখ্যায় সেটি প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তবে যেহেতু লেখা এবং গবেষণার বিষয়টা কৌতুহলুদ্দীপক, তাই পরের সংখ্যায় সেটা প্রকাশের আর একটা সুযোগ থাকছে।
আমার তখনো নিজের পার্সোন্যাল কম্পিউটার নেই। আর যোগাযোগ করার ইমেল যেটা দেওয়া ছিল সেটা আমার বসের। তিনি বছরে একবারও ইমেল চেক করেন কি না সন্দেহ। তখন প্রকাশক স্প্রিঞ্জার কোম্পানী কে লিখলাম, আমার দেশে ইন্টারনেট সব জায়গায় পাওয়া যায় না- তাই দেরী হচ্ছে। ওরা লিখল,
‘বুঝেছি, বুঝেছি। তোমাদের ওখানে তো যুদ্ধ হচ্ছে। তোমাদের আবার একটা সুযোগ দেওয়া হল।’
যেন টুইন টাওয়ারটা আমার বাড়ির দোরগোড়ায় ভেঙে পড়েছে। আর যুদ্ধটা একেবারে আমাদের পাড়াতেই লেগেছে!
যাই হোক, পড়ে পাওয়া সুযোগ পেয়ে আর জি করের সামনের ইন্টারনেট কাফে-তে দিনের পর দিন প্রুফ চালাচালি করে, একজন সাংবাদিক বন্ধুকে ধরে লেখার Abstract ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করিয়ে (এই জার্নালের লেখাগুলোর abstract-এর একটা ফরাসী অনুবাদও বের হত) সেই লেখা শেষ পর্যন্ত প্রকাশিত হল।
লিখতে লিখতে অনেক দূরে চলে এলাম। শেষের দিকে ভানুবাবুর দেরীতে বিরক্ত হয়ে দুটো কনফারেন্সের স্লাইড বোর্ন এন্ড শেফার্ড-কে দিয়েছিলাম। বোর্ন এন্ড শেফার্ডের ছবির গুণমান নিঃসন্দেহে ভালো। তবে লেখায় অজস্র ভুল। তাই আবার পুনর্মুষিক ভবঃ- ভানুবাবুর দোকানে ফেরত।
তারপর একসময় বোর্ন এন্ড শেফার্ড তো আগুন লেগে পুড়েই গেল!
শেষের দিকে অসুস্থ ভানুবাবুর জায়গায় ভানুবাবর ছেলে ষ্টুডিওতে বসত। মুশকিল হল, তার হাবভাব আর কথায় কথায় ইংরেজি বুলি। ভানুবাবুর ছেলে শুধু ইংরেজিই বলত না- অসহ্য রকমের ভুল ইংরেজি বলত। তখন ভানুবাবুর আস্তানাও বাধ্য হয়ে ছাড়তে হল।
তারপর তো এসে গেল মাইক্রোসফ্ট পাওয়ার পয়েন্ট। টুকরো স্লাইডের সেখানেই ইতি।