একটা বৃহৎ অংশের মানুষ মনে করেন হাতের কাজ, অফিসের কাজ করতে করতে টুক করে ডাক্তারকে ফোন করে জেনে নেবেন ‘টুবাইয়ের কাশির ওষুধ’, ‘হরেনের জেঠিমার পেটে ব্যথার কারণ’। এক শ্রেণীর ডাক্তার সেগুলো নিয়মিত করেও থাকেন, সব সময় যে খুব সাধু উদ্দেশ্যে তেমনটাও নয়।
এবার উল্টো দিকের ডাক্তারদের কথা শোনা যাক। যাঁরা ফোন ধরেন না..
১.
ধরুন, আপনি ‘টুবাইয়ের কাশির ওষুধ’ জানতে চেয়েছেন। ডাক্তার রোগের ইতিহাস আর রোগীর পরীক্ষা না করে কিছু একটা ওষুধ বলে দিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই কাশির কয়েক’শ কারণের মধ্যে ঠিক কী কারণে কাশি সেটা ডায়াগনোসিস না করেই তিনি ওষুধ বললেন। অন্ধের মতো এভাবে ওষুধ দিলে ডাক্তার আর হাতুড়ের মধ্যে কোনও তফাত থাকে না। দুজনেই কিছু না বুঝে ওষুধের নিদান দিচ্ছেন। এর ফলে রোগ আরও জটিল আকার নিতে পারে। হয়তো রোগীকে এখনই ভর্তি করা বা অন্য কোনও ইমার্জেন্সি চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে অনর্থক দেরি হতে পারে। তাতে রোগীর প্রাণ সংশয় হওয়াও অসম্ভব নয়।
২.
আগের পয়েন্টটা পড়েই আপনি লাফিয়ে উঠে বলবেন, ‘সেরকম অসুবিধে হ’লে কি আর ফোন করবো? ওই টুকটাক দরকারে..’
বিশ্বাস করুন, কোনটা টুকটাক রোগ আর কোনটা জটিল এটা বুঝতে খুব অভিজ্ঞ চিকিৎসকও প্রায়ই ভুল করেন। সে জায়গায় ফোনে শুনে.. নাঃ!! আমরা অতটা আত্মবিশ্বাস পাই না। আপনার চোখে সামান্য পেটে ব্যথাটা অন্ত্র আটকে যাওয়া কিংবা হার্ট অ্যার্টাকের জন্যও হতে পারে। তখন দ্রুত যথাযথ চিকিৎসা শুরু না করে পেটে ব্যথার ওষুধ খেয়ে গেলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
৩.
ফোনে বলা চিকিৎসায় কোনও ভুল হলেও ডাক্তার তার দায় নিতে আইনত বাধ্য। কেন ডাক্তার সাধ করে খাল কেটে কুমির ডাকবেন, বলতে পারেন?
৪.
প্রতি হাজার জন লোক পিছু ০.৭ জন ডাক্তার অনুপাতের দেশে একজন ডাক্তারের কাঁধে স্বাভাবিক ভাবেই প্রচুর চাপ থাকে। তাঁদেরও বিশ্রামের দরকার হয়। অবসর সময়ে ‘টক গন্ধের পটি’র গল্প শুনতে তাঁরও খুব একটা ভালো লাগে না। ভাবতে কষ্ট হ’লে অফিস ফেরত নিজেকে একটু ওই আসনে বসিয়ে ভেবে ফেলুন না..
৫.
অন্য সব কারণ বাদ দিয়েও একজন প্রফেশনাল যদি সোজাসাপ্টা ভাবে নিজের কাজের সময় বাদ দিয়ে কাজের আলোচনা না করতে চান তাঁকে কতোখানি দায়ী করা যায়? অন্যান্য পেশার কাউকে হাটে-বাজারে-টয়লেটে-রান্নাঘরে কাজের কথা শোনার আবদার শুনতে হয় বলে আমার জানা নেই। “*রামির বাচ্চা, পয়সার কাঙাল। তাই চেম্বারে ডাকে” বলে গালাগালি করে খানিক বুকের ঝাল ঝেড়ে ফেলতেই পারেন কিন্তু তাতে আপনার যুক্তির জায়গাটা সেই নড়বড়েই থেকে যায়।
ডাক্তারি একটি বিজ্ঞান, কোনও মন্ত্রপূতঃ বিদ্যা নয়। কাজেই, ফোনে শুনে ডাক্তার আপনাকে সঠিক উপদেশ দিয়ে দেবেন ভেবে থাকলে ভুল করছেন। ফোনের উপদেশে ওষুধ খেলে আপনার ক্ষতি হওয়ার আশু সম্ভাবনা। তার সাথে এটাও মাথায় রাখুন, ডাক্তারেরও একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে। সেটাকে সম্মান করতে শিখুন। হঠাৎ অসুবিধেয় সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকে না পেলে ফোন না করে আপনার নিকটবর্তী হাসপাতালে যান।
এবার ছবির উল্টো দিকটা দেখি। জীবন তো আর বইয়ের পাতা নয়, কাজেই ব্যতিক্রম থাকবেই। ধরুন, কোনও শিশু ডায়েরিয়ায় ভুগছে সাথে জলশূন্যতা। সেই অবস্থায় ডায়েরিয়ায় ভোগা শিশুর পেচ্ছাবের পরিমাণ বাড়লো কিনা অর্থাৎ জলশূন্যতা কমলো কিনা সেটা ডাক্তারকে জানানো দরকার। মেসেজে, হোয়াটসঅ্যাপে জানালে সেটা বে-আইনি হলেও মানবিক জায়গা থেকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তার মানে এই নয়, ‘ডাক্তারবাবু, একমাস আগে কাশির জন্য দেখিয়েছিলাম। বাচ্চার নাম মদন পাত্র। এখন পেটে ব্যথার জন্য কী ওষুধ দেবো?”.. এরকম কিছু জিজ্ঞেস করে বসবেন। আপনি ধরেই রাখুন, ডাক্তারের ওই ‘মদন পাত্র’-কে মনে নেই। কাজেই বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই, ফোনে তাঁর পক্ষে আপনাকে সাহায্য করা প্রায় অসম্ভব।
যদি কোনও কোনও বিশেষ ক্ষেত্রে মেসেজে ডাক্তারকে কিছু জানাতেই হয় তাঁর উত্তর দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করুন। পর পর কলের পর কল করে বিরক্ত করবেন না। তিনি হয়তো তখন আপনার নাক দিয়ে জল ঝরার চেয়ে অনেক আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করছেন। শেষে আবার একবার বলি, সেরকম ইমার্জেন্সি হলে ফোনের কথা না ভেবে সোজা হাসপাতালে নিয়ে যান।