রুকসানার বয়স এখন চব্বিশ। কিন্ত জীবন ঘড়ি যেন তাঁর বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে কারচুপি করে– হঠাৎ করে তাকে দেখলে ছত্রিশ কিংবা চল্লিশ বললে ভুল হবে না।
ছাপার শাড়ি পড়া, বড্ড সাধাসিধে রুকসানা যেন এই বাংলার হাজার হাজার গ্রাম্য মহিলাদের প্রতিনিধি। অল্প বয়সে বিয়ে, তারপর থেকে স্বামীর সংসারের ঘানি টানাটানি। ছোপ ছোপ দাগ পড়েছে মুখে।
ভালো করে তাকালে এখনো বোঝা যায় যদিও – চামড়ায় ভাঁজ পড়েনি। কিন্ত সেটুকু চোখে আর পড়ে কই? তার আগেই চোখে পড়ে – কালি। সে কালি কতকাল ধরে জমেছে চোখের নিচে, গালের এখানে ওখানে, গলার খাঁজে খাঁজে – সেই ইতিহাস পাওয়া যাবে না। জীবনে কোনদিন ফেসওয়াশ করা হয়নি– এটুকু একবার তাকালেই বোঝা যায়। ভেতরে ভেতরে হয়তো চলছে রক্তাল্পতা। বা অন্য কোন অসুখ। বা সবচেয়ে বড় অসুখ পেটের খিদে। হতেই পারে- কে পরিসংখ্যান নিয়ে বসে আছে এই দেশে??
হতেই পারে- একমাত্র উপার্জনকারী স্বামী কোনরকমে সংসার চালাতে পারে। হয়তো জমি জায়গা নেই। এসব তো কাহিনীতে থাকতেই পারে।কথাবার্তায়ও একদম আঞ্চলিক টান ।
কিন্ত তার মধ্যেও যেটা চোখে পড়ে- চোখ তুলে সোজা করে তাকানো। গহনা বা দামী পোশাকের বাহুল্য থাকার কথা নয়, নেইও!
আমার সাথে তাঁর পরিচয় হওয়া পেশাগত কারণে।
সত্যি বলছি, তা না হলে এখন এরকম একজন মহিলার সাথে পরিচয় হবার কথা বা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কথা শোনার চান্স এমনিতে খুব কমই। যদিও আশেপাশে হাজার হাজার এমন রুকসানা রয়েছে!
আর একটি কারণ হলো- গ্রাম ছেড়েছি বহুকাল। এখন গ্রামে যদিও বা যাই বহুদিন পর পর, এক আশ্চর্য নির্লিপ্ততা কাজ করে। কোথাও নতুন কারো সাথে বসে অকারণে ভাট বকা হয় না। অনেক বার ভেবেছি- যখন বাড়ি যাবো, সবার সাথে সারাদিন ধরে খোশগল্প করবো। অহেতুক এটা সেটা নিয়ে সময় কাটাবো। যা ইচ্ছে খুশি খাবো।
কিন্ত সে আর হয়ে ওঠে না।
কিন্ত এই রুকসানার সাথে হঠাৎ করেই একদিন পরিচয় হয়ে গেল। সেও প্রায় ছ’মাস আগে। সে বার সে এসেছিল স্বামীকে নিয়ে পরীক্ষা করাতে।
কেরালায় রাজমিস্ত্রির কাজ করা স্বামী, অসাবধানতাবশত কাজ করতে গিয়ে কোমরে হ্যাঁচকা টান লেগেছিল। তাই কন্ট্রাক্টর ক’দিন কাজ বন্ধ রাখতে বলায় , বাড়ি চলে এসেছিল। রুকসানা একরকম তাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল পরীক্ষা করাতে। স্বামী আসতে চায়নি টাকা খরচ হবে বলে। অথচ হ্যাঁচকা টান শুধু যে টান ছিল না, সেটা আমি আবিষ্কার করেছিলাম পরীক্ষা করে।
যখন বললাম- মেরুদণ্ডের একটা হাড় ভেঙেছে, এখন আর ওজন তোলার কাজ করা যাবে না কিছুদিন, রেস্ট নিতে হবে, রুকসানার স্বামী প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল- কাম না হরলে খামু কি? ঘর চলবি ক্যামনে?
আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখেছিলাম- রুকসানার মুখে হঠাৎ এক চিলতে হাসি খেলে গেল। পরক্ষণেই অন্ধকার।
– ও ডাক্তার, কদ্দিন ঘর থাহন লাইগবো?
ডাক্তার হয়ে তো আর সবার বাড়িঘর টাকা পয়সা ইনকাম- ইত্যাদি সব কিছু জানা হয় না, উচিত ও নয়। তাই কখনো কখনো নিয়ম মেনে যে সব উপদেশ দিয়ে ফেলি, সেটা হয়তো সব রোগীর পক্ষে মানাও সম্ভব হয় না। তবু বলেই ফেললাম- যতটা বেশি সময় বিশ্রাম নিতে পারবেন, ভালো হবে।
রুকসানা স্বামীর বিরক্তিকর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল- ঠিকাচে ডাক্তার।
এই স্বাভাবিক কথাবার্তার পর খেয়াল হলো- রুকসানা স্বামীকে ধরে নিয়ে চলে যাচ্ছে ।
অন্য কেউ সঙ্গে আসেনি কেন, এই প্রশ্নটা জেগেছিল, তবু জিজ্ঞেস করা হয়নি সেদিন।
তারপর আবার দেখা প্রায় তিন মাস পর। সে বার রুকসানা একা এসেছে। – ও ডাক্তার, সোয়ামি তো এহন মোটামুটি সুস্থ। কামে যাইতে চায়? আপনে কি কন??
আমি প্রোটোকল মেনে উত্তর দিই- এখন কি অবস্থা আছে না দেখে তো বলা যায় না। তবে একবার যেহেতু ভেঙেছে, ভারী কাজ না করাই ভালো। একবার নিয়ে আসলে বলতে পারতাম কি অবস্থা।
– আইতে চায় না। কয় , ডাক্তারের ধারে গ্যালে পয়সা খরচা।
– বাড়ি কতদূর?
এই প্রশ্নের উত্তরে রুকসানা হঠাৎই গল্পের মত বলতে শুরু করে। যা বললো, আমি আন্দাজ করলাম। চিনি না তো! অথচ রুকসানা হয়তো ভেবেছিল, আমি সব জায়গাই চিনি। বড় রাস্তা থেকে পায়ে হাঁটা পথ পেরিয়ে,
গ্রামের মসজিদের সামনে দিয়ে তিনটে বাড়ি পেরোলেই তাঁর বাপের বাড়ি। আর বড় রাস্তার এপারে সোয়ামির বাড়ি। আরো বলে ফেললো- একসময় সরকার জমি নিয়ে কিভাবে বড় রাস্তা বানিয়েছে। কিভাবে একই গ্রাম পরে দুই ভাগ হয়ে গেছে।
এসব কথা রুকসানার মত অনেকেই বলতে শুরু করেন। তাই একটুও আগ্রহ না দেখিয়ে বললাম- আচ্ছা। একদিন পারলে নিয়ে আসবেন।
রুকসানা কেমন যেন চুপ করে গেল। উঠছে না।
– কি সমস্যা? আর কিছু বলবেন? ওনাকে সাবধানে থাকতে বলবেন।
– আমিওতো হেডাই কই। বাড়ি থাইক্যা জমির কাম করতি পারে। সব্জি ব্যাচলে ও তো দুইডা মাইনসের অইয়া যায়। মোডে কতা হোনে না।
– বুঝিয়ে বলুন।
– হ আপনের কতা কমুনে।
অগোছালো শাড়ির পাড় কোমরে গুঁজতে গুঁজতে রুকসানা বেরিয়ে গেল।
আমরা যতটা দেখি, ততটাই যে মানুষের সব কিছু নয়, একজন মানুষকে একদিন দুদিন বা দশদিন দেখেও যে জানা যায় না, এই সত্যিটা আমরা মানতে চাই না।
কি জানি, হয়তো এই রুকসানা চাইছে স্বামী বাড়িতে থাকুক। সন্তান নেই যখন, তখন একলা একজন মহিলার পক্ষে থাকা কঠিন হয়ে ওঠে। হয়তো রুকসানার স্বামী চাইছে- তাদের ঝাড়াপোছা সংসারে এখন একটু পয়সা কামানোর সময়। বাইরে গেলে হয়তো এইসব কাজের চেয়ে ইনকাম বেশি হয়।
কি জানি। ডাক্তারের এতো গবেষণা করার সময় থাকে না। হয়তো ডাক্তারির জন্য এই ধরনের গবেষণা উপযুক্ত ও নয় সব সময়।
অতএব পরের রোগীকে দেখতে শুরু করি। প্রত্যেক রোগী এক একটা গল্প নিয়ে আসেন। কখনো তা লিখতে পারি, কখনো একঘেয়েমি এসে যায় আর দু’মিনিট পর ভুলে যাই।
এ গল্পও সেভাবেই শেষ হতে পারতো। কিন্ত হলো না। অতিমারীর ঠেলায় পড়ে শেষ তিন মাস সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ প্রায়।
শেষে ঠিক করলাম কাজ করতে হবে। কাজ না করে, কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। একটুখানি মন খারাপ লাগলো- এতোদিনের অলস জীবনযাপন ছেড়ে ফের একই কাজ দিনরাত করতে হবে!!
শেষ পর্যন্ত কাজ করতে শুরু করলাম। কাজ করার দ্বিতীয় দিন। হঠাৎ করে রোগীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো- কোথাও যেন দেখেছি। এখন মুখোশ সবার মুখে। তাই একপলকে মনে পড়ছে না। কি জানি রোগীও হয়তো আমাকে চিনতে পারতো, মাস্ক না থাকলে। এমন বহুবার হয়েছে, রোগী ছ’মাস একবছর পর এসেও বলে দেন- ডাক্তার বাবু আপনাকে দেখিয়ে ছিলাম অমুক জায়গায় বা তমুক অসুখের জন্য। ডাক্তারদেরও মনে থাকে, কিন্ত সেই সংখ্যা খুবই কম।
যাইহোক, রোগী চুপ করে শুয়ে আছেন। আমি পরীক্ষা করার আগে কাগজ দেখলাম- বাচ্চা নিতে চান।
একদম নন-মেডিক্যাল কারো লেখা। যাইহোক, নামটা দেখেই কেন জানি না আমার মনে পড়লো- সেই রুকসানার কথা। এর নামও রুকসানা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কি সমস্যা হয় বলুন।
এতোক্ষণ চুপ করে থাকা রোগী হঠাৎ মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেললো- ও ডাক্তার, আপনে?
মুখে খানিকটা আশার আলো জ্বলে উঠলো কি? কিন্ত কেন? সেবার তো স্বামীকে নিয়ে এসেছিল। এবার নিজেই।
– হুম। আমি। ডাক্তার ছাড়া আমি আর কার কে, নিজেই বুঝতে পারি না।
আমার মনে পড়লো- দু’বার আগে ইনি এসেছেন। তাই বললাম- আপনার স্বামী কেমন আছেন??
রুকসানা সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয়- ভালো। তার মুখের উজ্জ্বলতা ঢাকা পড়ে গেল যেন স্বামীর কথা শুনে। কেন?
– আচ্ছা, এবার বলুন কি সমস্যা আপনার??
কি জানি আমাকে কি ভাবলো। তারপর বললো- ডাক্তার আপনেরে কয়ডা কতা জিগামু। হাচা কতা কইবেন কিন্ত।
ওরে বাবা! এ আবার কেমন কথা? আমার মিথ্যা বলার প্রশ্ন আসছে কেন? রোগীর সমস্যা থাকলে বলবো, না হলে বলবো- নেই!! মিথ্যা বলার কোন দরকার আছে বলে তো মনে হয় না।
– অবশ্যই। বলুন।
রুকসানা ফের হয়তো কোন আশার আলো দেখতে পায়। সে মুখ দেখে বোঝা যায়- কাউকে কিছু কথা কখনো বলা হয়নি। অথবা কাউকে বলার পর প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে। তবু এই রুকসানা, যাঁর সাথে আমার পরিচয়ের পর্ব বললাম, সেই ঘাড় সোজা করে তাকানো রুকসানা, চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারা রুকসানা, একটু জ্বলে উঠেই ফের মিইয়ে গেল।
যদিও কি বলবে তার হদিস আমার জানা নেই, তবু বারবার মনে হচ্ছিল- বলুক না! বলুক না কি বলতে চায়। আজ না হয় একটু ডাক্তারির বাইরের গল্পই শুনে নেব। জীবনে হাজার মানুষের হাজার গল্পের কত কিছুই তো জানা হয় না, শোনা হয় না। আজ না হয় একটা গল্প শোনা হবে। তারপর পরীক্ষা করবো। বললাম- বলুন।
রুকসানা ফের একটু সোজা হয়ে বসে।
– ডাক্তার, মোর যহন বিয়া অয় হেরও আগে থেইক্যা ওইডা আয় না।
– ওইডা মানে কি ?
লজ্জা পেল রুকসানা। কেন?
– ওইডা মানে অইলো মাইয়াগো যেডা অয়- মাসিক।
– কখনোই হয়নি?
– না তো।
– তা আগে কখনো ডাক্তারকে বলেননি?
আমার মাথায় ডাক্তারি ঘুরতে থাকে। কখনোই রজঃস্রাব না হবার কারণ মাথায় জমাতে থাকি। নানান রকম কারণ আছে। বেশ কয়েকটি হলো জন্মগত।
– কমু ক্যামনে?
– এখন কি ভাবে বলছেন? হাসলাম।
– ও ডাক্তার (একটা কথা বলি, এই ও ডাক্তার বললেই আমার সেই রোগীকে কেমন যেন লাগে। অকারণে ডাক্তারবাবু না বলে ও ডাক্তার বলে কেমন নিজের অজান্তেই আমাকে খানিকটা আপন করে নেয় এইসব রোগীরা। কেন জানি না!), তাইলে হোনেন। মোগো গেরামে তহনও পেরেম কইরা কাউর বিয়া অয় নাই। আমাগো পেরথম। (মুখে একটু হাসি খেলে গেল কি? লজ্জাও?) হের পর তো ঝামেলা। কেউ মাইন্যা লয় না। বাপ-মার ঘর থেইক্যা বাইরাইয়া সোয়ামিরে লইয়া ছিলাম ভাড়ায়।
গল্পের খোঁজে আমি একটু প্রশ্ন করলাম- কেন মেনে নেয়নি?
আশেপাশে তাকিয়ে রুকসানা বলে- এক গেরামের ছাওয়াল, হের উপ্রে …
– তারপর?
– সোয়ামি তো হেই বিয়ার পর থেইক্যা গ্যালো কামে। ওই যে আপনেরে দেহাইলাম হেরও বচ্ছর দুই আগে।
– এর মাঝে আপনি ডাক্তারের কাছে যেতে পারতেন। যাই হোক বলুন।
– কইতারি নাই কাউরে। আব্বু আম্মুর লগে ঝগড়া অই বিয়া লইয়া। ওগো বাড়িতে ও ন্যায় না। কারে কমু?
– হুম। তা আপনারা থাকেন কোথায় এখন?
– আগে তো ভাড়ায় ছিলাম। হের পরও কিচু টাহা কামাইলো, আর আম্মু কিচু টাহা লুকাই লুকাই দিল। হেই দিয়া জাগা কিনচি। ঘর করচি।
– বাহ্। আপনার বাবা-মাকে বলতে পারতেন।
– আব্বু হোনে না। কয় মোর নাহি ধম্মো গ্যাছে।
বুঝলাম না কিছুই। এর মধ্যে ধর্ম আসে কোত্থেকে? প্রেম করে বিয়ে করেছে, এই তো! অবশ্য গ্রাম বাংলায় কত কিছু যে আছে তার হদিস নেই আমার কাছে।
– আচ্ছা। তারপর বলুন।। আমি খানিক ব্যস্ত হই।
– হেবার সোয়ামির যহন হাড় ভাইঙলো, হের পর তো বাড়িতেই ছিল আপনের কতা হুইন্যা। এহন কয় বাচ্চা নিমু। মাসিক না অইলে বাচ্চা অয় না বুঝি?
আমি ডাক্তারিতে ফিরলাম। বুঝলাম- বিয়ের অনেকদিন পর এটা স্বাভাবিক। সবাই বাচ্চা নিতে চায়।
– দেখতে হবে কি সমস্যার জন্য হচ্ছে না।
– হ ডাক্তার, দেহো। মুইও তো বাচ্চা নিমু। হক্কলে কয় তোর বাচ্চা আইবো না। হেই নিয়া ঝামেলা।
মা হবার জন্য, হতে না পারার জন্য একজন বিবাহিত মহিলার এই অবস্থায় কি কি ঝামেলায় পড়তে হয়, তার কিছুটা আমি ও জানি।
প্রথমতঃ তাঁকে বাজা বলে দেগে দেয়া হবে। নানা রকম কুসংস্কার তুলে তাঁকে দোষী করা হবে। সব রকমের মন্দের জন্য দায়ী করা হবে তাঁকে। হয়তো ঝড় বৃষ্টির জন্য, বাজ পড়ার জন্য, অ্যাক্সিডেন্ট এর জন্য, গলায় ভাত আটকে কাশি হবার জন্য, পাশের বাড়িতে পেট হবার জন্যও দায়ী হবে তাঁকে! বড্ড কাছের মানুষও তাঁকে ঠেলতে শুরু করবে দূরে। এই অসহ্য যন্ত্রণা যে কি, আমরা বহুবার দেখেছি। তাঁর কোথাও যাবার জায়গা থাকে না ডাক্তারের কাছে ছাড়া। তারপর চিকিৎসায় কোন কাজ হলে ভালো, না হলে সারাজীবন ধরে অবর্ণনীয় এক অত্যাচার সহ্য করে যেতে হয়। এ সমাজ এখনো মানতেই শেখেনি- এসব খুবই স্বাভাবিক।
স্বামী স্ত্রী — দুজনেরই সমস্যা থাকতে পারে। কিন্ত এদেশে মহিলাদেরকে দোষী করা হয় একশো শতাংশ ক্ষেত্রে!
ঝামেলা আর শুনলাম না। বললাম- শুয়ে পড়ুন।
সহকারীকে বললাম- সব লিখে রাখো।
রুকসানার মুখের দিকে তাকালাম আড়চোখে। কিচ্ছু বোঝা যায় না এই একবার দেখে।
জিজ্ঞেস করলাম- স্বামীর কোন সমস্যা নেই তো?
– না।
– আচ্ছা।
বাকি কাজটুকু মুখ বুজে করে ফেললাম।
রিপোর্টের ডিটেইলসে লেখার জন্য নয়। সংক্ষেপে বলি- রুকসানার যা সমস্যা সেটা হলো- তার গর্ভাশয় এবং দু’টো ডিম্বাশয়ের কোনোটাই তৈরি হয়নি। জন্ম থেকেই। কখনো কখনো এমন হয়। এগুলো তৈরি হলেও সেগুলো এতো ক্ষুদ্র বা কার্যক্ষমতাহীন যে কোন পরীক্ষায় ধরা পড়ছে না। অর্থাৎ, রুকসানার স্বাভাবিক উপায়ে মা হওয়া সম্ভব নয়।
এটুকু লিখলাম। এবার এই খানিকটা পরিচিত রুকসানাকে এই পুরো ব্যাপারটা যে বলবো- কিছুতেই সাহস জোগাড় করতে পারছিলাম না। অথচ রুকসানা একটু আশার কথা শোনার জন্য তাকিয়ে আছে। আশা আর অসহায়তার মিশ্রণে সে মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম- এই কালচে ছোপ পড়ে যাওয়া মুখ, এই সোজা করে তাকানো রুকসানা হয়তো এরপর ডুবে যাবে আরো অন্ধকারে। তার মাথা নিচু হয়ে যাবে সবদিনের জন্য ।
এ সমাজ এই জন্মগত সমস্যার রিপোর্ট মানবে না, জানবে না, বুঝবে না!!
বললাম- আপনি বাইরে বসুন। সঙ্গে কে এসেছে, তাঁকে ডাকুন।
সহকারী এরকম কিছু সিচুয়েশন আগেও দেখেছে। তাই নিজের থেকেই চলে গেল বাড়ির লোক ডাকতে।
রুকসানা যতই গ্রামের মহিলা হোক, সে বোঝে কোথাও একটা বড়সড়ো গোলমাল আছে। তার মুখ ক্রমশঃ কালো হতে শুরু করে।
আর্তির মত গলায় প্রশ্ন করে- কন না কি অইচে?
– বলছি।
– ও ডাক্তার, কেউ আহে নাই। মোরে কন।
– কেন?
এই প্রশ্নটা যে আমি কেন জিজ্ঞেস করলাম, নিজেও জানি না। উত্তরে যেটা এলো সেটা স্বাভাবিক নিয়ম, অথচ বুক ভেঙে দেয়ার জন্য যথেষ্ট!
– ও ডাক্তার, আপনে বোজেন না, গেরামের মাইনসে এডা ওডা কয়। সোয়ামির লগে এই লইয়া ঝামেলা! মুই তো বাপের বাড়ি থাহি এহন। কি অইচে কন দেহি?
বললাম- শুনুন, আপনার পক্ষে স্বাভাবিক উপায়ে মা হওয়া সম্ভব নয়। বাকিটা নিয়ে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলবেন।
– ক্যান ক্যান? কি অইচে?
যতটা পারলাম বুঝিয়ে বললাম। রুকসানার মুখের দিকে তাকাতে পারিনি আর। আমি সত্যিই জানি না এই মহিলার এরপর কি হবে। সোয়ামি মেনে নেবে না হয়তো, সোয়ামির পরিবার, সমাজ সবাই দোষ দেবে, প্রেম করে বিয়ে করার খোঁটা দেবে, বাপ-মার দোষ দেবে। আরো কি কি যে হবে ভাবতে পারছি না।
যাইহোক, গল্পটা এখানেই শেষ করতে হবে ভেবে মাথায় ডাক্তারি নামক স্যানিটাইজার ছিটিয়ে দিলাম। আর নয়। অন্য রোগী দেখতে হবে। অসহায়তার জীবাণু বেশিক্ষণ বাঁচিয়ে রাখলে ডাক্তারি করা যায় না।
কয়েকজন রোগী দেখলাম। মনটা কেমন হয়ে আছে। সহকারীকে বললাম- খানিকটা সময় আমি রেস্ট নেবো।
রেস্ট রুমে বসে আছি। একজন এসে বললো- স্যার আপনার সাথে একজন রোগীর বাড়ির লোক কথা বলবে।
– পাঠান।
যিনি ভেতরে এলেন, তিনি আর কেউ নয়। রুকসানার স্বামী । আমার মুখটা কেন জানি না ছ’মাস আগে দেখা হলেও মনে পড়লো। কিন্ত আজ একটা খটকা লাগলো। রুকসানার স্বামী ইনি? অবাক হলাম স্বাভাবিক নিয়মেই। বুঝলাম, কোন কারণে হয়তো বউয়ের পরীক্ষা করানোর খবর পেয়ে চলে এসেছেন। বললাম – আপনি রুকসানা র স্বামী তো?
– হ।
– শুনুন, ওনার যা সমস্যা, তাতে স্বাভাবিক উপায়ে মা হতে পারবেন না।
ভদ্রলোক কেমন যেন হয়ে গেলেন।
– কোনদিনও অইবো না?
– না । বাচ্চা নেবার অন্য উপায় দেখুন।
সে উপায় ডিটেলে বলা আমার কাজ নয়। তার জন্য অনেক পরীক্ষা করতে হয়, টাকা পয়সা খরচও যথেষ্ট।
– আইচ্ছা ডাক্তার বাবু, অন্য উপায় কি? দ্যাহেন , কি সমোস্যায় পড়চি। বাইচ্চা অইবো না তো অইবো না, মাইনসে কি কইচে হেই লইয়া ঝগড়া। রুকসানা বাপের বাড়ি চইল্যা গ্যাচে। এহন হক্কলে মোরে খারাপ কতা কয়। মুই নাহি বউরে তাড়াইচি! মুই ক্যান ওরে তাড়ামু? এট্টু বুজাইয়া কন ওরে।
বললাম- আপনাদের তো প্রেম করে বিয়ে। ওকে বোঝান এটা তে কারো দোষ নাই। আর বাচ্চা নিতে চাইলে অন্য উপায় আছে সেটাও বলুন। দত্তক নেয়া যায়। কারো কথা শুনে লাভ নেই। লোকজন বোঝে না।
রুকসানা এতোক্ষণ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছু না বলেই ঢুকে পড়লো।
– ও ডাক্তার, মাইনসেরে বুজামু কি? এই পোদীপডারে ই তো বুজাইতে পারচিলাম না। মুই কি বাচ্চার লাইগা ওরে বিয়া করচি? ধম্মো ছাইড়া হিঁদুর বউ অইচি কিসের লাইগ্যা? এক লগে থাকতি বাচ্চা লাগবি ক্যান?
আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম।
কথাগুলো কেমন যেন আলাদা। হ্যাঁ আলাদাই। এই রুকসানা আলাদা। এই রুকসানার স্বামীও – কতকটা হলেও আলাদা। না হলে এই ঘটনা খুব বেশি ঘটে না। এতোকিছুর পরও স্বামী, যে বাড়িতে ঝগড়াও করেছে আবার স্ত্রীকে না জানিয়ে চলেও এসেছে পিছু পিছু- সে আলাদাই। এসব কিছু ভাষায় প্রকাশ করা আমার সাধ্য নয়।
বললাম- আপনারা দুজনেই বাড়ি যান। একসাথে বসুন। তারপর ঠিক করুন কি করবেন। সেইমতো ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। আর কিছু বলার নেই আমার।
গল্পটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে।
রুকসানা স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে- হ ডাক্তার ঠিক কইচেন। চল বাড়ি যাবি।
পোদীপ বউয়ের দিকে তাকায়।
আমি ফের কাজে বসে যাবার জন্য বেরোলাম।
রুকসানার স্বামী ফের বলছে- রুকু বাড়ি চল। বাচ্চা ফাচ্চা লাইগবো না মোগো।
রুকসানার মুখ টা এখন আর আমি দেখতে পাচ্ছি না। বোধহয় আবার ঘাড় ঘুরিয়ে একটু হেসে সেও তাকিয়েছে সোয়ামির দিকে।
হয়তো সেই হাসির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে তার মুখের কালো ছোপ ছোপ দাগ। হয়তো সোয়ামিকে বলছে- পোদীপ তুই থাহিস, বাইচ্চা ফাইচ্চা লাগবো না।
আমি কাজ করতে করতে হাসলাম একটু। একটা জীবন, একটা সংসার, একটা কঠিন বাস্তব,তাকে না মেনে নিতে পারার যন্ত্রণা, অন্য উপায় খোঁজা, একটা দুর্বোধ্য সামাজিক নিয়মনীতি কুসংস্কার- এই সবের ভেতর বেঁচে থেকে এরপর থেকে রুকসানা আর পোদীপের একটা বড় গল্পের শুরু হবে।
সে গল্প দু’টো জীবনের। ভালোবাসার।