দিশা খোঁজার যাত্রা
আবার ডেট্রয়েট। ফিরে আসা। পুরোনো বন্ধুরা ওকে জানালে সুস্বাগতম। ডেট্রয়টে কিছুদিন থাকার পর চলে এলো নিউইয়র্ক। ওখানে স্টেট টিউবারকিউলোসিস হাসপাতালে কিছুদিন কাজ করার পর, ১৯২৯, নভেম্বরে ও যোগ দিলো রয়্যাল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে, ডাক্তার এডোয়ার্ড আর্চিবল্ডের কাছে। যিনি এই ধরণের চিকিৎসার পথপ্রদর্শক। সেখান থেকে কানাডার গেলো কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওখানে নর্ম্যান এখন শিক্ষক।
কিন্তু ফ্রান্সেস, তার কি হলো? নর্ম্যান কি তাকে ভুলে গেলো? না। চিঠিপত্র চলতো নিয়মিত, অনেকটা রোজনামচা র মতো। “তুমি আমাকে দেখলে চিনতে পারবে না ফ্রান্সেস, আমি বদলে গেছি”
“তুমি আর আমি নাহয় এক শহরে আলাদা আলাদা থাকবো। তবু তো কাছাকাছি থাকবো, সত্যিকারের বন্ধুর মতো”। মনে হচ্ছে ক্ষ্যাপাটে ডাক্তার নয়, শেষের কবিতার অমিত রে’ লাবণ্যকে চিঠি লিখছে।
নিস্তব্ধ অপারেশন থিয়েটার। হঠাৎ নর্ম্যান চিৎকার করে উঠলো। ইস্পাতের পাঁজর কাটা যন্ত্রটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো।
হয় না, এই সব পুরোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে সূক্ষ্ণ অপারেশন হয় না। অপারেশনের পর ডুবে গেলো নতুন যন্ত্রের নকশা তৈরি করতে। তৈরি হচ্ছে একের পর এক নতুন যন্ত্র। আমেরিকায় ডাক্তার আর্চিবল্ড আর নর্ম্যান বেথুন ছাড়া কেউ এই অপারেশন নিখুঁত ভাবে করতে পারে না।অপারেশনের সময় পাঁজর টেনে রাখার একটা যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেললো। “আয়রন রিট্র্যাক্টার”- হয়তো এখনও ব্যবহার হয়। পাঁজর কাটার একটা যন্ত্র তখন ব্যবহার হতো। ভালো কিন্তু নর্ম্যানের পছন্দ নয়। একদিন রাস্তায় এক মুচির জুতো সারানোর যন্ত্র দেখে তৈরি হলো বেথুন রিব শিয়ার্স। যন্ত্রটা ফ্রান্সেসকে দেখিয়ে নর্ম্যান শিশুর আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো।
ও হ্যাঁ। আবার প্রেম জিতেছে। ফ্রান্সেস আর নর্ম্যান দ্বিতীয় বার বিয়েটা একদিন সাক্ষাতেই সেরে ফেলেছে। কিন্তু ফ্রান্সেস এই উন্মাদ ডাক্তারকে নিয়ে অসুখী হয়ে পড়েছিলো। দিন নেই রাত নেই শুধু কাজ আর কাজ। ক্ষ্যাপার মতো কাজ করা। ফ্রান্সেসের জীবনে তখন দ্বিতীয় পুরুষ এসে পড়েছে। যেদিন নর্ম্যান ভুল করে একটা মানুষের লিভার এনে ফ্রিজে রেখে’ একটা কঙ্কাল নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করেছে, সেদিন ফ্রান্সেস বেরিয়ে গেলো। নর্ম্যান একটা মস্তো পুতুল এনে ওর বিছানার পাশে রেখে দিলো। এটা ওদের সন্তান। ফ্রান্সেস আবার আসবে, অন্ততঃ বাচ্চাটাকে দেখতে আসবেই। এই রকম তীব্র একমুখী প্রেম।
এরপর আবার কাজের ঝড়।
একটা ছোট্ট মেয়ে। সদ্য কিশোরী। দুটো ফুসফুস যক্ষ্মায় আক্রান্ত। বাঁচার আশা নেই। একদিন রাউন্ডে গিয়ে নর্ম্যান শুনলো মেয়েটা কাঁদছে “আমি বাঁচতে চাই। ভীষণভাবে বাঁচতে চাই। একটা চুম্বন, মৃত্যুর আগেও আমি পাবো না,…”
নর্ম্যান স্তব্ধ হয়ে গেল। এক মুহূর্ত। তারপর সেই সূর্যমুখী ফুলের মতো কিশোরীর ঠোঁটে চুমু খেলো। নার্স এই ভয়ানক ছোঁয়াচে রুগীর কাছ থেকে নর্ম্যানকে টেনে সরিয়ে আনলো। এক মৃত্যুপথযাত্রীকে এক ডাক্তার আর কিই বা দিতে পারে? এই ভালবাসা ওকে অনন্য করে তুলেছে।তবে এর মধ্যে অনেক অনেক মর্যাদা নর্ম্যানের কপালে জুটেছে।
এবার দুটো তিনটে ঘটনা লিখে এই পর্ব শেষ করবো।
একদিন ফ্রান্সেস নর্ম্যানের ফোন পেলো। “এক্ষুণি চলে এসো। তোমার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া দরকার।” এ ভিক্ষা আর আদেশের এক মিশ্রণ।
“একজন রোগী মারা গেলো…অপারেশন করেছিলাম.. একজন রোগী মারা যাওয়া মানে, আমার শরীরের একটা অঙ্গ বাদ চলে যাওয়া….”
নর্ম্যান অস্থির হয়ে ঘরে পায়চারি করছে। ফ্রান্সেস ছাড়া কেই বা আছে, যাকে সব কথা বলা যায়?ফ্রান্সেস নর্ম্যানকে বুকে টেনে নেয়।
“মারা গেল, অপারেশন টেবিলে। কোথায় আমার ভুল?”
“তোমার তো কোনও দোষ নেই। মৃত্যু আছে থাকবে, এটা সত্যি”
“তাকিয়ে দেখো, সারি সারি বাড়ির সারি। আমাদের ওখানে যেতে হবে। জানো ভারতবর্ষের শিশু মৃত্যুর সংখ্যার পরেই মন্ট্রিয়ল আর কুইবেক শহরের শিশুমৃত্যু। ঐ যে দূরে দেখছো ঝাপসা দিকচক্রবাল.. ঐ খানে, দরকারে টাকা, ওষুধপত্র আমরা সরকারের কাছ থেকে আদায় করবো, সেই টাকায় ওদের খাবার, চিকিৎসা হবে”
নর্ম্যান হঠাৎ ফ্রান্সেসের হাতদুটো ধরে বললো “ফ্রান্সেস আমি কি স্বপ্ন দেখছি? তোমার কি মনে হয়?”
“আমি এরকম অদ্ভুত কথা জীবনে শুনিনি”
এরপর নর্ম্যান গেলো রাশিয়ায়,কনফারেন্সে। ওখানে তখনও পুরোপুরি সমাজতন্ত্র হয় নি।কানাডার সঙ্গে তখন রাশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন। এই ভ্রমণের বিস্তারিত লেখা অসম্ভব।কিন্তু নর্ম্যান দেখলো ওখানে স্যানাটোরিয়ামগুলো অনেক ভালো। রোগীদের অনেক বেশী সুবিধে। সব থেকে বড়ো কথা সব কিছু সরকারি খরচে। যেটা নর্ম্যানের স্বপ্ন ছিলো।
“কেউ যদি আসন্ন প্রসবা কোনো নারীকে দেখে তাহলে তার মনে হবে একটা কুৎসিত দৃশ্য।সোভিয়েত রাশিয়াও এখন সেই অবস্থায়। এর শেষে কিন্তু আছে একটা নতুন প্রাণ। একটা সুন্দর জীবন।”
চতুর্থ পর্ব শেষ।