জেগে উঠলো মানবসন্তান
ইভেত
“বিশ্বাস করুন, আমরা আপনার কাছে দয়া দাক্ষিণ্য চাই না। আমাদের সর্বস্ব আমরা আপনাকে দেবো…..ইভেত আমাদের একটা মাত্র মেয়ে”
নর্ম্যান জানে মেয়েটার একটা ফুসফুস যক্ষ্মায় পচে গেছে। একটা দ্বিধা কাজ করে। “আমি কি ওকে ধীরে ধীরে মরতে দেবো? নাকি অপারেশন টেবিলে হত্যা করবো? বড্ড দেরী করে এসেছে…” এই অবস্থায় অপারেশন মানে হত্যা করা।
……
“খুব সাবধান, এবার ফুসফুসটা কেটে বাদ দিতে হবে। গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ধারা।….আরো অক্সিজেন চাই তাড়াতাড়ি করো। ওঠা নামা করছে একটা মাত্র ফুসফুস।
….হ্যাঁ সমস্ত রাত্রি আজ আমি ঘুমাতে পারবো। ইভেত এখন ভালো আছে। এবার আমি ঘুমোতে চাই….”
তখন স্পেনে চলছে অত্যাচারের চরম। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সাধারণ মানুষের।
“একই চাঁদ কিন্তু কাল রাতে উঠেছিল
স্পেনের বিদীর্ণ পাহাড়চূড়ায়।
রক্তিম,বন্য,
উজ্জ্বল তার ঢালে প্রতিফলিত
মৃতদের রক্তাক্ত মুখ”
–নর্ম্যান বেথুন
নর্ম্যান উইলে লিখে দিলো ওর মৃত্যুর পরে ফ্রান্সেস হবে ওর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। চলে গেল স্পেনের গৃহযুদ্ধে। ওর কাজ আর্তের পাশে থাকা। ওর কাজ পৃথিবীর সবাইকার জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু করা। তার জন্য সেটা স্পেন না বলিভিয়া, তাতে কিছু এসে যায় না।
একটা আলোর চ্ছটা ছুটে এলো। ফেটে গেল কামানের গোলা, কেঁপে উঠলো মাটি। আহতদের স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হচ্ছে। একটা ষোলো সতেরো বছরের ছেলে। চাঁদের আলো এসে পড়লো মুখে। অর্ধমৃত কিশোর, শুকনো ঠোঁট, বসে যাওয়া গাল, বুঁজে আসা চোখ। আরেকটা বোমা ফাটলো। সবাই মাথা গুঁজে কান চেপে বসে পড়লো। তারপর আরেকটা, শত্রু সেনা লক্ষ্য বস্তু খুঁজছে। কিন্তু নর্ম্যান দাঁড়িয়ে আছে, অবিচলিত। হাতে রক্তের বোতল। রক্ত ঢুকছে কিশোরের রক্তশূন্য শরীরে। ইউনিফর্ম পরা ছেলেটার শরীরে প্রাণের লক্ষণ দেখা গেলো। নিশ্চিন্ত ভাবে একটা সিগারেট ধরিয়ে ছেলেটার ঠোঁটে গুঁজে দিয়ে ক্ষ্যাপা ডাক্তার পরশপাথরের খোঁজে এগিয়ে গেলো। পরশপাথরের নাম রক্ত। অ্যালভারেজ রুইজ নামের এক কম্যান্ডারকে বললো “রক্ত চাই, অনেক রক্ত”।
আজ এমন একজন মানুষ এসেছে স্পেনের সাধারণ মানুষের যুদ্ধক্ষেত্রে, যে পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দিতে চায়। যে এসেছে রক্ত ঝরাতে নয়, রক্ত দিতে। এসে নেতাদের বোঝালো রক্ত লাগবে এবং কেন লাগবে। (আমরা ল্যান্ডস্টাইনার, দে কাস্তেল্লো, স্টার্লি আর রিচার্ড লুইসেন-এল এগট’রের গবেষণার বিস্তারিত আলোচনা করছি না) কমিটির অনুমোদন ছাড়াই নর্ম্যান সোরেনসন’কে নিয়ে প্যারিস চলে গেলো ব্লাড ব্যাঙ্কের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনতে। লন্ডনে চিঠি পাঠালো টাকা চেয়ে।
এবার চিন্তা হলো রক্তদাতা যোগাড় করার।
আগের রাতে নর্ম্যানের উত্তেজনায় ঘুম হয়নি-কেউ যদি না আসে? এতো আশা, টাকা-সব বৃথা যাবে। মাঝরাতে তাকিয়ে দেখে রক্তদান কেন্দ্রের সামনে হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়ে আছে।বন্ধুদের রক্ত লাগবে, আমরা রক্ত দিতে চাই। যুদ্ধক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ ব্লাড ব্যাঙ্ক তৈরি হলো।
ইটালির মুসোলিনি তখন নিয়মিত বিমান নিয়ে শরণার্থী সঙ্কুল শহরে বোমা ফেলছে। বড়ো বড়ো গর্তের ভেতরে নর্দমার পাইপের সঙ্গে, আসবাবের সঙ্গে, পড়ে আছে মৃতদেহের সারি।নর্ম্যান চলেছে যুদ্ধক্ষেত্রে। ব্লাড ব্যাঙ্ক নিয়ে। রাস্তায় সারি সারি অগণিত মানুষ। বিবর্ণ ঘরছাড়া মানুষের দল। মেয়েদের কান্না, শিশুদের কান্না, জন্তুদের চিৎকার- যতদূর দেখা যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। কেবল হাজার হাজার মানুষ, একে অপরের ঘাড়ে পড়ে, ঠেলাঠেলি করে আসছিল।এরা মালগা’য় সাধারণ মানুষের বাহিনী হেরেছে বলে পালিয়ে আসছে। তার মানে গত পাঁচদিন ওরা একটানা হাঁটছে। ঐ যে বৃদ্ধা, যার পায়ে দগদগে ঘা, সেও তো হাঁটছে। গর্ভবতী মেয়েগুলো।স্পেনের সূর্যও তখন ফ্যাসিস্টদের মতো নিষ্ঠুর। এদের পেছনে রয়েছে সার বাঁধা অশ্বারোহী বাহিনীর গুলি খাওয়া, আহত সৈন্যরা। তারাও এখন আশ্রয়, চিকিৎসা চায়। চোখ কোটরে ঢোকা।গ্লানি আর বিষণ্ণতায় মোড়া আহত শরণার্থী। একটা পেট্রোলহীন থেমে থাকা বাসের পেছনে পড়ে আছে এক একলা শিশু। বুড়ো আঙুল মুখে পুরে সে একটানা কেঁদে যাচ্ছে। কতদিন, কে জানে! সমুদ্রতীরে একজন সৈন্যবাহিনীর লোক পাওয়া গেল। “ফ্যাসিস্টরা দ্রুত এগিয়ে আসছে”,সে ফিরে গেলো ক্যাম্পে খবর দিতে। কোনও প্রতিরোধ নেই। এই অঞ্চলটা ফ্র্যাংকোর বাহিনীকে মুক্তিবাহিনীর তরফে যেন উপহার দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ জিপের দরজা টান মেরে কেউ খুলে দিলো। একটা লোক। কোলে একটা শীর্ণকায় অসুস্থ বাচ্চা। “আমার বাচ্চা, আমি হেঁটে আলামরিয়া পৌঁছনোর আগেই ও হয়তো মরে যাবে। ওকে একটা হাসপাতালে নামিয়ে দেবেন? বলবেন আমার নাম বলবেন জুয়ান ব্লাস। আমি ওকে ঠিক খুঁজে নেবো…..” বাচ্চাটাকে নিয়ে গাড়িতে শুইয়ে দিলো আমাদের নর্ম্যান। জুয়ান কাঁপা কাঁপা হাতে নর্ম্যানের হাতটা ধরে বললো “mi chico my malo”। না অভিধানের দরকার হয় নি। এর মানে আমার বাচ্চা-অসুস্থ-এটা বোঝার জন্য বাবার মুখের ভাবটুকুই যথেষ্ট।
আস্তে আস্তে জীপ ভরে গেলো। শিশু বুড়োবুড়ি আর গর্ভবতী মানুষের ভীড়ে। এই উদ্ধার কার্য চললো টানা আটচল্লিশ ঘন্টা। নর্ম্যানের জিপে আসতে আসতেই বহু আহত শিশু বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। হঠাৎ নর্ম্যানের মনে হলো আজ রাতে, এই সব রক্তঝরা রাতে কি খৃষ্টীয় দূতরা শান্তির বাণী প্রচার করে না?
গোটা পৃথিবী এই খবর রাখে না। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্র্যান্স নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে (?) বাণিজ্যিক জাহাজে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে, স্পেনকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। খবরের কাগজে কেবলমাত্র ব্যঙ্গ, বিনোদন আর ভূয়া খবরে বোঝাই। রাজনৈতিক নেতারা সব ভন্ড। তাই নর্ম্যানকে আমেরিকায় জনসমর্থন তৈরি করতে পাঠানো হলো। সঙ্গে একটা ফিল্ম ‘হার্ট অফ স্পেন’।
দীর্ঘ বক্তৃতামালার সময়েই খবর এলো বিদেশী শক্তি (জাপান) আক্রমণ করেছে চীনের মানুষকে, সঙ্গে রাজশক্তি তো আছেই। এমনিতেই আফিংয়ের নেশায়, মঙ্গোলদের (কুবলাই খান) শাসনে, রাজতন্ত্রের শোষণে চীনের মানুষ মৃতপ্রায়। জনবিষ্ফোরণে অভুক্ত। এরমধ্যে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি)।
ফ্রান্সেস,
ভ্যাঙ্কুবার যাওয়ার পথে তোমার সঙ্গে আমার মন্ট্রিয়লে দেখা হয়েছিল। স্পেনে গিয়ে বুঝেছি সব সময় নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাপারটা উপভোগ করার সময় আর নেই।……
যে পৃথিবী হত্যা ও দুর্নীতির জন্ম দেয় তার বিরুদ্ধে আমি হাত না তুলে বেঁচে থাকতে চাই না।সংবাদপত্র সত্য বলে না, নেতারা ভন্ড…..স্পেন আর চীন, সেই একই যুদ্ধের দুটো অংশমাত্র।আমি চীনে যাচ্ছি কারণ ওখানে আমার প্রয়োজনটা সব থেকে বেশী।
শুভেচ্ছা জেনো
বেথ
পঞ্চম পর্ব শেষ