“ডাক্তারবাবু, বাচ্চাটা একদম খেতে চায় না? কী করি বলুন তো?”
“ডাক্তারবাবু, সারাদিন ফোন নিয়ে বসে থাকবে, কথাই শোনে না! আর পেরে উঠছি না!”
“রোজ ওর চকোলেট, কোল্ড ড্রিংক এসব চাই। স্কুল থেকে ফেরার পথে এত বায়না করে না, সামলাতে পারি না! কী করি,বলে দিন তো?”
প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা।
এমনই প্রশ্ন এক মা করেছিলেন তার পাঁচ বছরের ছেলের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে নাজেহাল হওয়ার পর। তা আমার পরবর্তী জিজ্ঞাসা ছিল, ‘বাচ্চা কি এরমধ্যেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে নাকি?’ ভদ্রমহিলা আমার কথা বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন। আমি আরও স্পষ্ট করে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, ‘এখন থেকেই রোজগার করে নাকি?’ উনি বললেন, “না, না, সে কী করে করবে?” আমি বললুম, ‘তাহলে ওই চিপস, চকোলেট, কোল্ড ড্রিংক ঠিক কে কিনে দেয়? আপনি, না ওর বাবা?’ আমতা আমতা করে বললেন, “সে তো মানে . . . . আমরাই . . . আসলে এমন করে চায়, না করতে পারি না!”
আজকের যুগের সমস্ত বাবা-মায়েরাই এমন সন্তানকাতর। অপত্যস্নেহ কি তাঁদের বাবা-মার ছিল না? কিংবা তার আগের প্রজন্মের? একটু মনে করে দেখুন তো, ছোটোবেলায় আপনার নিজের বাড়িতেই এতখানি আহ্লাদ পেয়ে আপনি বড়ো হয়েছেন কি না, যতটা আপনার বাচ্চা পাচ্ছে? আসলে সন্তানদের দুধে-ভাতে রাখতে গিয়ে, ওই দুটো জিনিসই ভীষণভাবে বাদ পড়ে যাচ্ছে, আমাদের এই দ্রুতগতির জীবনে। তার জায়গায় ঢুকে পড়ছে ফাস্ট কিংবা জাঙ্ক ফুডেরা . . . ফলাফল? ওবেসিটি বা স্থূলত্ব।
ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এতদিন পর্যন্ত এক জ্বলন্ত সমস্যা ছিল অপুষ্টি, যা আজও প্রবলভাবে রয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে যোগ হয়েছে স্থূলত্বের সমস্যা। আমাদের আগের প্রজন্মের ডাক্তারদের বোধ হয় এত শিশুদের দেখতে হয়নি যারা এমনভাবে ওবেসিটির শিকার। আগের লেখাটুকু পড়ে এটুকু নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে ওবেসিটির প্রাদুর্ভাবের পিছনে, বাবা-মায়েদের ভূমিকা কতটা মারাত্মক। তবে কি আমি শুধু বাচ্চার বাবা-মাকেই দোষী ঠাউরাচ্ছি? আজ্ঞে দোষ যে একেবারে নেই সে কথা তো হলফ করে বলতে পারি না। তবে আরও অনেক প্রভাব রয়েছে। বাকিটুকু বিস্তারিত খুলে বলা যাক, তবে . . .
কাকে বলব ওবেসিটি, বা ওভারওয়েট? দু-টি কি একই জিনিস?
এর আগে আপনাকে জানতে হবে, BMI বা Body Mass Index কী? একটা খুব সামান্য ফর্মূলা দিয়ে আপনি সামান্য অঙ্ক জানলেই BMI নির্ণয় করতে পারবেন। জানতে হবে শুধু বাচ্চার ওজন আর উচ্চতা। এই ওজনকে(কেজিতে) উচ্চতার(মিটারে) বর্গ দিয়ে ভাগ করলে পেয়ে যাবেন BMI।
BMI= কেজিতে মেপে নেওয়া ওজন/(মিটারে মেপে নেওয়া উচ্চতা)২
বড়োদের ক্ষেত্রে BMI-এর ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট শ্রেণিবিভাগ থাকলেও (যেমন, BMI ৩০-এর উপরে গেলে স্থূলত্ব ইত্যাদি), বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এর একটা বয়সভিত্তিক চার্ট আছে, যার ভিত্তিতে স্থূলত্বকে নির্ধারণ করা হয়। এই চার্ট অনুযায়ী বাচ্চার BMI ৮৫-তম সেন্টাইলের সমান বা বেশি হলে তাকে ওভারওয়েট এবং ৯৫-তম সেন্টাইলের সমান বা বেশি হলে তাকে ওবেসিটি বলব।
২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে প্রায় ১১.৫% শিশু(২-৪বছর বয়সি) ওভারওয়েট এবং প্রায় ১ কোটি চল্লিশ লক্ষ বাচ্চা ওবেসিটির শিকার।
অপুষ্টি না হয় খারাপ, আমরা সকলেই জানি। কিন্তু স্থূলত্বে সমস্যা কোথায়?
সমস্যা অনেক। এক-এক করে বলা যাক তাহলে।
১) শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া: একে আমরা ডাক্তারি পরিভাষায় Dyslipidemia বলে থাকি। এই রোগে যেহেতু ক্ষতিকারক কোলেস্টেরলের মাত্রা দেহে বাড়তে থাকে, তাই পরবর্তীতে রক্তবাহ ব্লক হয়ে, রক্ত চলাচলে বাধার সৃষ্টি হতে পারে। হার্টের রক্তবাহে এমনটা হলে, আমি-আপনি তাকে হার্ট অ্যাটাক বলে থাকি। হার্ট-অ্যাটাক কতটা বিধ্বংসী হতে পারে, তা বোধ হয় সাম্প্রতিক অতীতে ঘটা কে.কে.-র মৃত্যু আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়।
২) শরীরে সুগারের মাত্রা বেড়ে যাওয়া: ডায়াবেটিস বলতে পারেন। আবার ডায়াবেটিসের আগের পর্যায় হল impairedglucosetolerance, বা অনেকে pre-diabetes-ও বলে থাকেন। অর্থাৎ, শরীরে ইনসুলিনের বিরুদ্ধে একপ্রকারের অযাচিত প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছে, যা রক্তে সুগারের মাত্রাকে ধীরে ধীরে বাড়িয়ে তুলছে, কিন্তু তখনও ডায়াবেটিস হলে যে মাত্রায় সুগার বাড়ে, ততখানি বাড়েনি (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইনসুলিনের অভাবেই শরীরে সুগার বাড়ে, যাকে আমরা ডায়াবেটিস বলি)। যদিও, এই রোগীদের অচিরেই ডায়াবেটিসের স্তরে পৌঁছোতে বেশি সময় লাগে না। দেখা গেছে এই pre-diabetes বা frankdiabetes আক্রান্ত বাচ্চাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশই হয় ওবেসিটি নয়তো ওভারওয়েটের শিকার। ‘সুগারের রোগ’ আবার একা আসে না। সঙ্গে চোখ, নার্ভ এবং সবশেষে কিডনির সর্বনাশ করে দিয়ে চলে যায়। এবং হ্যাঁ, বাচ্চাদেরও ডায়েবেটিস হয় . . . এখন আরও বেশি করে হয়।
৩) প্রেশার বেড়ে যাওয়া: অর্থাৎ hypertension। আজকের দুনিয়ায় এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখানে কোনো সদস্যের প্রেশার, সুগার বা হার্টের ব্যামো নেই। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন সেই সমস্ত ব্যারাম একেবারে শিশুকালে বাঁধিয়ে ফেললে, জীবনটা কতখানি দুর্বিসহ হয়ে উঠতে পারে। হ্যাঁ, দেখা গেছে স্থূলত্বের শিকার যে সমস্ত বাচ্চা, তাদের ভিতর এক-চতুর্থাংশেরই ‘প্রেশারের রোগ’ ধরে যায়।
৪) লিভারে ফ্যাট জমা: অনেকে আমরা ফ্যাটি লিভার বলি। শরীরও মোটা হচ্ছে, ওদিকে লিভারও খোশমেজাজে মেদ বাড়িয়ে চলেছে। প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র ফ্যাটি লিভার তেমন ক্ষতিকারক না হলেও, ধীরে ধীরে তা হেপাটাইটিস (steatohepatitis), সিরোসিস, এমনকী খুব বিরল ক্ষেত্রে ক্যান্সারেরও জন্ম দিতে পারে।
৫) পিত্তথলিতে পাথর হওয়া: এও স্থূলত্বের আরেক অভিশাপ হিসেবে আসে। মেয়েরা ছেলেদের থেকে খানিক বেশি আক্রান্ত হয়।
৬) অ্যাজমা: যারা অত্যধিক স্থূল, তাদের অ্যাজমা হওয়া এবং তার বাড়বাড়ন্তের সম্ভাবনা বেশ খানিক বেশিই থাকে। আমার ছোটোবেলাতে এক স্কুলের বন্ধুকে দেখতাম ঘাড়ে-গর্দানে চেহারা, বেশ মোটা, কিন্তু ভালোই দুরন্ত। অথচ, বেশি ধুলোবালি লাগলেই কিংবা ঠান্ডা লাগলে কেমন একটা সাঁই-সাঁই করে আওয়াজ হতে থাকত শ্বাসের সঙ্গে। তখন বুঝতাম না, এখন বুঝি। আপনারাও যত তাড়াতাড়ি বোঝেন, ততই মঙ্গল।
৭) ঘুমের সময় শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া: একে আমরা obstructivesleepapnoea-ও বলে থাকি। মারাত্মক অসুখ। ওজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই রোগের সম্ভাবনাও বাড়ে। এতে পরবর্তীতে মৃত্যুর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
৮) ওভারিতে সিস্ট হওয়া: এখন অনেকের ওভারিতেই সিস্ট ধরা পড়ে। এবং তাদের মধ্যে মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ মহিলা ওবেসিটির শিকার।
কিন্তু এখন বাচ্চাদের এই মোটা হয়ে যাওয়ার পিছনে দায়ী কী? কেনই-বা আগের থেকে অনেক বেশি বাচ্চা ওবেসিটির শিকার হচ্ছে আজকের দুনিয়ায়?
কারণ অনেকগুলি থাকলেও, মূল কারণ কিন্তু, দুটো—
১) খাদ্যাভ্যাস: মূলত যে কারণে মানুষ মোটা হয়, তা হল সাপ্লাই-এর সঙ্গে ডিম্যান্ডের মিলমিশ না ঘটা। বিষয়টা খানিক অদ্ভুত লাগছে জানি। আসলে ক্যালোরি ইনটেক আর ক্যালোরি খরচের মধ্যে বৈষম্যই ওবেসিটিকে ডেকে আনে। এখন আমরা যে ধরনের খাবার বাচ্চাদের খাওয়াই, তার অধিকাংশই high ক্যালোরি কিন্তু low নিউট্রিয়েন্ট-যুক্ত খাবার। এতে আমাদের ক্যালোরি মেলে ঠিকই কিন্তু সঠিক পুষ্টি মেলে না। এর মধ্যে পড়ছে, অত্যধিক চিনিযুক্ত ড্রিংক (বাজারে যে সমস্ত কোল্ড ড্রিংক পাওয়া যায়), স্যাচুরেটেড বা সম্পৃক্ত ফ্যাট জাতীয় খাবার (যেকোনো ফ্রায়েড চিকেন বা চিপস), চকোলেট, বিভিন্ন ফাস্ট ফুড ইত্যাদি। এই সমস্ত খাবারের ক্যালোরি সংগ্রহের পর, বাকি সময়টুকুতে শারীরিক পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে তার খরচের দিকেও আমরা মন দিই না। একেই বলে energyimbalance, যার পরিণতি স্থূলত্ব।
২) লাইফস্টাইল বা জীবনশৈলী: দেখা গেছে, যে সমস্ত ফ্যামিলিতে টিভি বা ফোন দেখতে দেখতে খাওয়ার চল আছে, তাদের চিনিযুক্ত খাবার, চিপস, কোল্ড ড্রিংক, বিভিন্ন ভাজাভুজি খাওয়ার প্রবণতা এবং একইসঙ্গে স্থূল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। প্রতি এক ঘণ্টা অতিরিক্ত টিভির সামনে বসা, আদতে ওবেসিটির সম্ভাবনাকে ২% করে বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া অধিকাংশ বাচ্চাকেই এখন আমরা খেলাধুলো থেকে বিরত রাখি। সম্প্রতি খবরের কাগজে পড়লাম, কোনো এক অভিজাত আবাসনের ঘাসের লন নষ্ট হয়ে যাবে—এই যুক্তিতে সেখানকার বাচ্চাদের সেই ঘাসের উপর খেলতে দেওয়া হচ্ছে না। হাজার হোক, লনের ভিউ পাওয়ার জন্যেই এত খরচ করে ফ্ল্যাট কেনা, কিনা! আমাদের ছোটোবেলায় সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতাম, বেশ মনে আছে। সেও একপ্রকারের শারীরিক কসরত। কিন্তু প্রায় সে যুগেই হওয়া (২০০২ সালে) একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৫৩% বাবা-মা তাদের বাচ্চাকে স্কুলে গাড়ি বা বাইক চালিয়ে দিয়ে আসেন। এখন সে সংখ্যাটা আরও অনেক অনেক বেশি। এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে যোগ হয়েছে অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমের অভিশাপ। বিভিন্ন স্মার্ট ডিভাইসে ডুবে থাকতে থাকতে বাচ্চাদের আর সময় কোথায় খেলনা নিয়ে খেলা করার? কিংবা বাইরে গিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার? এবং স্মার্ট ডিভাইসের সঙ্গে এই অভিশপ্ত বন্ধুত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুরু হয়ে যায় বয়স দু-বছর ছোঁয়ার আগেই, যা আদতে বাবা-মা বা বাড়ির বড়োদেরই দান।
এ ছাড়া আরও একটি কারণের কথা না বললেই নয়। সেটি হল জিনের প্রভাব। দেখা গেছে যে বাচ্চার বাবা, মায়ের মধ্যে একজন স্থূলত্বের শিকার, তাদের obese হওয়ার সম্ভাবনা ৩-৪ গুণ বেশি এবং যাদের বাবা, মা উভয়েই obese, তার ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা ১০-১২ গুণ। এই একটি এমন বিষয়, যাকে আমরা পরিবর্তন করতে পারব না। তাই একে বলা হয় unmodifiableriskfactor। কিন্তু এরপরেও শুধু modifiable বিষয়গুলিকে নিয়ন্ত্রণ করেই আমরা এই মহামারির সঙ্গে অনেকখানি মোকাবিলা করতে পারি।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, কীভাবে?
এই প্রশ্নের উত্তর এরকম সরাসরি দেব না। আসলে আপনাদের প্রশ্নগুলো তো ঠিক এভাবে আসে না . . . আসে আরও বাস্তব সমস্যাকে উদ্ধৃত করে। তেমনভাবেই কয়েকটা খুব দৈনন্দিন প্রশ্ন তুলে ধরব এবং তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব।
১) আমরা দু-জনেই working parents, ফলে বাচ্চাকে টিফিন করে দেওয়া সবসময় সম্ভব হয় না। বদলে আমরা টাকা দিয়ে দিই, স্কুলের ক্যান্টিন থেকে কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু বাচ্চা দিন দিন আরও মোটা হয়ে যাচ্ছে। কেন, বুঝতে পারছি না। কী উপায়?
বাচ্চার হাতে অর্থ নয়, চয়েস দেওয়া উচিত। আসলে বাচ্চাদের স্কুল-বয়সে খাবারের পছন্দ সেভাবে গড়ে ওঠে না। ফলে, হাতে টাকা চলে এলে, সে তার বন্ধু এবং মাস মিডিয়া দেখে প্রভাবিত হয়ে নিজের পছন্দ ঠিক করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ফুড-চয়েস ভীষণ অস্বাস্থ্যকর হয়। সেজন্যেই শরীরে তৈরি হয় energyimbalance এবং ওবেসিটি। যতই ব্যস্ততা থাকুক আপনাদের, বাচ্চার খাবারের প্ল্যান কিন্তু আগের রাতে করে রাখতে হবে। নিজেদের কাজগুলোকে সেইমতো সাজিয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া এখন অনেকখানি সমানাধিকার সমাজে এসেছে। ঘরে শুধু মায়েরা কাজ করেন না। বাবারাও বেশ ভালোই রান্না করতে পারেন, কেউ কেউ তা না পারলে হাতে হাতে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে দেন। মনে রাখবেন, যেহেতু দু-জনেই বাইরে একটা কাজ করেন, বাড়িতে এসে এই কাজটুকু একসঙ্গে ভাগ করে না নিলে, আদতে ক্ষতি হবে বাচ্চারই।
২) ডাক্তারবাবু আপনি বারবার বলেন, এটা খাওয়াবেন না, ওটা খাওয়াবেন না। কিন্তু কী খাওয়াব, সেটা যদি একটু বলে দেন, উপকার হয়।
ট্রান্স-ফ্যাট বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট যতটা সম্ভব কম রেখে, শাকসবজি, ঢেকিছাঁটা চাল, ডাল ইত্যাদি দিয়ে সহজেই সুষম খাদ্য তৈরি করা যায়। যেমন ধরুন চিকেন বা পনির বাড়িতে তৈরি রুটির ভিতরে দিয়ে স্যান্ডউইচ রেডি করে ফেলা যায়। কিংবা বাদামি চাল (brownrice) আর তার মধ্যে নানা মরসুমি শাকসবজি দিয়ে তৈরি করে ফেলা যায় পোলাও। না পালিশ করা চালই বাদামি চাল যার মধ্যে তুষ ও অঙ্কুরের অংশ থেকে যায়; আর সেটা পালিশ করে ঝেড়ে ফেলে দিলেই সাদা চাল বেরোয়। এই তুষ এবং অঙ্কুরের অংশে বেশ কিছু পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেল এবং ফাইবার থাকে। এ ছাড়া বাদামি চালের glycemicindex (যা কিনা নির্ধারণ করে, কোন খাবার খাওয়ার পরে সেই খাদ্য রক্তে কতখানি সুগার বাড়াতে পারে) সাদা চালের থেকে কম। ফলে, ডায়াবেটিসে এই চাল খানিক উপকার দেয়। ভাত-ডালের পাশাপাশি, খিচুড়ি, বিভিন্ন ধরনের সবজির তরকারি, ডিম, মাছ, মাংস, সুজি, ডালিয়া এইসবও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রান্না করতে পারেন। এ ছাড়া বাড়িতে তৈরি ধোসা বা ইডলিও স্বাস্থ্যকর খাদ্যের তালিকায় পড়ে।
নুন এবং চিনির ব্যবহার পরিমিত করুন। ভাতের পাতে কাঁচা নুন দেবেন না। সম্ভব হলে, চিনির বদলে গুড়ও ব্যবহার করতে পারেন।
স্ন্যাক্স হিসেবে যদি বলেন তবে বিভিন্ন মরসুমি ফল, বাদাম, ওটস, উপমা, পোহা ইত্যাদি বেশ ভালো।
যদি বাচ্চা চিনিযুক্ত কোল্ড ড্রিংক খেতে অভ্যস্ত হয়, তবে তাকে বাড়িতে তৈরি ফ্রুট শেক বা স্মুদি দিতে পারেন। এ ছাড়া লেবুর শরবত, দই, লস্যি, রাসাম এগুলোও ভালো অপশন। তবে কখনোই প্রক্রিয়াজাত ফ্রুট জুস, যা বাজারে পাওয়া যায়, তা বাচ্চাদের দেবেন না। এতে বিভিন্ন প্রিজারভেটিভ, আর্টিফিসিয়াল কালার ইত্যাদি মিশে থাকে।
ব্রেকফাস্টে অনেকে পাঁউরুটি সেঁকে দেন, যাতে কার্বোহাইড্রেট আর ক্যালোরি খুব বেশি থাকলেও, প্রোটিন, ফাইবার এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় নিউট্রিয়েন্ট কম থাকে। এর থেকে বাড়িতে বানানো রুটি অনেক স্বাস্থ্যসম্মত। আর কখনো ব্রেকফাস্ট যেন মিস না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
এ ছাড়া তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে, বিভিন্ন তেল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করাই ভালো। যেমন কখনো সয়াবিন ওয়েল, কখনো-বা সানফ্লাওয়ার ওয়েল ইত্যাদি। তবে কখনোই পোড়া তেলে রান্না করবেন না। এতে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়।
এ ছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সি বাচ্চাদের চা বা কফি দেবেন না। যারা obese নয়, ৫-১০ বছর বয়সি এমন বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রতিদিন হাফ কাপ (১০০ মিলি) এবং ১০-১৮ বছর বয়সিদের এক কাপ (২০০মিলি) চা বা কফি দেওয়া যেতে পারে। তবে কখনোই তা ঘুমোতে যাবার আগে নয়। এবং বাচ্চা যাতে একদিনে চা, কফির পাশাপাশি অন্যান্য ক্যাফিনেটেড খাবার (যেমন চকোলেট, কোল্ড ড্রিংক) না খায়, তা নজর রাখা উচিত।
খেয়াল রাখবেন, যেকোনো বেকড বা ফ্রায়েড ফুডে ট্রান্স-ফ্যাট অত্যন্ত বেশি থাকে। সর্বোতভাবে এড়িয়ে চলাই ভালো।
মনে রাখবেন, বেশি সময় ধরে খালি পেটে যেন বাচ্চা না থাকে। অল্প করে বারবার খাওয়ান। অনেক সময় বাচ্চা বায়না করে খেতে চায় না। সেক্ষেত্রেও পুরোটা একবারে না খাইয়ে অল্প অল্প করে দু-বারে খাওয়াতে পারেন।
৩) আমার দুই ছেলে। একজনের বয়স ৬, আরেকজনের ১১। ওদের ওজন যথাক্রমে ২৯ আর ৪৮ কেজি। আমরা একটা ছোটো ফ্ল্যাটে থাকি। বেশি জায়গা নেই। কিছু প্র্যাকটিক্যাল এক্সারসাইজ যদি বলে দেন, যেগুলো এই অল্প স্পেসে করা সম্ভব, তাহলে ভালো হয়।
শারীরিক কসরত বিভিন্নরকমের হয়ে থাকে। এখানে মূলত তিন ধরনের কসরতের কথা বলব।
Aerobicexercise
(দৈনিক অন্তত এক ঘণ্টা) |
পেশি শক্ত করার ব্যায়াম
(প্রতি সপ্তাহে অন্তত তিনদিন) |
হাড় শক্ত করার ব্যায়াম
(প্রতি সপ্তাহে অন্তত তিনদিন) |
দ্রুত হাঁটা, বাস্কেটবল, সাইকেল চালানো, নৃত্য, জগিং, সাধারণ গৃহকর্ম, দৌড়, বাগান তৈরি, ঘর মোছা বা পরিষ্কার করা ইত্যাদি | জিমন্যাস্টিক্স, পুশ-আপ, পুল-আপ, সিট-আপ, দড়ি টানাটানি খেলা, দড়ি বা গাছে চড়া, মাঙ্কি বার ইত্যাদি | ফুটবল, টেনিস, স্কিপিং, সাঁতার, মার্শাল আর্ট ইত্যাদি |
মনে রাখবেন, recommendation অনুযায়ী, ১৬ বছরের নীচের বাচ্চাদের জিম করা কিন্তু উচিত নয়। বাড়িতে বাচ্চার শুয়ে-বসে থাকার সময় আরও কমিয়ে দিন। লিফটের বদলে পারলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন। স্কুলে যাওয়া বা আসার সময় একটু বড়ো বাচ্চারা সাইকেল ব্যবহার করতে পারে। অন্যান্য ব্যায়ামের পাশাপাশি যোগব্যায়াম এবং প্রতিদিন অন্তত ১৫-২০ মিনিট দ্রুত হাঁটা অভ্যাস করান। ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, ফুটবল ইত্যাদি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলা যেতে পারে। যাদের বাড়িতে জায়গা কম, তারা উপরে লেখা ব্যায়ামগুলোর মধ্যে যেটুকু করা সম্ভব, তা করতে পারেন, এবং ভালো হয় বাড়ির সকলেই কম-বেশি এই শারীরিক কসরতের অভ্যাসটুকু বজায় রাখলে।
ওবেসিটির উপর জেনেটিক্সের কিছু প্রভাব থাকা সত্ত্বেও একটা প্রবাদ মনে রাখবেন, obesity does not run in families but in families who do not run . . .
৪) আমার বাচ্চার পাঁচ বছর বয়স। সারাদিন টিভি দেখে, ভিডিয়ো গেম খেলে, শুয়ে-বসেই কাটিয়ে দেয়। অনেক বলেও কোনো কাজ হয়নি। ভুলটা যদিও আমাদেরই, তবু এখন আমরা বাড়ির পরিবেশ কীভাবে বদলাতে পারি, সে বিষয়ে কিছু যদি বলেন?
পাঁচ বছর বয়সটা খুব বেশি নয়। এখনও হাতে সময় রয়েছে। তবে এখানে দায় কারো একার নয়, সম্মিলিতভাবে বাড়ির ভিতরে এক স্বাস্থ্যকর পরিবেশ গড়ে তোলা যায়। স্মার্ট ডিভাইস এবং তার স্ক্রিন টাইম এ বিষয়ে সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধক। এ বিষয়ে বিস্তারিত আগের সংখ্যায় লিখেছি, সেখানে অবশ্য-করণীয় একাধিক উপায়ের কথা বলেছি। এখানে তার আর পুনরাবৃত্তি করব না। স্বল্প কথায় তবু কিছু প্র্যাকটিসের কথা এখানে তুলে ধরছি।
- বাচ্চাকে বল নিয়ে খেলা, বিল্ডিং ব্লক, স্কিপিং, লাফানো, মাঠে গিয়ে খেলা, লুকোচুরি বা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় উৎসাহিত করুন। সাইকেল চালানো শেখাতে পারেন। ঘরে বসে স্ক্রিন–মিডিয়া দেখার বদলে দাবার মতো ইনডোর গেম বা যোগব্যায়াম শেখাতে পারেন। এ ছাড়া স্মার্ট ডিভাইস হাতে দেওয়া বন্ধ করুন। স্ক্রিন-টাইম সংক্রান্ত সুপারিশ (আগের সংখ্যায় উল্লিখিত) মেনে চলুন। প্রাথমিকভাবে বেশ কঠিন হবে। হয়তো বাচ্চার কান্না থামাতে গিয়ে করুণায় ফোনখানি আবার ‘আহা রে, বাছা আমার’ বলে তার হাতেই তুলে দেবেন। কিন্তু সর্বনাশের অনেকখানি এখনও প্রতিরোধযোগ্য, এবং সেও আপনারাই পারবেন।
- বাচ্চার ঘরে যদি টিভি রেখে থাকেন, সেটি দ্রুত সরিয়ে দিন। খাওয়ার সময় টিভি দেখা বন্ধ করুন। বরং এই সময়টাতেই নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতা বাড়ান। দেখা গেছে যে পরিবার খাওয়ার সময় নিজেদের মধ্যে বার্তালাপ, মত বিনিময় বজায় রাখে, তারা অনেক বেশি আনন্দে থাকে। খাওয়ার পর, টিভি দেখার বদলে বাচ্চাকে বিভিন্ন গল্প পড়ে শোনান।
- কোনো কাজই যে ছোটো নয় এবং বাড়ির সমস্ত কাজের দায়িত্ব কোনো একটি মানুষের (বা মহিলার) নয়, এ কথা ছোটো থেকেই শেখান। বাচ্চাকে তার নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী বাড়ির কাজে সাহায্য করতে বলুন। যেমন স্যালাড কেটে দেওয়া, ডিনার টেবিল সাজানো, বইয়ের তাক পরিষ্কার করা, বিছানা গোছানো ইত্যাদি।
এতক্ষণ ধরে যা পড়লেন, সে শুধু এই বইয়ের অক্ষরমাত্র। এই অক্ষর প্রাণ পেতে পারে, একমাত্র কাজের মধ্য দিয়েই। বাড়িতে কারো ওবেসিটি থাকুক বা না থাকুক, স্বাস্থ্যকর অভ্যেস যেহেতু সবসময়েই স্বাস্থ্যকর; তাই আশা রাখব, আপনাদের দৈনন্দিন কাজের মধ্যে, অবসরের মধ্যে, স্ক্রিন–টাইমের মধ্যে উপরের অক্ষরগুলো সামান্য হলেও প্রাণ খুঁজে পাবে। এই জীবন্ত কথাদের উপর ভর করে আপনারাও সম্মিলিতভাবে ওবেসিটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল হন। ভালো থাকুন।
তথ্যসূত্রঃ
১) Balasundaram P, Krishna S. Obesity Effects On Child Health. [Updated 2023 Mar 8]. In: StatPearls [Internet]. Treasure Island (FL): StatPearls Publishing; 2023 Jan-. Available from: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK570613/#
২) Kar SS, Kar SS. Prevention of childhood obesity in India: Way forward. J Nat Sci Biol Med. 2015 Jan-Jun;6(1):12-7. doi: 10.4103/0976-9668.149071. PMID: 25810628; PMCID: PMC4367021
৩) Sahoo K, Sahoo B, Choudhury AK, Sofi NY, Kumar R, Bhadoria AS. Childhood obesity: causes and consequences. J Family Med Prim Care. 2015 Apr-Jun;4(2):187-92. doi: 10.4103/2249-4863.154628. PMID: 25949965; PMCID: PMC4408699.
৪) Guidelines for Parents, Overweight and Obesity: Detection, Prevention, and Management,Indian Academy of Pediatrics (IAP),Available from: https://iapindia.org/pdf/guideline-on-OBESITY-04032021.pdf , Accessed May 28th, 2023
৫)Saha J, Chouhan P, Ahmed F, Ghosh T, Mondal S, Shahid M, Fatima S, Tang K. Overweight/Obesity Prevalence among Under-Five Children and Risk Factors in India: A Cross-Sectional Study Using the National Family Health Survey (2015–2016). Nutrients. 2022; 14(17):3621. https://doi.org/10.3390/nu14173621