১)
ছেলেকে ফোনে বলতেই, তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো না বটে, কিন্তু ঠাণ্ডা বরফগলায় জানিয়ে দিল, – না।
– মানে, আমি যাব না? আহত বিস্ময়ে লোকটা বলল।
ছেলে সেই রকমেরই কাটা কাটা উচ্চারণে বলল, – না, মানে না। সেই কবে থেকে এই জ্বালাতন করছ বলো তো। আমার সঙ্গে বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়েরা থাকবে। তাদের কারও বাড়ির থেকে কেউ আসবে না। যে যার মত নিজের ডেস্টিনেশনে চলে যাবে। আমি ওদের সিনিয়র, বাবা! একটা প্রেস্টিজ নেই আমার?
বাধ্য হয়ে তিরস্কার মেনে নিল অবুঝ বাবাটি।
২)
মানুষটার ছেলে বিদেশ থেকে ফিরছে। আজ সকালে দমদমে নামবে। যাত্রা শুরু হয়েছে প্যারি থেকে।
না না এই প্যারিতেও সে এসেছে বিমানে। ফ্রান্সের সমুদ্র উপকুলের এক শহর থেকে। এই ছেলের সঙ্গে বয়সে অনেকই ছোটো একদল ছেলেমেয়ে।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ বেজায় উত্তেজিত। পাসপোর্টে প্রথম স্ট্যাম্প পড়ল তাদের। দিন আষ্টেক আগে ওরা সবাই এসেছে একটা সাইন্টিফিক কনফারেন্সে।
এই ছেলের তত উৎসাহ নেই। তার পক্ষে এই বিদেশ আসা এখন নেহাতই ক্লান্তিকর চাকরির একটা অঙ্গ। তার পাসপোর্টে অনেক ছাপ। নানান দেশের। সবচেয়ে পুরোনোটা প্রায় কুড়ি বছর আগের। গতকাল রাত পুরোটা জেগেছে মুম্বাই এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে। ভোর ছটায় রওনা হয়েছে সেখান থেকে।
যে মানুষটার ছেলে, সেই মানুষের নিজের অবশ্যি কোনও পাসপোর্ট নেই। ছেলে অনেকবার বলা কওয়ার পরেও করেনি। আলস্যেই। কিন্তু ছেলেকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে যাওয়ায় তার ভারি উৎসাহ।
৩)
সেই অবুঝ বাবাটা জীবনকথায় তার নিজের বাবার কথা লিখেছিল। সেই লেখার একটা অংশ শোনাই।
❝একদিনের কথা বলি। তখন আমি জাজিগ্রাম স্কুলে পড়ি। ক্লাস ফাইভ কী সিক্স। পাশের গ্রাম হিলোরায় আমাদের বাসা। স্কুলের টিফিনে কেউ এসে খবর দিল তোর বাবা এসে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। আসলে বাবার তো সেই মাসান্তে আসা। এসে জাজিগ্রামের হাট থেকে বাজার সওদা করে দিতেন। দূর থেকে উঁকি দিয়ে দেখলাম বাবা একমুখ আশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ বিকেলেই তিনি ফিরে যাবেন অনেক দূরের কর্মক্ষেত্রে।
ঘামে ভেজা মুখ। দুপুরের গনগনে রোদের মধ্যে, একহাতে বাজারের ব্যাগ। অন্য হাতে একটা কাঠি আইসক্রিম। মানে বাঁশের কাঠির গায়ে জমানো রঙিন বরফ। দু’পয়সা না তিন পয়সা দাম ছিল তখন। নিম্ন মধ্যবিত্ত বাবার সাধ্যের মধ্যে এইটুকুই। তখন বুঝিনি কতখানি ভালোবাসা ছিল ওই বরফখণ্ডে।
কেন জানি না নির্বোধ এক লজ্জায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বাবার কাছে গেলাম না। টিফিনের পরে ক্লাস শুরু হয়ে গেল। বিকেলে বাড়িতে ফিরতে মা বলল, তোর বাবা তোর জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো বরফটা গলে যাবার পর বাড়ি ফিরেছে। খুব দুঃখ পেয়েছে মানুষটা। কুলুঙ্গির দিকে আঙুল তুলে দেখালো, দ্যাখ, ওইখানে কাঠিটা রেখে গেছে। চলে যাবার সময় বলে গেল তোকে দেখাতে।
আজ মনে হয়, সত্যিই মনে হয়, সেই ভালোবাসা জড়ানো কাঠিটা যদি খুঁজে পেতাম আর একবার।❞
৪)
এই এতোলবেতোল মানুষটা লাইন মিলিয়ে মিলিয়ে দুয়েকটা পদ্যও লিখত কখনও। তারই একটা মনে পড়ল তার এই সব তালেগোলে।
গল্পহীন
________
আমার কোনও গল্প নেই… সত্যি কাহিনিও।
সাহস নেই … তাই বলিনি অবগাহন দিও।
হিসেব ভুলে পালিয়ে গেছি। হইনি শ্রেণীগত।
ভাবের ঘরে চুরিও করা হয়নি যথাযথ।
যুদ্ধে যাই যখনই কাড়ানাকাড়া বেজে ওঠে
ভালোবাসার নোনতা স্বাদ তখনও লেগে ঠোঁটে।
গোহারা হেরে যাবার পর ফিরেছি ভাঙা ঘরে
পরাজয়ের কথা লিখেছি বেহায়া অক্ষরে।
রাত নামলে অহংকারে চিবুক রাখা চাঁদে
চোখ রেখেছি… সন্তর্পণ গোপন অপরাধে।
কপাল গুণে জ্যোৎস্না আমায় চিনতে পারেনি তো
হয়তো বেঁচে যেতাম, যদি কখনও ডেকে নিত।
মুখ লুকোই। অলীক ঋণে ডুবতে থাকি … ঋণী।
এখানে কোনও গল্প নেই … ছিল না কোনওদিনই…
৪)
নিজের বাবার কথা মনে করে মানুষটার মনে হল, তাদের বয়ে যাওয়া জীবন কোনও উপন্যাস নয়। ছোটো ছোটো আনন্দ-দুঃখ দিয়ে গাঁথা নেহাতই রঙহীন মধ্যবিত্ত জীবন। প্রার্থিত চমক নেই বলে এমনকি ছোটো-বড়ো-অণু কোনও গল্পও হয়ে ওঠে না তাদের এই সাদামাটা জীবন কাহিনি।
৫)
আজ থেকে অনেকদিন পরে এই ছেলেটার নিজের ছেলে যখন বিদেশ থেকে ফিরবে, তখন কি শুকতারাটির দিকে তাকিয়ে, এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে ওর মনে পড়বে চলে যাওয়া বাবাটার, চলে যাওয়া মানুষটার কথা?