আমাদের পরিবারে বড়দের প্রতি বশ্যতাবোধ একটু বাড়াবাড়ি রকমের ইয়ে ছিল। অবশ্য তা আমাদের প্রজন্ম অবধি। তার পরে ব্যপারটা ওই ব্যাঙাচির লেজের মতই অবলুপ্ত হয়েছে।
সে কালে আর একালেও, পুত্র কন্যারা কালের নিয়মেই এক ছাদের নীচে থাকে না। থাকেওনি। আমাদের সময়ে উদ্বাস্তু পরিবারে তা ঘটেছিল নেহাতই অর্থনৈতিক কারণে, ক্ষুণ্ণিবৃত্তির কারণে। এক ছাদের নীচে থাকা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখনকার দিনে সাধ্যের মধ্যে থাকলেও এক ছাদের নীচে থাকা নিষেধ।
তা হলেও আমাদের সময়ে বড়দের মানামানিটা একটু বেশি মাত্রায়ই ছিল। প্রায় প্যাথলজিক্যাল লেভেলে।
এখন যেমন, ছেলে টেলিফোনে বিরক্ত গলা শোনায়,
– আঃ বাবা, যা বোঝো না সে ব্যাপারে কথা বোলো না। এখন কনফারেন্স কল নিতে হবে, ফোনটা রাখো।
কিম্বা কন্যা হোয়াটসঅ্যাপে চমকায়,- ফর সাচ আনকাইন্ড ওয়র্ডস, আই জাস্ট ডোন্ট, ওয়ান্ট টু টক এনিমোর,
নাঃ, এ হেন বাক্যালাপ বড়দের সঙ্গে, আমাদের সেই অভাবপীড়িত সংসারছবিতে, ভাবাই যেত না।
উদাহরণ দিয়ে বলি।
আমার দাদু মানে ঠাকুরদা, সে আমলের ইংরেজিতে ডবল এমএ। প্রচুর ইংরেজি জানেন। নাকি হয় তো জানেনও না। আমি ইংরেজিতে এতই ওস্তাদ, তা বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই। এই দাদুই আমার মোটে ইংরেজি না শেখার মূলে, অপ্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী, কিছুটা।
আমাদের সময় হায়ার সেকেন্ডারিতে কোনও টেক্সট ছিল না। বড় লেখকদের লেখা ইংরেজি পড়ার সৌভাগ্য পাঠ্য বইয়ের সুবাদে, আমাদের ঘটেনি। তো সেই সময়ে আমার করা ইংরেজি ট্র্যান্সলেশন দাদুকে দেখাতাম। প্রতিটি লাইন অবধারিতভাবে কেটে নতুন লাইন লিখতেন দাদু। শেষ অবধি যা দাঁড়াতো সেটি, আমার করা নয়, দাদুরই করা এক অনুবাদকর্ম। আমি রেগেমেগে বলতাম,
– তোমাদের সময়ের ইংরেজি এখন পাল্টে গেছে।
কী কথা থেকে কী কথায় এসে গেলাম। সেই ডবল এম.এ. মানুষটির অভ্যেস ছিল নিদ্রার আগে রোজ ইংরেজি ডিকশনারি থেকে বিশটা শব্দ আত্মস্থ করা।
দাদুর সঙ্গে কোনও শব্দের বানান নিয়ে দ্বিমত হলে, বাবা-জ্যাঠা-কাকাদের কখনও বলতে শুনিনি,
– বাবা, আপনি যে বানানটা বলছেন, সেটা ভুল।
বরং তাঁরা বলতেন, – বাবা, আপনে যে বানানটা কইতাসেন, সেই বানানটা ঠিকোই, কিন্তু মনে লাগে এই বানানটাও যেন কই দেখসি। এই বলে সেই শুদ্ধ বানানটি সন্তর্পণে পেশ করতেন।
দাদু দেখেশুনে ডিকশনারি ঘেঁটে সন্তুষ্ট হয়ে হাঁক পাড়তেন, – বড়কু, বড়কু রে, আমিই ভুল। আইজকাল আর কিসুই ঠিক মনে থাহে না!
এই যে মান্যজন ভুল করছেন জেনেও তাঁকে সরাসরি ভুল না বলা, সেই কথাই বলছিলাম।
বড়দের মান্য করার আর এক ঘটনা বলি।
সেদিন বাড়িতে চাল নেই। এই রে চাল আবার নেই বলতে নেই তো। বলতে হবে,- চাল বাড়ন্ত।
তো সেই রকমেরই এক বাড়ন্ত বেলায়, বড়কাকু বেরিয়েছেন চাল কিনতে। রান্নাঘরে আমার মা রেডি। চাল এলে উনুনে আঁচ দিয়ে ভাত চাপাবেন। ছয়টি ক্ষুধার্ত পেটে ভাত পড়বে। বেলা গড়ায়। বড়কাকু আর ফেরেন না। সন্ধ্যের মুখে সেই তিনি ফিরলেন। চাল নয়। বগলে একটি হাফ পাউন্ড পাঁউরুটি। কী ব্যাপার?
জিজ্ঞেস করতে উত্তর এলো, – চাল কিনতে যাইতাসি ইস্কুলের পাশ দিয়া। দেখি, সন্তোষের মাইয়াটা কানতাছে। জিগাইতে কয়, আইজ ফরম ফিলাপের শ্যাষ দিন। হ্যার বাপে টাকাডা জোগাড় করতে পারে নাই।
বড় পিসিমণি বললেন, – তয়, তুমি আইজ দাতা কর্ণের পাট করসো নাহি?
– বাঃ, বাবাই না শিখাইসিলেন, দ্যাহো মণি, একডা কথা খেয়াল রাইখ্যো। আমাদের নিজেদের এক কালে ফর্ম ফিলাপের পয়সা আসিলো না। দেইখো,কেউ য্যান, এই কারণে ঠেইকা না যায়!
দাদু স্বকর্ণে শুনলেন। পিতৃসত্য রক্ষার এই প্রয়াস শুনে তিনি প্রায় দশরথের মতই স্তব্ধবাক।
আমাদের প্রজন্মেও বড়দের মান্য করার এই ধারা বজায় ছিল। বড়কাকু তখন সপরিবারে মনোহরপুকুর রোডের এক দেড়তলা ঘরে ভাড়া থাকেন। আমরা, মানে আমি, কাকিমা, আমার গিন্নি Sunanda,, ভাই Tarakeswar (তারু) জমিয়ে পোস্ট-দ্বিপ্রাহরিক আড্ডায় মগ্ন। বোন মৌসুমী সাউথ পয়েন্টে পড়ে। স্কুল ছুটির পর দু-বেণী ঝুলিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি টপকে ঘরে ঢুকল। হাতে সামনের ফুটের রঘুলাল চুরনওয়ালার ঝাঁপি থেকে সংগৃহীত গাঢ় খয়েরি রঙের তেঁতুল আচার। বাঁ হাতে সেই থকথকে বিষাক্ত আচারের শালপাতা। ডানহাত, ধোয়া নয় বলাই বাহুল্য। সেই হাত সাগ্রহ জিভে আঙুল দিয়ে তুলে দিচ্ছে অমৃত। মুখে ব্রহ্মস্বাদ আস্বাদনের আভা।
দেখেই সুনন্দা অগ্নিমূর্তি। – ছিঃ মৌ, তুমি না উঁচু ক্লাসে উঠেছ। স্কুল ফেরত হাত না ধুয়ে আচার? ছিঃ…বলেই ওর হস্তধৃত সাত রাজার ধন ফেলে দিতে অতি উদগ্রীব হাত বাড়ালেন জানলা ঘেঁষে বসা বৌদিদিমণি। মৌ,সম্ভবত পরম বিশ্বাসেই সমর্পণ করল তার সম্পদ।
বৌদি? তিনি কী করলেন? তিনি ফেলে দেবার বদলে, ধীরে সুস্থে, চোখ আধা নীমিলিত করে সেই বস্তু কতটা বিষাক্ত বোঝবার জন্য স্বাদ নিলেন আঙুলে তুলে। টি-টেস্টারের মত চাটনি-টেস্টারের দুরূহ ভূমিকায়। হ্যাঁ, পুরোটাই টেস্ট করলেন। তারিয়ে তারিয়ে। জিভ আর তালুতে তৃপ্তির চটকা তুলে। হাত না ধুয়েই, তিনিও।
আমারই বঁধুয়া আনবাড়ি যায়, আমারই আঙিনা দিয়া। অতৃপ্ত লালাসিক্ত রসনায়, সেই দৃশ্য অসীম ধৈর্যে বিরহিণী রাধার চোখে সহ্য করল মৌ। জুলজুল চোখে। বড়দের মান্য করা শেষ প্রজন্মের প্রতিনিধি Mousumi।
যা হোক, আমাদের ঠিক আগের প্রজন্মের এক অনন্য কাহিনি বলে শেষ করি। সেই হায়ার সেকেন্ডারির আগের বছরেই। আমার আর মায়ের তুমুল টাইফয়েড। দাদু আমাদের কাছে। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন আমার মিলিটারি কাকা। আজই তিনি অমৃতসরে তাঁর কর্মস্থলে ফেরত যাবেন। শয্যাশায়ী মায়ের বদলে ব্যবস্থাপনায় আমার পিতাশ্রী। বাহুল্যমুক্ত আয়োজন। ঘি আর আলুসেদ্ধ দিয়ে ফেনা ভাত। বাবা কাকুকে খেতে দিয়েছেন। ঘি যথোপযুক্ত পরিমানে দেবার পরেও আর একটু স্বাদিষ্ট করার বাসনায়, আরও তিন চামচ।
– খাও অমু, খাঁটি গব্য ঘৃত। অন্যত্র পাইবা না। যেমুন সোয়াদ তেমুন গন্ধ।
ধনকাকু বাধ্য বালকের মত ঘাড় নাড়তে নাড়তে খাচ্ছেন। কী মনে হতে আরও এক চামচ ঢেলে বাবা বললেন, – খাও, লজ্জা কইরো না!
খাওয়া শেষে কাকা রওনা হয়ে গেলেন। দাদু বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, – অমুরে ঠিকঠাক খাওয়াইছস তো?
বাবা গর্বোদ্ধত গলায় তদীয় পিতৃদেবকে উত্তর দিলেন, – হ বাবা, দিসি। আইটেম তো একটাই। গণপতি ঘোষের গব্যঘৃত। য্যান সাক্ষাৎ অমৃত। হেইডাতেই মজা পাইসে বিস্তর।
বাঙালেরা খেয়ে ভালো লাগলে বলে, খাইয়া মজা পাইসি।
কদিন বাদে, প্রায় দেড় মাস জ্বরভোগের পর আমি আর মা উঠেছি। মা রান্নাঘরে গিয়ে তাঁর সাম্রাজ্য স্ক্রুটিনি করে বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন,- তুমি কি লুচি ভেজেছিলে এর মধ্যে?
– আমি? আমি লুচি ভাজতে পারি?
– তবে? আমার ভাজা ডালডা রাখার কাচের বয়ামের জমাট ডালডা আদ্ধেক কেন? এই তো চামচে করে খাবলা খাবলা তোলার দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
– কই, দেখি!
বাবা সাগ্রহে সেই বয়ামটা দেখে হঠাৎই নতমুখ।
– ও বাবা, চুপ করে গেলে কেন?আসন্ন দ্বৈরথ দেখার উদগ্র আগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
– না, মানে ওটাই তো অমু-কে আমি উৎকৃষ্ট গাওয়া ঘি বলে যাবার দিন ইয়ে, মানে সার্ভ করেছি!
পরের দিনই শ্রীমান অমিয়র ৫৬ এপিওর ঠিকানায় চিঠি গেল,- অমু, তোমার পেট কোনরূপ… না মানে বাবা জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন… ইত্যাদি।
এই ছিল বড়দের মান্য করার সেকাল। ভর্জিত ডালডা দিয়ে মেখে ভাত খেয়েও খাঁটি গব্যঘৃত খাবার অভিব্যক্তি করতে পারা সেই নির্বোধ সময়।
না হে, আমার কন্যা ও পুত্ররা! তোমরা বড়দের মান্য করার এই অনুভূতি বুঝতে পারবে না।