Doctor, heal thyself
কিন্তু দমকলেই যদি আগুন লাগে, সে আগুন নেভাবে কে?
নেভানোর প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগুন যে লাগতে পারে, আগুন লাগে এবং লেগেছে—একথা সমাজ, সরকার এমনকী চিকিৎসা কর্মীরা নিজেরাও বোঝে না, বুঝতে চায় না, স্বীকার করে না বা স্বীকার করতে চায় না। সোজা কথায়, জেনেও না জানার ভান করে।
কিন্তু বালির মধ্যে মুখ গুঁজে থাকলেই তো ঝড় থেমে যায় না। গবেষণালব্ধ ফলাফল বলছে—পেশাগত বিপদ এবং অসুস্থতার নিরিখে স্বাস্থ্যকর্মীরা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে আছে। এমনকী কৃষিকাজ ও নির্মাণকর্মে নিযুক্ত কর্মীদের পেশাগত বিপদও স্বাস্থ্যকর্মীদের তুলনায় অনেক কম।
চিকিৎসাকর্মী বা স্বাস্থ্যকর্মী বলতে শুধু চিকিৎসকদের বোঝানো হয় না। নার্স, আয়া, টেকনিশিয়ান, ল্যাবরেটরি কর্মী, শল্যচিকিৎসার সহকারী, রেডিয়োলজি টেকনিশিয়ান, হাসপাতালে নিযুক্ত সমাজকর্মী, ক্যাটারিং কর্মী, সুরক্ষাকর্মী, ঝাড়ুদার—অর্থাৎ চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরিভাবে বা ঘুরিয়ে যুক্ত সব কর্মীই স্বাস্থ্যকর্মী। রোগী এবং রোগীর পরিবারকে স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে গিয়ে এঁরা সকলেই এক বা একাধিক অসুখ অথবা দুর্ঘটনার শিকার হন, বা দুর্ঘটনার সম্ভাবনার মধ্যে কাজ করতে বাধ্য হন।
রোগী, রোগীর পরিজন, সমাজ, সরকার, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য প্রশাসক এমনকী স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেরাও এসব জেনে বা না জেনে উপেক্ষা করেন। অথচ স্বাস্থ্য পরিষেবার মান ও লভ্যতা অনেকটাই স্বাস্থ্যকর্মীদের সুস্থতার উপরে নির্ভর করে।
চিকিৎসাক্ষেত্রে মানুষের শরীর ও তার অসুখবিসুখ, বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ, ওষুধ, বায়োলজিক্যাল টিস্যু, ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি, দাহ্য ও ভঙ্গুর পদার্থ নিয়ে কাজ করতে হয়। তাই হাসপাতাল, নার্সিংহোম থেকে শুরু করে পলিক্লিনিক, পরীক্ষাগার, প্রসূতি সদন, আউটডোর, ইনডোর ওয়ার্ড, এমার্জেন্সি, অপারেশন থিয়েটার, লেবার রুম, মর্গ—সর্বত্র বিপদের সম্ভাবনা থাকে। দূষিত-সংক্রমিত বস্তু, পুঁজ, রক্ত, মল, মূত্র, মনুষ্য শরীরের টিস্যু, হাড়, মজ্জা, মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি, ছুরি, কাঁচি, ওষুধ, গ্যাস, তেজস্ক্রিয় বস্তু—অসংখ্য বিপজ্জনক জিনিস নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজ করতে হয়। সামান্যতম অসতর্ক হলেই বিপদের সম্ভাবনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়তি কাজের বোঝা, অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য হওয়া, ক্লান্তি, অবসাদ, অকারণে ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা, কর্মস্থলে যথাযথ সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অজানা বিপদের চেয়ে চেনাজানা বিপদের মোকাবিলা করা সহজ। তাই মূল যে সমস্ত ক্ষেত্র এবং যে সব কারণে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পেশাগত দুর্ঘটনা, চোট ও অসুখ হয়ে থাকে সেগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা এবং সচেতনতা প্রয়োজন।
১. সংক্রমণ—হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মীরা মূলত তিনভাবে সংক্রমিত হতে পারেন। রক্তবাহিত সংক্রমণ, বাতাসবাহিত সংক্রমণ এবং জলবাহিত সংক্রমণ। হাসপাতাল থেকে যে জীবাণু স্বাস্থ্যকর্মীদের শরীরে ঢোকে, তাদের একটা বড়ো অংশ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়।
ক) রক্তবাহিত সংক্রমণ— অপারেশন থিয়েটার, ওয়ার্ড, ইনডোর, আউটডোর, ল্যাবরেটরিতে ইঞ্জেকশন দিতে যাওয়ার সময়, স্যালাইন বা রক্ত দেওয়ার সময় অথবা রক্তপরীক্ষার জন্য রক্ত নেওয়ার সময় স্বাস্থ্যকর্মীর শরীরে সুচ ফুটে যেতে পারে। অপারেশনের সময় শল্য চিকিৎসক, তার সহকারী, ওটি নার্স, টেকনিশিয়ানের হাত বা অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্লেড বা ওই জাতীয় ধারালো যন্ত্রে কেটে যেতে পারে। রক্ত অথবা রক্তরস, পুঁজ, রোগীর শরীর থেকে নির্গত কোনো তরল পদার্থ স্বাস্থ্যকর্মীর চোখে বা মুখে চলে যেতে পারে। এভাবে রোগীর শরীর থেকে ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া, ছত্রাক বা পরজীবী স্বাস্থ্যকর্মীদের দেহে সংক্রমিত হয়ে মারাত্মক রোগ—এইডস, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি ইত্যাদি হয়ে সিরোসিস, ক্যান্সার হতে পারে, এমনকী মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিরল কিছু ক্ষেত্রে সেলুলাইটিস, হাড়ে এবং গাঁটে প্রদাহ, গ্যাংগ্রিন হয়ে যেতে পারে।
খ) বায়ুবাহিত সংক্রমণ— রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস, কাশি, সর্দি, লালা ইত্যাদি থেকে স্বাস্থ্য কর্মীদের যক্ষ্মা, কোভিড, ইনফ্লুয়েঞ্জা, চিকেন পক্স, সোয়াইন ফ্লু, বার্ড ফ্লু, কুষ্ঠ ইত্যাদি হতে দেখা যায়। কোভিড, যক্ষ্মা, ফ্লু জীবনহানিও ঘটাতে পারে। এগুলো নিয়ে পরে আরেকটু আলোচনা করা হবে।
গ) জলবাহিত সংক্রমণ— হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পানীয় ও চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত জলে ভাইরাস ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ ঘটতে পারে।
ঘ) অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী সংক্রমণ— হাসপাতালে বেশিদিন ভর্তি থাকা রোগী, বিশেষত ইনটেনসিভ কেয়ারের রোগীদের শরীরে যে সমস্ত ব্যাকটিরিয়া আশ্রয় নেয়, সেগুলোর একটা বড়ো অংশের কোষে জিনগত পরিবর্তন হয় ও সেই ব্যাকটিরিয়াগুলো অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটিরিয়ায় পরিণত হয়। এই ব্যাকটিরিয়ায় স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হতে পারে অথবা তারা এই ব্যাকটিরিয়া তাদের শরীরে বাড়িতে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের পরিবারের সদস্যদেরও একইভাবে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই এক্ষেত্রে কাজ করে না, সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ঙ) যক্ষ্মা— এই রোগটি আমাদের দেশে যেকোনো মানুষের হতে পারে। আদতে ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষের শরীরে যক্ষ্মার জীবাণু বাসা বেঁধে থাকে, সবার যক্ষ্মারোগ হয় না। তবে গরিব, অপুষ্টিতে ভোগা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করা মানুষ, শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া মানুষ, ডায়াবেটিস, এইডস আক্রান্ত রোগী, কমবয়েসি ও অত্যধিক পরিশ্রমকারী ও অনিয়মিত খাদ্যগ্রহণকারী, অভুক্ত মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। চিকিৎসাকর্মীদের যেসব যক্ষ্ণারোগীদের সংস্পর্শে আসতে হয় তাদের অনেকেরই নিশ্বাসে প্রচুর সংখ্যক জীবিত যক্ষ্ণা-জীবাণু থাকে, ফলে তাদের সহজেই এই জীবাণুর শিকার হতে হয়। তার ওপরে অনেক স্বাস্থ্যকর্মীর অত্যধিক পরিশ্রম করতে হয় ও খাওয়া-দাওয়ার ঠিক থাকে না, তাই তারা সহজেই যক্ষ্মাক্রান্ত হয়।
চ) কোভিড— বায়ু ও ড্রপলেট বাহিত রোগ কোভিড গত তিন বছরে সারা পৃথিবী জুড়ে কত লক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর প্রাণ কেড়েছে তার হিসেব নেই!
ছ) জলাতঙ্ক— জলাতঙ্কের আইসোলেশন ওয়ার্ডে কাজ করা নার্স, চিকিৎসাকর্মী, টেকনিশিয়ান সবার জলাতঙ্ক হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। জলাতঙ্ক হলে মৃত্যুর সম্ভাবনা এক-শো শতাংশ।
২. দুর্ঘটনা
ক) বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়া— খারাপ হয়ে যাওয়া বৈদ্যুতিন মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি থেকে চিকিৎসাকর্মীদের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হওয়া খুব অস্বাভাবিক বা বিরল ঘটনা নয়।
খ) পুড়ে যাওয়া ও আগুন লাগা— হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক তার ও দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্য থেকে আগুন লেগে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীরা দগ্ধ হতে পারে, এমনকী তাদের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
গ) বিষাক্ত রাসায়নিকে আক্রান্ত হওয়া— হাসপাতাল, পরীক্ষাগার ও ক্লিনিকে অনবধানতার কারণে অনেক সময়ই বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য শরীরে লেগে বা প্রবেশ করে স্বাস্থ্যকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে।
ঘ) বিকিরণজনিত অসুস্থতা— হাসপাতাল, পরীক্ষাগার, অপারেশন থিয়েটার ও ক্যান্সার চিকিৎসাকেন্দ্রে রোগীর রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য এক্স-রে বা আণবিক বিকিরণ ব্যবহৃত হয়। যদিও এক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা নিয়ম, তবুও এক্স-রে বা সিটি স্ক্যানের টেকনিশিয়ান, রেডিয়োলজিস্ট, অর্থোপেডিক সার্জন, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, নার্স, সহকারী, ক্যান্সার কেন্দ্রের টেকনিশিয়ান ও ইঞ্জিনিয়ারদের শরীরে বিপজ্জনক মাত্রায় বিকিরণ প্রবেশ করতে দেখা যায়। এদের অনেকেরই অত্যধিক বিকিরণজনিত কারণে ক্যান্সার, বন্ধ্যাত্ব, হাড়ের রোগ, চোখে ছানি ইত্যাদি হতে পারে।
ঙ) আঘাত— হাসপাতালে যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে, অপারেশন থিয়েটার বা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে যন্ত্র ভেঙে পড়ে দুর্ঘটনা একেবারেই বিরল নয়। এ থেকে চিকিৎসাকর্মীরা চোট পেতে পারে, এমনকী স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে।
৩. অন্যান্য
ক) অস্টিয়োপোরোসিস ও ভিটামিন ডি-র অভাব— অস্বাস্থ্যকর রুটিন, অপুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস, বিশ্রামের অভাব, সারা দিনরাত ঘরের ভিতরে এয়ারকন্ডিশনের মধ্যে কাজ করা—এসবের ফলে স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে অস্টিয়োপোরোসিস ও ভিটামিন-ডি এর অভাব অনেক বেশি হয়।
খ) উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ— শরীরচর্চার অভাব, এলোমেলো খাওয়ার সময় ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং মানসিক চাপের কারণে সাধারণ মানুষদের তুলনায় একই বয়েসি স্বাস্থ্যকর্মীদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ ইত্যাদি বেশি হয়।
গ) মানসিক অসুস্থতা— সারাক্ষণ প্রবল মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করতে করতে ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক রোগগ্রস্ত হওয়া খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ক্লান্তি, বিশ্রামের অভাব, একটানা কাজ, অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ এবং মানসিক শান্তির অভাব। সুস্থ সামাজিক কর্মকাণ্ডে যোগদান করা বিশেষ সম্ভব হয় না। রোগীর তথাকথিত আপনজন ও প্রশাসকদের ক্রমাগত হুমকি এবং অসংবেদনশীল আচরণও স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক অসুস্থতার জন্য অনেকাংশে দায়ী। ফলত মানসিক অবসাদ, আত্মহত্যার প্রবণতা, নেশায় আসক্তি, সিজোফ্রেনিয়া এবং অন্যান্য মানসিক রোগ এদের মধ্যে বেশি হয়।
রোগীর পরিজন ও সমাজবিরোধীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া
স্বাস্থ্যকর্মীদের অসুস্থতার এই কারণটি নিয়ে আলাদা করে বলার দরকার আছে। কোনো কারণে রোগী সুস্থ না হলে বা রোগীর পরিজনের যৌক্তিক ও অযৌক্তিক আশা পূরণ না হলেই হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভাঙচুর, স্বাস্থ্যকর্মীদের শারীরিকভাবে নিগ্রহ করা এখন নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা।
সরকারি ও বেসরকারি দুই ধরনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাতেই স্বাস্থ্যকর্মীদের যথাযথ সুরক্ষা ব্যবস্থা ও সুরক্ষা বিষয়ক ট্রেনিং-এর অভাব পরিলক্ষিত হয়। কিছু কিছু বড়ো এবং বেসরকারি হাসপাতালে এবং সরকারি মেডিক্যাল কলেজে মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা—যেমন জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন, এন.এ.বি.এইচ., এন.এ.বি.এল., জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতির নজরদারি থাকে। সেক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিদর্শন ও নজরদারি চলাকালীন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। তারপর আবার যে কে সেই।
এক্ষেত্রে সরকার, স্বাস্থ্য প্রশাসক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি পেশাগত অসুখ ও সুরক্ষার বিষয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজস্ব উদাসীনতাও অনেকাংশে দায়ী। এমনকী, আক্রান্ত হলেও তার যথাযথ চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ ও পুর্নবাসনের ক্ষেত্রে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রচুর অব্যবস্থা ও গাফিলতি দেখা যায়।
এই পেশাগত অসুস্থতা প্রতিরোধ করা অনেকাংশেই সম্ভব। তবে তার জন্য প্রয়োজন সঠিক সচেতনতা, স্বাস্থ্যকর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, সমাজ, রোগীর পরিজন, প্রশাসন ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সংবেদনশীলতা।
চিকিৎসা পেশাতেও যে অন্যান্য পেশার মতো পেশাগত বিপদ ও অসুস্থতার সম্ভাবনা আছে—এই কঠিন সত্যিটা সব পক্ষকে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। চিকিৎসক-নার্সদের দেব-দেবী কিংবা দানব-দানবী ভাবা বন্ধ করতে হবে। তারাও যে রক্তমাংসের মানুষ, তাদেরও খিদে, ঘুম, বিশ্রাম, প্রস্রাব-পায়খানা ইত্যাদি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার প্রয়োজন আছে, এটা বুঝতে হবে।
চিকিৎসাকর্মীদের নিজেদের পেশাগত সমস্যা ও অসুস্থতার বাস্তব গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে। যথাযথ সুরক্ষা ও শৃঙ্খলা মানতে হবে। পেশাগত সুরক্ষার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং সবাইকে সেটা নিতে হবে। প্রয়োজনীয় স্থানে এবং পরিস্থিতিতে বিকিরণ প্রতিরোধী পোশাক, পার্সোনাল প্রোটেকটিভ ডিভাইস (বা পিপিই, কোভিডের সময়ে যেমন সারা দেহ-মুখ ঢাকা পোশাক আপনারা সবাই দেখেছেন), মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদি পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে। মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি ঠিকমতো চলছে কিনা তা নিয়মিত পরীক্ষা করাতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের সময় ও প্রয়োজনমত হেপাটাইটিস-বি, কোভিড, ইনফ্লুয়েঞ্জা, জলাতঙ্কের ভ্যাকসিন নিতে হবে। রোগীদের রক্তবাহিত ভাইরাসের পরীক্ষা নিয়মিত করাতে হবে। বিপজ্জনক রাসায়নিক নিয়ে কাজ করা কর্মীদের উপযুক্ত প্রতিরোধক পোশাক দিতে হবে।
পেশাগত কারণে কোনো চিকিৎসাকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চিকিৎসার দায়িত্ব সরকার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। চিকিৎসাকর্মীর অঙ্গহানি ঘটলে তার আশু পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পেশাগত কাজে তার মৃত্যু হলে পরিবারকে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়িত্বও সরকারের।
স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। অবিলম্বে শূন্যপদগুলো পূরণ করার দরকার। সরকার, প্রশাসন ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বুঝতে হবে স্বাস্থ্যকর্মীরা যন্ত্র নয়। তাদের কাজের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দিতে হবে।
সর্বোপরি হাসপাতাল, নার্সিংহোম ও ক্লিনিকে চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সমাজকর্মীদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। রোগের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে। নয়তো রোগী ও চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যে দূরত্ব রয়েই যাবে। আর এরকম অসুস্থ পরিবেশে উচ্চমানের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া কোনোদিনই সম্ভব হবে না।