২০০৮-এ কাঁধে একটা সস্তার রুকস্যাক আর পকেটে দেড়শ খানিক টাকা নিয়ে যখন ট্রেন থেকে নেমেছিলাম নিউ জলপাইগুড়ি ইস্টিশনে এবং অটোয় চেপে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে অবাক চোখে দেখছিলাম ধুলোয় ঢাকা শহরের দিগন্তে নীলচে পাহাড়ের হাতছানি, তখনো, ওই তখনো ডাক্তার হতে চাইনি আমি। এম বি বি এস পাস করেছি শুধুমাত্র। এবং সেটাও বাবা চেয়েছিল বলেই। বাবা, জোর করেছিল বলেই। নয়ত আমার তো কথা ছিল ঝোল্লা পাঞ্জাবি আর কাঁধে শান্তিনিকেতনী নিয়ে বাংলা অনার্স পড়ার। যেখানে কলেজে থাকবে গুলমোহর আর কৃষ্ণচূড়া, আর ক্যান্টিনে থাকবে ক্যাপস্টেন আর মাঠের দুর্বায় থাকবে মহীনের ঘোড়া গাওয়া ছোট্ট ছোট্ট বান্ধব-বৃত্তরা। থাকবে বন্ধুরা। থাকবো আমি। থাকবে মাধবীলতার মতো — সে। আর থাকবে শ্লোগান,দেওয়াল-স্টেনশিল কিংবা ঘাস ছুঁয়ে যাওয়া আলতো ফড়িং। এবং এইভাবেই পার করবো এলোমেলো পায়ে– কলেজ।
সেসব হয়নি। পড়লাম মেডিক্যাল কলেজ কলকাতায়। শ্লোগান ছিল যদিও, বান্ধব বৃত্ত কিংবা দেওয়াল স্টেনশিলও। কিন্তু ঐভাবে না। ওই স্বপ্নের মতো না। ওই আর্ট কলেজের ক্যানভাসের মতো না। ছিল, একটু অন্যরকম ভাবে। এবং ওই অন্যরকম ভাবেই একদিন ইন্টার্নশিপ আর হাউজ সার্জেনশিপ শেষ করে সরকারি চাকরি নিয়ে যখন হাজির হচ্ছি উত্তরবঙ্গ চত্বরে, তখনো … সেই তখনো মনটা ছটফটিয়ে আছে ছুঁতে না পারা গুলমোহর-কৃষ্ণচূড়ার দিনগুলোতে।
আর তারপর হঠাৎ সবটা বদলে গেল একটু একটু করে। একটার পর একটা মুখ আমার আউটডোরের চেয়ারের সামনে এসে দাঁড়াতে শুরু করলো যত, তত… ঠিক ততটাই বুঝতে পারলাম যে, এই গল্পগুলোকেও ছুঁতে চেয়েছি আমি। চেয়েছি, এই গল্পগুলোর মাঝখানে আমৃত্যু থেকে যেতে। লকডাউনে দুখানা পেল্লায় মুলো হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া রিকশাওয়ালা তেগ বাহাদুর, বেখাপ্পা বুটজুতো পরে মেয়ের হাত ধরে একই সানকি থেকে ভাত খাওয়া প্রৌঢ়, যে দিন কতক আগেই বিক্রি করে দিয়েছে আরেক মেয়েকে কিংবা “পায়খানা হয় না… পায়খানা হয় না” বলে হরেকদিন বি কমপ্লেক্স নিয়ে যাওয়া হাসিমুখো এক বৃদ্ধ… । শ্লোগান বা স্টেনশীল তো আদতে অনেক আর অনেকখানিই কাগুজে। সত্যিকারের ভারতবর্ষকে যদি চিনতে হয়, জানতে হয় ভারতবর্ষের যন্ত্রণাকে আর হাত রাখতে হয় সেই যন্ত্রণাতে সাবধানী, তাহলে ডাক্তার হয়ে উঠতে পারাটাই বোধহয় সবচাইতে শ্রেয় পথ।
এই বইতে পাতার পর পাতা জুড়ে রেখে গেলাম আমার সেই ডাক্তার হয়ে ওঠারই গল্প। এম বি বি এস পাশ করলেই তো ডাক্তার হয়ে যাওয়া যায় না। অন্তত আমি তো পারিইনি। পেরেছি এই ১৩ বছর সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলোতে। এই বই, সেই মুহূর্তগুলোরই কোলাজ।
আর বাকি রইলো গুলমোহর কিংবা কৃষ্ণচূড়া। সেসব নাহয় অন্য কোনো জীবনে।
আপাতত, এই জীবনে আমার সমস্ত আবেগ, সমস্ত কষ্ট, সমস্ত লড়াই, সমস্ত মনখারাপ কিংবা সমস্ত প্রেম এই ডাক্তার হয়ে ওঠাতেই।
বাবা, থ্যাংক ইউ। জোর করেছিলে ভাগ্যিস।
#লিরিক্যাল প্রকাশ করছে, #দাস্তান_এ_দাবাখানা।
সম্পাদক সমরন হুদা
চিত্রশিল্পী শুভদীপ ভট্টাচার্য মাথার উপর সুমেরু মুখোপাধ্যায় আর লেখা থেকে শুরু করে এডিটিং তক সুরভিপ্রজ্ঞা দাশগুপ্ত।
আমার কোনো বইয়েরই কোনো সংস্করণ শেষ হয় না।
সুতরাং… পছন্দ হলে আর পকেট-সই হলে খরিদ করবেন।
কেমন?