রায়গঞ্জ এক প্রান্তিক জেলাশহর – অবহেলিত উত্তরবঙ্গের। বিখ্যাত পরিচালক ফ্রান্সেস্কো রোজির পরিচালনায় সাড়া ফেলা চলচ্চিত্র “ক্রাইস্ট স্টপড অ্যাট এবোলি”-তে দেখিয়েছিলেন যীশু খ্রিস্ট যেখানে (এবোলি) যেতে পারেননি সেখানে যুদ্ধ এবং মৃত্যু পৌঁছে গেছে। এর সাথে রায়গঞ্জে করোনাকালের কিছুটা তুলনা চলে। বিশ্বের ২০০-র কাছাকাছি দেশে এই অতিমারি ছড়িয়েছে। রায়গঞ্জও ব্যতিক্রম নয়।
এখানে উল্লেখ করতে হবে যে রায়গঞ্জ করোনাকে আবাহন করেনি। কিন্তু করোনা সংক্রমণ ছোট্ট এই গ্রামীণ শহরকে সামাজিক ও মানসিকভাবে এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার ক্ষেত্রে উদ্ব্যস্ত করেছে, যেমন করেছে পৃথিবীর সমস্ত দেশকে। এরা কেউই করোনাকে ডেকে আনেনি। করোনা বিশ্বব্যাপী কর্পোরেট পুঁজির মুনাফার জন্য উদগ্র লালসার বিষময় উপজাত সামগ্রী। ২০১১ থেকেই বিশ্বের বিজ্ঞানীদের একাংশ এরকম একটি মারাত্মক অতিমারির ব্যাপারে সতর্ক করে আসছিলেন।
২০০৯ সালে তৈরি USAID-এর সাহায্যপুষ্ট “প্রেডিক্ট প্রোজেক্ট” তৈরি হয়েছিল। প্রেডিক্ট প্রোজেক্টের প্রোগ্রাম ১,২০০ বিভিন্ন ভাইরাসকে চিহ্নিত করে যার মধ্যে ১৬০টি নোভেল করোনাভাইরাস ছিল। য়ুহান সহ পৃথিবীর ৬০টি ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানী এবং টেকনিশিয়ানদের ট্রেইনিং দেওয়াও শুরু করেছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন করোনা অতিমারির শুরুর সময়ে (মার্চ, ২০২০) “শিব ঠাকুরের আপন দেশে / আইন কানুন সর্বনেশে”-র মতো কলমের এক আঁচড়ে এরকম একটি মূল্যবান প্রোজেক্ট বন্ধ করে দিল। বিজ্ঞানের ক্ষতি হল, ক্ষতি হল মানুষের।
নেচার এবং নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনের তুল্য জার্নালগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণাপত্র দেখিয়েছে করোনা ভাইরাসের মতো বিভিন্ন জুনোটিক ভাইরাস (যারা প্রাণী দেহ থেকে মনুষ্য দেহে এসে বসতি তৈরি করে) গত দু দশকে বিপুল পরিমাণে ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ বিশ্বব্যাপী মুনাফার জন্য জমি ব্যবহারের ধরন পরিবর্তিত হওয়া এবং বনাঞ্চলের দ্রুত ও বিপুল হ্রাস।
করোনার সময়ে আমরা প্রকটভাবে প্রত্যক্ষ করলাম মেডিক্যাল-ইন্ডাস্ট্রিয়াল-স্টেট-পলিটিক্স কমপ্লেক্স-এর চরিত্র। এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ – বহুজাতিক কোম্পানি মাইলানের মদতপুষ্ট আমেরিকার ট্রাম্পের হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনকে “গেম চেঞ্জার” আখ্যা দেওয়া এবং, পরিণতিতে, রাষ্ট্র রাজনীতি ও ইন্ডাস্ট্রির কাছে বিজ্ঞান নতজানু হয়ে পড়ে। আমেরিকার আন্তর্জাতিকভাবে মান্য সংস্থা এফডিএ ওষুধটিকে গ্রাহ্যতা দেয়। শেষ অব্দি গতবছর জুন মাসে ইংল্যান্ডের “রিকভারি ট্রায়াল” প্রকাশিত হবার পরে ওষুধটি পরিত্যক্ত হয়। ঘটনা এতদূর অব্দি পৌঁছেছিল যে ব্রাজিলের স্বাধীন-মনস্ক চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে ট্রায়াল রিপোর্ট তৈরি করা প্রত্যাখ্যান করলে প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। এ সংবাদ ল্যান্সেটে প্রকাশিত হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা নিজেদের নাম গোপন করে ট্রায়াল রিপোর্ট প্রকাশ করেন।
মজার ব্যাপার, এমনকি প্রাচীন কবি চসারের লেখাতেও কোভিডের উল্লেখ পাওয়া যায়।
এক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাইরাস। এক অদৃশ্য শত্রু। আর তার জেরেই পাল্টে গেল তামাম দুনিয়া, আমাদের দৈনন্দিনের যাপিত জীবন। বিশ্বব্যাপী তান্ডবে প্রাণ হারালেন অগণিত মানুষ (৩০ লক্ষেরও বেশি)। রুজি গেল ততোধিকের। কিছুটা হলেও অতিমারীর দাপট এখন নিয়ন্ত্রনে, অন্ততপক্ষে ভারতে। শত্রু ভাইরাসকে আমরা এখন একটু বেশি চিনি। কিন্তু একবার মনে করুন তো একেবারে গোড়ার দিকের কথা। একটি করে সংক্রমণের খবর আসছে আর আতঙ্কে শিউরে উঠছি আমরা। মানুষে মানুষে অবিশ্বাস। দেশে দেশে পারস্পরিক দোষারোপ, বিদ্বেষ। সন্ত্রস্ত মানুষ জীবন বাঁচাতে নিজের ঘরে সেঁদিয়ে যাচ্ছেন। জীবিকার কথা তখন গৌণ।
কি এই ভাইরাস? সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হল এই ভাইরাসের গায়ে “স্পাইক প্রোটিন” থাকে। সমস্ত বিপত্তির মূলে এই স্পাইক প্রোটিন। শরীরে প্রবেশের পরে দেহের কোশে এই প্রোটিন জোড় বেঁধে অসম্ভব সব বিপজ্জনক জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটাতে থাকে এবং মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। করোনার সেই প্রথম দিনগুলিতে রেঁস্তোরায়, রাস্তায় সকলের চর্চা সূর্যের ছটার মতো দেখতে আণুবীক্ষণিক সেই ভাইরাসকে নিয়ে। অনেকেই তখন তার তীব্রতা তথা মারণক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করছেন। অনেকে আবার যথেষ্ট সাবধানী। এখন আবার করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আসছে। রায়গঞ্জেও নতুন করে শুরু হয়েছে সংক্রমণ – যদিও এখনো মা্রাত্মক আকার ধারণ করেনি। করতে ক’দিন?
(সারা গায়ে সুর্যের ছটার মতো দেখতে স্পাইক প্রোটিন)
কি ঘটলো রায়গঞ্জে করোনার প্রথম অধ্যায়ে? সাধারণ চোখে দেখতে গেলে, ক্রমাগত মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। আলাদা করে কোভিড হাসপাতাল খোলা হল। সে হাসপাতালের সব বেড ভর্তি হয়ে গেল। রায়গঞ্জের চারজন চিকিৎসক মৃদু থেকে মাঝারি উপসর্গসম্পন্ন মানুষকে ফোনের মাধ্যমে চিকিৎসার জন্য নিজেদের এক্সপার্টাইজের হাত বাড়িয়ে দিলেন। “স্থানান্তরী শ্রমিকাদের” মুখে অন্ন জোগানোর জন্য অগ্রণী রাজনৈতিক কর্মীরা “শ্রমজীবী ক্যান্টিন” খুললেন।
তাহলে অন্য সব জায়গার মতো রায়গঞ্জেও করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য নিয়ে দুটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে এলো – প্রথমত, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা সুরক্ষিত করে করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে একেবারে বুনিয়াদি স্তর থেকে প্রতিরোধের ব্যবস্থা সম্ভব কিনা; দ্বিতীয়ত, সমাজের দুর্বলতর শ্রেণীর ক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষার সুনিশ্চিত বন্দোবস্ত কিভাবে হচ্ছে। খোদ বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা জানিয়েছে – যে সমস্ত দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নগুলো প্রধান গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে সে দেশগুলো করোনা মোকাবিলায় অনেক বেশি সফল হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে রয়েছে নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশগুলো। খেয়াল করলে দেখবো করোনার দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউ ইউরোপ, আমেরিকা এবং ভারতবর্ষে যেরকম অভিঘাত তৈরি করেছে এ দেশগুলোতে সেরকম অভিঘাত তৈরি করেনি।
যাহোক, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মুখে দাঁড়িয়ে রায়গঞ্জ এবং উত্তর দিনাজপুর। জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী (৬ এপ্রিল, ২০২১) –
জেলায় মোট কেসের সংখ্যা ৬,৮১১। সেরে উঠেছে – ৬,৫৩৮।
মোট অ্যাক্টিভ কেস – ১৮২।
মৃত রোগীর সংখ্যা – ৭৮।
একাধিক কোভিড হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা – ১২।
জেলার বাইরে থেকে আসা রোগীর সংখ্যা – ৬।
বাইরে একজন রোগীকেও রেফার করতে হয়নি। হোম আইসোলেশনে থাকা রোগীর সংখ্যা – ১৬৪, যারা এখনো অনেক ক্ষেত্রে ফোনের মাধ্যমে আগে উল্লেখিত চিকিৎসকদের পরামর্শ গ্রহণ করছেন।
সেরে ওঠার হার – ৯৫.৯৯%।
রায়গঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যা – ১২।
ইসলামপুর উর্দু অ্যাকাডেমি কোভিড হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা শূন্য।
করোনাকালে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া এবং রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা একটা বিষয়কে সামনে নিয়ে এলো – আপৎকালীন পরিস্থিতিতে সরকার যে উদ্যোগ জনসাধারণের জন্য নিতে পারে, স্বাভাবিক সময়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য এই উদ্যোগ নিলে যেকোন ধরনের রোগ প্রতিরোধ করা এবং রোগের মোকাবিলা করা অনেক শজ হয়ে দাঁড়ায়। এরকমই নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সেখানে কাজে লাগানো যায়। পরিণতিতে সরকারি কোষাগারের ওপরে চাপ কম পড়ে।
কিন্তু এখানে উল্লেখ করতে হবে, সরকারি হাসপাতাল থেকে করোনার চিকিৎসার সময় রোগীদের বিভিন্ন অপরীক্ষিত ওষুধ দেওয়া হয়েছে – যেমন, হাইড্রক্সিক্লোরোকূঈণ, আইভেরমেক্টিন, ডক্সিসাইক্লিন ইত্যাদি। করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এ ওষুধগুলোর কোন ভূমিকাই নেই। পরবর্তীতে এ ওষুধগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ট্রায়ালে পরিত্যক্ত হয়েছে। বিজ্ঞান-অপবিজ্ঞান-ভুল বিজ্ঞানের মাঝেকার ভেদরেখা বোঝারও সময় ছিল এই করোনাকাল।
করোনা-প্রতিরোধী (যদিও এখনো দাবী করা যাবেনা যে টিকার ফলে ১০০% প্রতিরোধ দীর্ঘকাল ধরে সম্ভব) টিকাকরণের ক্ষেত্রে রায়গঞ্জের সাফল্য নজরে পড়ার মতো। মোট টিকাপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা ১,৩১,০০০ এবং টিকার দুটি ডোজই সম্পন্ন হয়েছে এরকম মানুষের সংখ্যা ১৭,০০০। জেলা স্বসাথ্যদপ্তর থেকে পাওয়া (৭.০৪.২১) এই হচ্ছে সর্বশেষ তথ্য।
৫ মে, ২০২০-তে ইংরেজি দৈনিক টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রের একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল – “Viral rumour helps keep lockdown”। এর কারণ ছিল – “after the train reached here, a rumour that it is carrying corona-virus infected workers from other states spread across Raiganj, prompting people to rush back home.”।
অন্য সব জায়গার মতো রায়গঞ্জেও লকডাউন পরবর্তী সময়ে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ (বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া)। শিক্ষার্থীদের ওপরে, ইউরোপ বা আমেরিকার মতো, এর মানসিক চাপ কি কি ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করছে তার কোন হিসেব আমাদের কাছে নেই। ক্লাস ঘরের পরিবর্তে অন্তহীন অনলাইন ক্লাস সামাজিক মানসিকতাকে (social psyche) কিভাবে পুণর্গঠিত করছে তারও কোন হিসেব আমাদের কাছে অনুপস্থিত। হাঁচি-কাশি-স্বাভবিক মেলামেশা সবকিছুই নতুন ঢংয়ে এসেছে। এর আদুরে নাম “নিউ নর্মাল”।
করোনা-অতিবাহিত রায়গঞ্জের দৈহিক স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক স্বাস্থ্য, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি অস্তিত্ব যাপনের একেবারে গোড়ার বিষয়গুলো নতুন করে বড়োসড়ো হয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হল। এবার নিজেদের অন্তর্বেক্ষণের সময় সমাগত।
ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্যের বক্তব্যের সাথে আমি একমত।
প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি সচল থাকে এবং গ্রাম/ওয়ার্ডস্তরের স্বাস্থ্যকর্মীরা সচেতন করতে থাকেন সাধারণ মানুষকে তবে এই রোগ হওয়া বা বিস্তার আটকানো যায় অনেকটা।
অবশ্য তার জন্য দরকার যথেষ্ট সংখ্যক চিকিৎসাকর্মী (সরকারী বা স্বপ্রণোদিত)।
রায়গঞ্জ দারুণ লড়ছে।
অভিনন্দন সকলকে।
খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখা
খুব প্র য়োজনীয় সময়ের দাবি মেনে লেখা।রায়গঞ্জের চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো উচিৎ।
খুব সুন্দর লেখা
বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করার ফলে নিবন্ধটি পড়ে একাধিক প্রশ্ন মনে আসছে। লেখকের নিবন্ধগুলি পড়ে সাধারনভাবে মনে হয়েছে ওঁর মাথায় এত কিছু গিজগিজ করে যে একটি নিবন্ধে সব ঢোকাতে চান। সাধারণ পাঠক হিসেবে বলব লেখক দূ-একটি মূল বিষয় ধরে নিবন্ধ লিখলে ভাল হয়। তথাপি লেখাটি যে ভাল তা বলাই বাহুল্য।
Very informative !
লেখাটি সম্যক ধারনা দেয় বটে, কিন্তু সত্যি মানতে নারাজ দেশের পলিসি মেকাররা। মানুষের তৈরী এই ভাইরাস করপোরেট পুজির তামাশা বা বিনোদনের ফল একথা পার্লামেন্ট কে তুলবে। কার আছে হিম্ম! কে হবে আগুয়ান।