মহাপুরুষ
১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল। অমাবস্যার রাত। দুই সদ্য তরুণ যুবক পাথরের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন একটি অশ্বত্থ গাছের তলায়। স্থান-মুজঃফরপুর পার্ক।
লাগোয়া ইংলিশ ক্লাব থেকে তাস খেলা সেরে এখুনি বেরিয়ে আসবেন কুখ্যাত বিচারক ডগলাস কিংসফোর্ড। সময় রাত সাড়ে আটটা। ঠিক এই সময়টাতেই উনি বাড়ি ফিরে যান প্রতি রাতে।
অপেক্ষমাণ যুবকদ্বয়ের নাম দীনেশচন্দ্র রায় এবং দুর্গাদাস সেন মতান্তরে হরেন সরকার। হ্যাঁ, এই নাম নিয়েই ওঁরা এসেছেন কলকাতা থেকে। যে ধর্মশালায় এক সপ্তাহ আগে এসে উঠেছেন কলকাতা থেকে, সেখানকার রেজিস্টারেও এই দুটি নামই লেখা আছে। সেরকমই যে নির্দেশ ছিল কলকাতার নেতা বারীন ঘোষ আর হেমচন্দ্র কানুনগোর।
টাইম লাইনে যদি সময়টাকে এখানেই থমকে দেওয়া যায় তাহলে আসুন একটু ইতিহাস নিয়েও পর্যালোচনা সেরে নেওয়া যাক।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ নিয়ে সেই মুহূর্তে উত্তাল বাংলাদেশ তথা সারা ভারতবর্ষ। তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক মুখ কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত নরম এবং চরমপন্থীদের মধ্যে।
বিপিনচন্দ্র পাল আর অরবিন্দ ঘোষেরা বাংলায় এবং বালগঙ্গাধর তিলক মহারাষ্ট্রে আগুন ঝরানো বক্তব্যের মাধ্যমে সহিংস আন্দোলনকে প্রাত্যহিক সমর্থন জানাচ্ছেন। চরমপন্থী আন্দোলনের ঢেউ যত বাড়ছে, আরো নিষ্ঠুর প্রশাসকের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে ভারতের ব্রিটিশ সরকারকে।
অরবিন্দ ঘোষ, বিপিনচন্দ্র পাল, ব্রম্মমাধব উপাধ্যায়দের নেতৃত্বে শুরু হয়েছে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে দৈনন্দিন বিষোদগার। এতে সক্রিয় অংশ নিয়েছে দৈনিক যুগান্তর, বন্দেমাতরম এবং সন্ধ্যা পত্রিকাগুলি। বিদেশি পণ্য বর্জনের সাথে সাথে তরুণ ‘স্বদেশী’-রা সমর্থন জানাচ্ছেন এই চরমপন্থী পথের। ঢাকায় অনুশীলন সমিতি আর কলকাতায় যুগান্তর এককাট্টা করছে তরুণ জাতীয়তা-বাদীদের। সারা বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা।
কলকাতায় এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্তরা অরবিন্দ ঘোষের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় বোমা এবং আগ্নেয়াস্ত্র কোথা থেকে মিলবে?
হেমচন্দ্র কানুনগো নিজের জমিদারির কিছু অংশ বিক্রি করে চলে গেলেন প্যারিস। রাশিয়ান বিপ্লবী নিকোলাস স্যাফ্রিনস্কির কাছ থেকে নিলেন বোমা বানানোর পাঠ।সেটা ১৯০৭ সাল। কলকাতায় ফিরে হাতেকলমে কাজ শুরু হল মানিকতলার ৩২ নম্বর মুরারিপুকুর রোডে, অরবিন্দের পৈতৃক বাগানবাড়িতে।
এদিকে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী লেখাগুলি ক্রমশ ধার বাড়াতে লাগলো। বিপদ বুঝে চূড়ান্ত দমননীতি প্রয়োগ করা শুরু করল ব্রিটিশরা। বিদ্রোহী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে শুরু হল বিপ্লবীদের উপর ব্যাপক অত্যাচার।
বন্দেমাতরম পত্রিকায় সম্পাদকীয় কলমে সশস্ত্র বিপ্লবের সমর্থনে আগুন ঝরানো লেখার দরুন দুমাসের কারাদণ্ড হলো বিপিনচন্দ্র পালের। সমর্থক জনতার ভিড়ে নির্মমভাবে লাঠি চালালো ইংরেজ শাসক। ১৫ বছরের একটি কিশোর তার প্রতিবাদে আক্রমণ করে বসল এক সার্জেন্টকে। সেই দিনটা ছিল ২৬শে আগস্ট ১৯০৭।
১৫ বছরের সুশীল সেনকে ১৫ বার চাবুক মারার আদেশ দিলেন প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ড, যিনি এমনিতেই কুখ্যাত ছিলেন বিপ্লবীদের নিষ্ঠুর এবং কঠিন সাজা দেওয়ার জন্য।
তাই সেই দিনই বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে এই ম্যাজিস্ট্রেটকে আর বাঁচিয়ে রাখা চলবে না।
ইতিমধ্যে হেমচন্দ্র ফিরে এসেছেন বোমা বিশারদ হয়ে। মুরারি পুকুর রোড থেকে পার্সেল করে পিকরিক অ্যাসিড দিয়ে তৈরিএকটি বই বোমা পাঠানো হলো কিংসফোর্ডের বাড়িতে। কপালের ফেরে জজ সাহেবের সেই বইটি খোলেন নি। কিন্তু কলকাতার পুলিশ অনুমান করতে পেরেছিল যে সাহেবের জীবন বিপন্ন হতে চলেছে।
জজ সাহেবকে তাই পত্রপাঠ মুজঃফরপুরে বদলি করে দেওয়া হল।
কিন্তু বিপ্লবীরা ছাড়বার পাত্র নয়। তৈরী হতে লাগলো কিংসফোর্ডকে নিকেশ করার মাস্টার প্ল্যান।
উত্তরবঙ্গ থেকে আগত স্বাস্থ্যবান প্রফুল্ল চাকীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রথমে। পরে হেমচন্দ্র কানুনগোর ইচ্ছায় জুড়ে দেওয়া হল মেদিনীপুরের দামাল ছেলে ক্ষুদিরাম বসুকে।
এই ক্ষুদিরাম বসু ছেলেটি ১৯০৬ সাল থেকেই মেদিনীপুর পুলিশের চক্ষুশূল। স্বদেশী আন্দোলনের সময় জোর করে বিদেশী পণ্য বিক্রি করার চেষ্টা করাতে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন এক ব্যবসায়ীর দোকানে। স্বদেশী কাগজপত্র প্রচারে বাধা দেওয়ায় ঘুষি মেরে মুখ ফাটিয়ে দিয়েছিলেন পুলিশ কনস্টেবলের। ব্রিটিশ ‘ডাক’ গাড়ি থেকে লুঠ করে নিয়েছিলেন টাকার ঝুলি।
অকুতোভয় এই ছেলে, তমলুকে কলেরা রোগ মহামারী আকার ধারণ করলে, রোগীদের পাশে পৌঁছে যান সাহায্যের জন্য। ভিখারিকে অকপটে দান করে দেন বাবার কাছ থেকে পাওয়া একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন, দামি পশমিনা শাল।
১৯০২ সালে মেদিনীপুরে সিস্টার নিবেদিতা আর অরবিন্দ ঘোষের বক্তৃতা শুনে আর তাঁদের বই পড়েই ঠিক করে নিয়েছিলেন দেশমাতৃকার বন্ধন মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
স্কুল-কলেজের পড়াশোনা যে তাঁর জন্য নয় সে কথা জানিয়েও দিয়েছিলেন একমাত্র দিদি অপরূপাকে।
তাই মাত্র ১৫ বছর বয়সেই মেদিনীপুরে অনুশীলন সমিতির সদস্য হয়ে যান।
আর তারপর বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে প্রফুল্ল চাকীর সঙ্গে মুজ:ফরপুরে এসে পৌঁছানো। এবং নাম ভাঁড়িয়ে ধর্মশালায় ওঠা।
তারপর কয়েকদিন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের গতিবিধি লক্ষ্য করে নিশ্চিত করে বেছে নেওয়া বধ্যভূমিকে।
আর তাই আজ অমাবস্যার এই মসীলিপ্ত রাত্তিরে, পার্কের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন দুই বিপ্লবী, সেই অত্যাচারী ইংরেজ রাজপুরুষের জন্য। গায়ে জড়ানো চাদরে লুকিয়ে রয়েছে প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরী এই বোমা। হেমচন্দ্র কানুনগোর হাতে বানানো।ডাইনামাইট।
ক্লাব থেকে ফিটন গাড়িটা আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে।এক,দুই,তিন…..! দৌড়ে এগিয়ে গেলেন দুই আগুনে বিপ্লবী। ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে দেশমাতৃকার আহ্বানের সাথে সাথে আলোর তীব্র ঝলকানি আর কানফাটানো শব্দ। ছিন্নভিন্ন শকট আর মানুষের আর্তনাদ।
কিন্তু কিংসফোর্ডের গাড়ি সেটা ছিল না…..! সেই গাড়িতে ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেটের ব্রীজ খেলার পার্টনার প্রিঙ্গেল কেনেডির স্ত্রী আর কন্যা।
ইংরেজ শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সেই ছিল বিপ্লবী দের প্রথম প্রতিহিংসামূলক প্রতিবাদ। চোখের বদলে চোখ, বারুদের বদলা বারুদ। আর সেই বোমার আওয়াজের অনুরণন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট অবধি পৌঁছে গেল। সাহেবরাও এই প্রথম বুঝতে পারলো যে রোগা-সোগা বাঙালিরাও বোমা বানাতে শুরু করেছে। সেই প্রথম তাদের ভয় পাওয়া শুরু।ন রমপন্থী কংগ্রেসের মতো শুধু কথায় এরা চিঁড়ে ভেজাবে না।
যদিও গান্ধী বললেন এই কাজ ঠিক নয়।স্বরাজ কোনমতেই আসবে না এই পথে। তিলক জানালেন অকুন্ঠ সমর্থন। সিপাহী বিদ্রোহের পর এটাই সত্যিকারের কোন ঘটনা যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দিশা বদলাতে চলেছে। এই ছিল তাঁর মত।
শুধু ক্ষুদিরামকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, মহিলা দুজন মারা যাওয়ায় তিনি অনুতপ্ত কিনা যার জবাবে তিনি আফসোস করে বলেছিলেন কিংসফোর্ডের বেঁচে যাওয়াটা তার কাছে সবচেয়ে দুঃখের। অন্য মৃত্যু দুটি তো কোল্যাটারাল ড্যামেজ। যুদ্ধে হয়েই থাকে।
শুধু একটা জায়গাতেই খটকা রয়ে যায়। দুই বীর বিপ্লবী এত সহজে ধরা পড়লেন কি ভাবে? যাঁরা এক সপ্তাহ মুজঃফরপুরে পুলিশের নাকের ডগায় ইংরেজ ক্লাবের আশেপাশে ঘুরে বেড়ান নির্দ্বিধায়, কলকাতা স্পেশাল ব্রাঞ্চের রেড অ্যালার্ট থাকা সত্ত্বেও!!
মুজঃফরপুর পুলিশ এতটাই নিঃসন্দেহ ছিল যে তাদের কর্তা আর্মস্ট্রং কলকাতা পুলিশকে বোমা ফাটার ছয় ঘন্টা আগেও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে সেখানে কোন বিপ্লবীর অস্তিত্ব নেই।
তবে কি বিপ্লবীদের পালানোর কোন ব্লু প্রিন্ট তৈরী ছিল না? প্ল্যান এ, বি অথবা সি? যে ভাবে দুঃসাহসী বিনয় বসুকে পরবর্তী কালে ঢাকার মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজে লোম্যান সাহেবকে গুলি করে হত্যা করার পর, শহরে লুকিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করেন বিপ্লবীরা, কারণ তাঁদের জানা ছিল যে পুলিশ রেল স্টেশনে আর সড়কপথে নজর রাখবে।
তাছাড়া এটাও মনে রাখতে হবে বিহার ক্ষুদিরামদের চেনা জায়গা ছিল না। কেন না তার আগের বছরেই তাঁর পরিচিত মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে,ট্রেন লাইনে বোমা বসিয়ে সারা রাত হেঁটে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন ক্ষুদিরাম।
তাহলে সারা রাত প্রায় ২৫ মাইল হেঁটে ভোরবেলায় ওয়েইনি স্টেশনে দুই কনেস্টবলের কাছে কিভাবে ধরা পড়লেন বীর বিপ্লবী? যাঁর দু হাতে লাঠি চালানো, শারীরিক সক্ষমতা আর সহ্যশক্তির কথা আমরা বারবার পড়ি!
তবে কি ধরে নিতে হবে যে বিপ্লবীরা বুঝতে পেরেছিলেন অত্যাচারী কিংসফোর্ড এবারেও বেঁচে গেলেন। আর দুই নির্দোষ ইংরেজ মহিলার হত্যাকারী হয়ে রয়ে গেল তাঁদের নাম!
কোথাও কি এই হতাশা আর গ্লানিবোধ তাঁদের হতোদ্যম করে দিয়েছিল? সারারাত একা ট্রেন লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে কি সে কথাই ভাবছিলেন তিনি? নয়তো ৩০ রাউন্ড গুলি আর দুটো পিস্তল থাকা সত্ত্বেও লড়াই ছেড়েদিলেন কেন? মুজঃফরপুর থেকেই আলাদা হয়ে যাওয়া প্রফুল্ল তবু লড়েছিলেন। মোকামাঘাট স্টেশনে পুলিশের সাথে গুলিবিনিময়ের পর, ধরা দেবেন না বলে শেষে সুইসাইড করেন।
বিচারক তাঁকে মৃত্যুদন্ডের সাজা শোনানোর পরেও অবিচলিত ছিলেন ক্ষুদিরাম। জজসাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন আসামীর কিছু বলার আছে কি না।
ক্ষুদিরাম তাঁকে জবাব দিয়েছিলেন সময় থাকলে বিচারককেও বোমা বাঁধা শিখিয়ে দিতেন।
আসলে সময়টাই বোধহয় এইরকম ছিল। কত যে স্বার্থহীন আত্মত্যাগ ঘটেছে সেইসময়ে,তার ইয়ত্তা নেই।
পরিবার পরিজনের কথা না ভেবেই বিদ্রোহের এই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেইসময়কার তরুণ যুবকেরা। মায়েদের কোল খালি করে দিয়ে। তাঁরা তাঁদের ভবিষ্যৎকে জলাঞ্জলি দিয়ে গেছেন আমাদের বর্তমানকে সুরক্ষিত রাখার জন্য।
তবে এঁদের মধ্যে ক্ষুদিরাম থাকবেন একেবারে সামনের সারিতে। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে,
আকাশেতে ধ্রুবতারার মতো যাঁর দেখানো পথ ধরেই এগিয়ে গিয়েছিল ভারতের পরবর্তী সশস্ত্র বিপ্লব।
জয় হিন্দ।