এত ক্ষুদ্র আকারের ভাইরাস আটকাতে মানুষের হাতে গড়া মাস্ক কতটা কার্যকর এ প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক। যাঁরা দাবি করছেন যে কার্যকর, তাঁদের ব্যাখ্যাটা দেখা যাক। মাস্ক ব্যবহারের অন্যান্য দিকগুলি যেমন কোন মাস্ক কিভাবে ব্যবহার করতে হবে, কোনটা কার জন্য কতটা নিরাপদ ইত্যাদি বিষয়গুলি এই নিবন্ধের আলোচ্য নয়।
মাস্কের ব্যবহার
বায়ুবাহিত রোগের মোকাবিলায় মাস্কের ব্যবহার নতুন কিছু নয়। ১৯১০ সালে প্রথমবার জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানের রীতিনীতি অনুযায়ী মাঞ্চুরিয়ার প্লেগ মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মাস্কের ব্যবহার করা হয়। এর আগে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষে প্লেগ যে বায়ুবাহিত সেটা জানা গিয়েছিল এবং চতুর্দশ শতাব্দীতেই মাসকের ব্যবহার শুরু হয়েছিল।
মাস্কের উপযোগিতা প্রমাণ করার জন্য ইনফ্লুয়েঞ্জা, ইনফ্লুয়েঞ্জা লাইক ইলনেস, ও অন্যান্য করোনা ভাইরাসঘটিত রোগ নিয়েও প্রচুর গবেষণা হয়েছে। এমন নয় যে কোভিভ দেখা দেওয়ার পরেই এ নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে।
মাস্ক ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তি
মাস্ক ব্যবহার নিয়ে নানান বিভ্রান্তির তিনটি কারণ আছে:
(১) কোভিড মহামারীর শুরুতে রোগটি সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্যের অপ্রতুলতা। এই অসুবিধে এখন অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেছে।
(২) বিভিন্ন ধরণের মাস্ক নিয়ে গবেষণার অপ্রতুলতা। এ নিয়েও জোরকদমে গবেষণা চলছে।
(৩) আদর্শ কোভিভ আচরণ বিধির পরিবর্তন – বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ইত্যাদি নামজাদা আন্তর্জাতিক সংস্থা এই মহামারীর শুরুতে মাস্ক জোগানের অপ্রতুলতার বিষয়টি বিবেচনা করে কেবলমাত্র স্বাস্থ্যকর্মীদের মাস্ক ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছিল। পরে মাস্কের যোগান বাড়তে তারা তাদের নির্দেশিকার পরিবর্তন ঘটায় ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাশাপাশি সর্ব সাধারণের জন্য মাস্ক ব্যবহারকে আদর্শ বিধির আওতায় নিয়ে আসা হয়। আগের তুলনায় মাস্কের দাম উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে।
মাস্ক যে কাজ করে সেই দাবির সপক্ষে অজস্র (১) আরসিটি, (২) ল্যাব এনিম্যাল এক্সপেরিমেন্টাল মডেল স্টাডি, (৩) অবজারভেশনাল স্টাডি এবং (৪) ম্যাথামেটিক্যাল মডেল স্টাডি আছে। এই গবেষণাগুলি হেল্থ কেয়ার সেটিং এবং কমিউনিটি সেটিং – দুই পরিবেশেই করা হয়েছে।
মাস্ক কি ভাবে কাজ করে?
মাস্ক কিভাবে কাজ করে সেটা বুঝতে হলে করোনা ভাইরাস কিভাবে একজন থেকে আরেক জনের শরীরে ছড়ায় সেটা জানা দরকার।
ভাইরাসের সাইজ ঠিক কেমন সেটার একটা আন্দাজ এর জন্য- মানুষের চুলের গড় ডায়ামিটার মোটামুটি ৮০ মাইক্রোমিটার। কোভিভ রোগের ভাইরাস এর ডায়ামিটার মোটামুটি ০.১ মাইক্রোমিটার। কিন্তু এই ভাইরাস অন্য শ্বাসতন্ত্রের রোগের ভাইরাসের মতো একলা নিজে থেকে রুগীর শরীর থেকে বেরিয়ে অন্য মানুষের শরীরে ঢোকে না।
নিঃশ্বাসের সাথে জড়িত কাজকর্ম (যেমন দম ছাড়া, কথা বলা, গান গাওয়া, কাশি, বমি)-এর ফলে সংক্রমিত মানুষের শরীর থেকে এরোসল ড্রপলেট বাইরে বেরিয়ে আসে। শ্বাসতন্ত্রের তরল (থুতু ও লালা) থেকে এটমাইজেশন পদ্ধতিতে (ঠিক যে ভাবে ডিওডোরেন্ট স্প্রে হয়) এই ড্রপলেট বা সূক্ষ তরলকণা তৈরি হয়। এর মধ্যে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরিন, ল্যাক্টেট, গ্লাইকোপ্রোটিন জাতীয় উপাদান থাকে। এই ড্রপলেটের কাঁধে চেপে সংক্রমিত রোগীর শরীর থেকে করোনা ভাইরাস বেরিয়ে আসে।ভাইরাস বহনকারী এই ড্রপলেটের ডায়ামিটার মোটামুটি ভাবে ০.২ – ১০০ মাইক্রোমিটার অবধি হতে পারে। মোদ্দা কথা এই যে মাস্ক সরাসরি ভাইরাস আটকাচ্ছে না, ড্রপলেট আটকাচ্ছে।
সবচেয়ে ভালো জাতের মাস্ক যা N95 নামে পরিচিত সেটা ০.৩ মাইক্রোমিটার সাইজের ড্রপলেট আটকাতে পারে ৯৫%। এবার প্রশ্ন আসে যে তাহলে মাসকের ব্যবহার কিভাবে ভাইরাসের প্রবেশ আটকাতে পারে।
(১) সাইজ:- বেশির ভাগ ভাইরাস বাহিত ড্রপলেটের সাইজ ওই ০.৩ মাইক্রোমিটারের চেয়ে বড়।
(২) চলন:- ভাইরাস বাহিত এই ড্রপলেটগুলি তীরের মত বেরিয়ে এসে সরলরেখা ধরে চলা ফেরা করে না। এগুলির চলন আঁকাবাঁকা যা “ব্রাউনিয়ান মোশন” নামে পরিচিত। এর ফলে মাস্কের কাপড়ে এদের আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যে মাস্কের লেয়ার বা স্তর যত বেশি সেখানে এই সম্ভাবনা তত বেশি। কারণ মাস্কের ফুটোগুলো সরলরেখা বরাবর একটা টানেল বা সুড়ঙ্গের মতো থাকছে না।
(চিজ এফেক্ট এর ছবি)
(৩) শোষণ:- এন৯৫ জাতীয় মাস্কে আরো একটি অতিরিক্ত ব্যবস্থা থাকে। ইলেকট্র-স্ট্যাটিক পদ্ধতিতে মাস্কের কাপড়ে ওই জলকণাগুলি আটকে গিয়ে শুষে যায়।
ওপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে মাস্কের কার্যকারিতা নির্ভর করে যে বিষয়গুলির ওপর সেগুলি হল: অনুগঠন (যেমন ফাইবারের ব্যাস, থিকনেস, পোরোসিটি), সার্ফেস চার্জের ঘনত্ব, ইত্যাদি এবং একই সাথে ওই পরিবেশে বাতাসের গতিবেগ, এরসোল কণার ব্যাস, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ইত্যাদি।
সব ধরনের মাস্ক তাই সমান উপযোগী নয়। সার্জিক্যাল (মেডিক্যাল) মাস্ক সাধারণত পলিপ্রপিলিন তন্তু দিয়ে তৈরি হয়। এর তিনটি স্তর থাকে: ভেতরের দিকে মুখে লেগে থাকার জন্য নরম তন্তুর স্তর, মধ্যে মেল্ট-ব্লোন ফিল্টার ও একেবারে বাইরের দিকে জল-নিরোধী স্তর।
এন ৯৫ মাস্কে সাধারণত তিন থেকে চারটি স্তর থাকে। পলিপ্রপিলিনের ন্যানো ফাইবার ওই ইলেকট্র-স্ট্যাটিকের কাজ করে। জীবাণু আটকানোর ক্ষমতা এদের সব চেয়ে বেশি।
সংক্রমণ আটকানোর দিক থেকে সাধারণ কাপড়ের তৈরি মাস্কের ক্ষমতা কম অন্যান্য মাস্কের তুলনায়। কিন্তু এর সুবিধে হল যে সবচেয়ে আরামদায়ক, বেশি সময় পরে থাকা যায় ইত্যাদি। মনে রাখা দরকার যে নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। অর্থাভাবে এন৯৫ বা সার্জিক্যাল মাস্ক জোগাড় করা না গেলেও নিজেকে ও অন্যকে সুরক্ষিত রাখতে কাপড়ের মাস্ক নিয়ম করে ব্যবহার করা দরকার।
সবশেষে একটাই কথা বলা দরকার। মাস্ক ব্যবহার নিয়ে জোর দেওয়ার একটি মারাত্নক কুফল আছে। নিয়মিত মাস্ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে একটি ছদ্ম-নিরাপত্তাবোধের জন্ম হয় যা থেকে আদর্শ কোভিভ আচরণবিধির অন্যান্য অংশগুলি যেমন স্যানিটাইজার ব্যবহার, শারীরিক দূরত্ব বজায় ইত্যাদি অবহেলা করার প্রবণতা জন্মায়। মনে রাখতে হবে যে কেবলমাত্র মাস্ক ব্যবহারই শেষ কথা নয়।