সঞ্জিদা হাসপাতালের লাউঞ্জে বসে ছিলো। একজন চাওয়ালা ঝুলন্ত স্টোভে কেৎলি বসিয়ে ঘুরছে দেখে ডাক দিলো। পাশের চেয়ারে একজন মোবাইল কানে ঊচ্চৈস্বরে হিন্দিতে বকবক করে যাচ্ছে।
“লেবু চা লেবু চা পাঁচ টাকা” সঞ্জিদার জন্য চা ঢালতে ঢালতেও হাঁক পাড়ে “লেবু চা লেবু…”
একজন ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে আসে “চারশো সাত…. চারশো সাত…. কোথায় চারশো সাতের বাড়ির লোক… কেউ আছেন?”
সঞ্জিদা প্লাস্টিকের কাপটা নিয়েই উঠে দাঁড়ায় “এই যে এখানে আমি আছি চারশো সাতের বাড়ির লোক”
ছেলেটি – কমবয়সী ছেলেই তো – এগিয়ে আসে। সঞ্জিদাকে আপাঙ্গে দ্যাখে। “আপনি চারশো সাতের বাড়ির লোক?” সে মুখস্থ বলার মতো বলে যায় “ওনার তো লাংসের কান্ডিশন ভালো না এখন শরীরে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে। ওনাকে এবার আইসিইউতে দিতে হবে। আপনি এদিকে আসুন প্রয়োজনে ভেন্টিলেটরে দিতে হবে – একটা বন্ডে সই করে দিন।”
সঞ্জিদা সই করে ওয়ার্ডের বাইরে এসে ওর এক ডাক্তার ছাত্রীকে ফোন করে। “ওকে বোধহয় আইসিইউতে দিতে হচ্ছে….. হ্যাঁ রে অনেক দিনের হাঁপানি তো …. হ্যাঁ রে আমি মেন্টালি রেডি…. আচ্ছা রাতে একবার জানাস….”
বিষাদগ্রস্ত সঞ্জিদার চোখে কি জল এসেছিলো? না বোধহয়। অনেক দিনের মানসিক প্রস্তুতি ছিলো তাছাড়া বয়সও হয়েছে – তবু বহু বছরের সঙ্গী। আইসিইউ-র বাইরে সঞ্জিদা অপেক্ষা করে।
এবার অন্য একজন আসে। অনেক ডাক্তারি কথা বলে। আসল কথাটি হলো অবস্থা খুব খারাপ।
সঞ্জিদা আনমনে ফিরে আসে। কাজের মেয়েটা রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে। হয়তো এরপর থেকে একা একাই খেতে হবে। ইচ্ছে হয় না তবু রুটি তরকারিটা খেয়ে নিয়ে নাসিমের পড়ার ঘরে গিয়ে বসে। এক কাপ চা হলে ভালো হতো। নাসিম চলে গেলে পৃথিবীটা শূন্য হয়ে যাবে। যাবে কি? নাকি অভ্যেস হয়ে যাবে।
ঘুম আসছে না। এক কাপ চা বানিয়ে আবার পড়ার ঘরেই এসে বসে। রাত এগারোটা নাগাদ ওর ডাক্তার ছাত্রী ফোন করবে। ও নাসিমের লেখার খাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে।
লেখা পাগল মানুষ ছিলো। সময়ে অসময়ে কেবল লেখা আর বই পড়া। যদিও বাংলার টিচার ছিলো তবু সঞ্জিদার সাহিত্যে খুব উৎসাহ ছিলো না। নাসিম লিখতো আর ও সেলাই ফোঁড়াই করতো। লেখার পরে নাসিম ওকে পড়ে শোনাতো। ও খুব সুন্দর পাঠ করতো। সারা জীবন একটা কেরাণীর চাকরি না করে বরং ইস্কুলের বাংলার টিচার হলে বোধহয় ও বেশী সুখী থাকতো। ওকে এ কথা বললে শুধু হাসতো –”হয়তো শুধু সাহিত্য ঘাঁটলে আর সাহিত্য প্রীতিটাই থাকতো না।”
বসে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়ার পরে মঞ্জরীর ফোন এলো। নতুন কী বা আর বলবে। লাংস কাজ করছে না। সেন্স নেই। সবই শেষ তবুও এই অসম লড়াইটা ডাক্তাররা লড়ে যাচ্ছে। মনে মনে তো সঞ্জিদা জেনেই গেছে। ও আর নেই। ও আর ফিরবে না। মন তৈরি করছে। সে লোকে যাই বলুক। ও খুবই প্র্যাক্টিক্যাল। বরাবরই।
বড্ড অস্থির লাগে। মন চঞ্চল। একটা কিছু করার থাকলে … ও নাসিমের পুরোনো কবিতার খাতা নিয়ে বসে।একবার কবিতা একবার গল্প। রাত পেরিয়ে যেতে থাকে। কখন যেন কোন গাছে আঁধারের মধ্যেই একটা কাক স্বপ্নে ডেকে ওঠে। দূরে দূরে একটা দুটো কুকুর কোনও রাতচরাকে দেখে ঘেউ ঘেউ ওঠে। আবার সব চুপচাপ। গল্পের পর কবিতার পরে গল্প এভাবেই চলে। ওর চোখ লাল হয়ে যায়। সঞ্জিদা উঠে চোখে মুখে জল দ্যায়।
কাক ডাকে – আকাশের রং হালকা হয় – ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া বয়। সঞ্জিদার চা বানাতেও ইচ্ছে হয় না। এক চিলতে বারান্দায় নিশ্চুপ বসে থাকে। রাস্তায় চায়ের দোকানে ঝাঁপ খোলে। ধূপ জ্বেলে স্টোভ জ্বালায়। একটা দুটো লোক চায়ের দোকানে এসে বসে। পৃথিবীর কতো কিছু জানা হয় নি। এই ভোরে কারা চা খেতে আসে? পাঁউরুটিওয়ালা তিন চাকার ভ্যান নিয়ে এসে দাঁড়ায়। একটা কুকুর সামনের পা টান টান করে আড়মোড়া ভাঙে। শহরতলী জেগে ওঠে। মর্নিং ওয়াকাররা দল বেঁধে কলবল করতে করতে চলে যায়। চায়ের দোকানে ভীড় বাড়ে – রাস্তায় লোক। মাধবী এসে বেল বাজায় আরেকটা দিন শুরু হয়। “মাসি তুমি হাসপাতাল যাবে নি?”
“নারে, এখন শুধু বিকেলে দেখা করতে দেবে।”
“ক্যানো?”
“এখন তো জ্ঞান নেই। খুব খারাপ অবস্থা – আইসিউতে। হয়তো এবার আর ফিরবে না রে।”
মাধবী কথা খুঁজে পায় না। “তুমি গিয়ে বসো নে আমি আজ ঝা পারি করে রাখব।” আবার একটু পরে আসে
“মাসি আমায় একশোটা টাকা দে’ রেখো আমি কালকেরে কিছু বাজার নে আসবো।”
সঞ্জিদা ব্যাগ থেকে একশোটা টাকা বার করে দেয়। মাধবী কাজ শেষ করে চলে যায়। সঞ্জিদা আনমনে পোশাক পরে। আনমনে যেন খেয়াল করে নি এমনি করে নাসিমের একটা কবিতার খাতা ন্যায় ব্যাগে ভরে। অল্প ভাত নাড়াচাড়া করে’ উঠে পড়ে। চটি পরে – তালা দ্যায়। তারপর একটা টোটো রিক্সা চেপে শহরের দিকে রওয়ানা দেয়।
কন্ডাক্টর ছেলেটা ভালো। কত কিছুই তো ভালো। শুধু আগে চোখ মেলে দেখা হয়নি। “মাসিমা চারমাথা – অপিস বাড়ি – ট্রাম গুমটি এগিয়ে আসুন এইইই বেঁধে আস্তে লেডিস” ও বাসের দেওয়ালে থাবড়া দ্যায় …. বাসটা ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় করতে করতে চলে যায়। সঞ্জিদা শাড়ির কুঁচি ধরে দুপাশ দেখে রাস্তা পার হয়।
রিসেপশনে সঞ্জিদার লেখা কাগজটা খুব মন দিয়ে দ্যাখে য্যানো পরীক্ষার খাতা দেখছে। ও দাঁড়িয়ে থাকে। অবশেষে ডাক আসে। “সঞ্জিদা আলি ভেতরে যান সায়েব ডেকেছেন।”
সঞ্জিদা ভেতরে যায়। একটা মাঝ বয়সী ভদ্রলোক বসে আছেন। “বলুন ম্যাডাম …” কথাটা শেষ করেন না ।
“আমার স্বামী নাসিম আলী … আইসিইউতে ভর্তি আছে” … সঞ্জিদা কবিতার খাতাটা শক্ত করে ধরে।
“বলুন – আমি কী করতে পারি?”
“উনি হয়তো আর বাঁচবেন না। ভেন্টিলেটরে আছেন…”
ভদ্রলোক অপেক্ষা করে থাকেন।
“নাসিম সারা জীবন শুধু লিখে গ্যাছে – কবিতা গল্প- প্রবন্ধ – সবই খুব ভালো ….” ও মাথা নিচু করে “যদি ওর মৃত্যুর পরে ওর বডিটা একবার … অন্ততঃ একটা ঘন্টা …. এই প্রতীক্ষায় রাখা যায় ….” সঞ্জিদা উৎসুক চেয়ে থাকে
“আসলে সারা জীবনে তো কোনও নাম খ্যাতি পায়নি অথচ ….”
এই প্রস্তাব ভদ্রলোককে হতচকিত করে। “ম্যাডাম, দেখুন আসলে এই শেষ প্রতীক্ষায় তো কেবলমাত্র … বিখ্যাত মানুষদের …. মানে যাঁদের নাম …. ফেমাস মানুষদের রাখা হয় …. এটা তো সরকারি জায়গা মৃত মনীষীদের সম্মান জানানোর …. স্যরি ম্যাডাম, এখানে আমি কিছু করতে নাচার….”
সঞ্জিদা খাতাটা খোলে “এই কবিতাটা শুনুন … কটা লাইন – জীবনানন্দ ভ্যান গখ কেউ তো বেঁচে থাকতে কিচ্ছু পায় নি … কিন্তু ভালো লেখকের তো একটা প্রাপ্য থাকে … একটা শেষ সম্মান ….?”
ও পড়তে থাকে
“শ্বাপদের মতো রাত্রি নামে
আকাশ
একফালি চাঁদ ঝুলে থাকে
লক্ষ চকচকে চোখের সুমুখে
ফেরিঘাটে ছাতামাথে বসে থাকা….”
ভদ্রলোক হাঁক পাড়েন – “এই …..এনাকে বাইরে নিয়ে যাও …. ম্যাডাম আমি ম্যানেজমেন্টের ছাত্র … এটা আমার বিষয় নয় – আপনি সরকারি অফিসে যান ….”
সঞ্জিদাকে একজন এসে বলে “দিদি, আপনি চলে আসুন। আমাদের সময় নষ্ট করবেন না।”
সঞ্জিদা নিজেই উঠে যায়। আস্তে আস্তে বেরিয়ে এসে বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে আরেক জায়গা। এবার অন্তিম যাত্রার কাউন্টার। একই পদ্ধতি। অপেক্ষা তার পর কথা। একই উত্তর।
সঞ্জিদা প্রার্থনা করে “নাসিম প্রিয় আমার, আর কিছু দিন কষ্ট করে বেঁচে থাকো। আমি কোথায় যেতে হয় যাবো কিন্তু তোমার এইটুকু পাওনা আমি আদায় করবো।” ভিজিটিং আওয়ার শুরু হবে। সঞ্জিদা হাসপাতালের দিকে ফিরে যায়।
উফঃ দারুন লেখা। ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন।