জ্বর, প্রবল গায়ে ব্যথা। কুঁচকি আর বগলের কাছে ফুলে যাচ্ছে। তারপর হাত-পায়ের আঙুল, নাকের ডগা কালো হয়ে পচে যাচ্ছে। কারো ক্ষেত্রে প্রবল শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি কিংবা শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ!! শরীরের বিভিন্ন অংশ কালো হয়ে যায় বলে নাম দেওয়া হ’ল ‘ব্ল্যাক ডেথ’। ‘কালো মড়ক’। এ ‘ঈশ্বরের প্রতি অবাধ্যতার অভিশাপ’ থেকে কারও মুক্তি নেই। পৃথিবী ধ্বংসপ্রায়..
উৎস সন্ধানে পিছিয়ে যেতে হবে আরও কিছু বছর। আনুমানিক ১৩৩০ সাল। চীনদেশে কিছু মানুষ অদ্ভুত এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কোত্থেকে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আবির্ভূত হয়েছেন মহাকাল!! এদিকে তখন মধ্যযুগীয় শহরগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলেফেঁপে উঠেছে। সিল্ক রুট বরাবর জুড়ে গেছে ইউরোপ-আফ্রিকা-এশিয়া। আন্তর্জাতিক বানিজ্যের হাত ধরেই সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লো এই রহস্যময় মৃত্যুদূত। ১৩৪৭ সালে ক্রিমিয়া, সেখান থেকে ইতালীয় বণিকদের হাত ধরে ক্রমশ ১৩৪৮ সালে ইংল্যান্ড, ১৩৪৯ সালে ওয়েলস, আয়ারল্যান্ড, ১৩৫০-এ স্কটল্যান্ড.. তারপর ধীরে ধীরে সমগ্র ইউরোপ।
এ দেবতার রোষের হাত থেকে কারো মুক্তি নেই। দেবতাকে তুষ্ট করতে বলি দেওয়া হচ্ছে সংখ্যালঘুদের- কোথাও ইহুদি, কোথাও আরবীয়রা। আবার কখনো কুষ্ঠ বা অন্যান্য চর্মরোগীরা অভিশাপের দায়ভার নিয়ে বাধ্য হচ্ছেন।
তবু অভিশাপ আর থামছে কই? সমগ্র ইউরোপের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা এই করাল মৃত্যুর গ্রাসে। ৭৫-২০০ মিলিয়ন হতভাগ্য মানুষ ধুঁকতে ধুঁকতে মারা গেলেন।
এদিকে চিকিৎসা পদ্ধতি বলতে শিরা কেটে রক্ত বের করে ফেলে দেওয়া, পেঁয়াজ বা অন্যান্য গাছগাছড়া ক্ষতস্থানে ঘষে দেওয়া, সাপ কুচিয়ে খাওয়া। ভিনিগার, আর্সেনিক, পারদ সব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হ’ল। তবু ফল মিললো না। স্বজন হারানোর কান্নায় সমগ্র ইউরোপের আকাশ মথিত। শকুনের ডানার তলায় লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে সূর্য!!
ডাক্তারদের পোষাকগুলোও বড় অদ্ভুত!! পুরো শরীর ভারী পোষাকে ঢাকা, পায়ে বুট, মাথায় চামড়ার টুপি, নাকের কাছে পাখির ঠোঁটের মতো ধাতব নাক। তার মধ্যে সুগন্ধী গাছগাছড়া আর মশলা ভরা। ‘খারাপ বায়ু’ই সব রোগের মূল কারণ, তাই দুর্গন্ধযুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়া যাবে না কোনোমতেই..
তবু সমাধান মিললো না। অভিশাপ চলতেই থাকলো বছরের পর বছর..
বিপদের মেঘ কাটিয়ে আলোর হদিশ দিলেন ব্যাক্টিরিওলজিস্ট আলেকজান্দ্রা ইয়ারনিস। ১৮৯৪ সালে হং-কং যখন এই কালো মৃত্যুতে হাঁসফাঁস করছে তখন বিজ্ঞানী ইয়ারনিস আবিষ্কার করলেন এক ধরনের রক্তচোষা পোকা এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। ১৮৯৮ সালে জিয়ান পল সাইমন্ড খুঁজে পেলেন এই পোকাকে বহন করে নিয়ে যায় ইঁদুর। পোকার পেটে বেড়ে ওঠে ‘কালো মৃত্যু’র জীবাণু। পেট ভরে গেলে রক্তচোষা পোকা ক্ষতস্থানে জীবাণু উগরে দেয়। তারপর আক্রান্ত মানুষের দেহ থেকে আরও, আরও মানুষ..
১৮৯৬ সাল নাগাদই অ্যান্টি-সেরাম দিয়ে চিকিৎসা শুরু হয়। আক্রান্ত মেরুদন্ডী প্রাণীর দেহরস চিকিৎসার পথ বেশ খানিকটা খুলে দেয়। যদিও মানুষ তখনও আরও উৎকৃষ্ট উপশমের পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে। অবশেষে, ১৯৩০ সালে সালফোনামইড গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক, ১৯৪৭ সালে স্ট্রেপটোমাইসিন, পরে ডক্সিসাইক্লিন, ফ্লুরোকুইনোলোন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক ‘কালো মৃত্যু’র কালো-দিনের প্রায় অবসান ঘটায়। যদিও তার পরেও ভারতে, ভিয়েতনামে, আফ্রিকায় বেশ কিছু মৃত্যু হয়েছে তবু মৃত্যুমিছিল আর কখনোই সে মধ্যযুগীয় অভিশাপের ধারে-কাছে আসে নি। যদিও জনসংখ্যার ঘাটতি পূরণ করতে ইউরোপের লেগে গেল পরবর্তী দু’শ বছর!!
হ্যাঁ, প্লেগ। মানব ইতিহাসের এ যাবৎ ঘটে যাওয়া ভয়ংকরতম অতিমারী।
পুরোনো ইতিহাসের সাথে কিছু মিল পাচ্ছেন?
মিল থাকুক বা না-থাকুক, আপাতত করোনা-সন্ত্রস্ত পৃথিবীর খুব দ্রুত কিছু ‘আলেকজান্দ্রা ইয়ারনিস’ আর ‘জিয়ান পল সাইমন্ড’দের দরকার।
শেষমেষ নতুন দিনের গান মানুষই লেখে। ‘ব্ল্যাক ডেথ’ পড়ে থাকে ইতিহাসের অন্ধকারে…..