নন্দিনী আজ আর ফ্ল্যাটে ফিরতে পারবে না । গত তিনদিন ধরে আবাসনের লোকজন হল্লাবাজি করছে। নন্দিনী শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের স্টাফ নার্স। এখন করোনা কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের দায়িত্বে। অতএব তাকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। নন্দিনী অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছে প্রতিবেশীদের। এভাবে সংক্রমণ ছড়ায় না। বরং নন্দিনীর থেকে তারা জেনে নিক কীভাবে প্রতিরোধ করতে হবে কোভিড আক্রমণকে। কিন্তু এইসব অন্ধরা আলো দেখতে অনিচ্ছুক। মাস্ক ছাড়া দিব্যি যাতায়াত, কেনাবেচা করছে। সবজিওয়ালা, দুধওয়ালা, মাছওয়ালা যে কেউ করোনার ক্যারিয়ার হতে পারে। এমনকী লক্ষণ নাও থাকতে পারে। মুখ দেখে তো আর রোগ বোঝা যায় না!
বহুবার অনুরোধ করেও আবাসনের কর্মকর্তাদের মন গলাতে পারেনি নন্দিনী। ভন্ডামিতে ভরা সমাজ। প্রয়োজনে এরাই পায়ে পড়ে। নিজের বুড়ো বাবা মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে চলে যায় ভুল ঠিকানা দিয়ে। যাতে ফেরত না নিতে হয়। বৃদ্ধাশ্রমের খরচটাও বাঁচল!
কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করে একটা বিকল্প থাকার ব্যবস্থা আজ করতেই হবে। বিগ শপারে কিছু জামাকাপড়, অ্যাপ্রণ, খাবার দাবার গুছিয়ে নিল নন্দিনী। মনের খাবার বলতে বই। কবিতা পড়তে ভালবাসে নন্দিনী। করোনা ডিউটিতে কবিতা পড়া মাথায় উঠেছে। প্রাণভয় তো আছেই। মা মারা গেছে ছোটবেলায়। সে এক মেয়ে। বাবা একা গ্রামের বাড়িতে। বাবার জন্য অন্ততপক্ষে তাকে সুস্থ থাকতে হবে।
কবি জয়দেব বসু নন্দিনীর খুব প্রিয়। আজ (১২ই মে) কবির জন্মদিন। আরেকজনেরও। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। বাবা মেয়ের নাম ‘নন্দিনী’ রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ পড়ে। হতাশা, অবসাদের মধ্যে নন্দিনী এক মহাজাগতিক আলো। বাঁচার আশা।
জয়দেব বসুর দু’চার লাইন ভাবতে ভাবতে টোটোতে উঠে বসল নন্দিনী। টোটোচালক ছেলেটা বি এস সি পাস। সরকারি চাকরি পায়নি তাই টোটো চালায়। একমাত্র এর চোখেই মনুষ্যত্বের ভাষা দেখেছে নন্দিনী। মোবাইল নম্বরটা দিয়ে বলেছিল, “লাগলে ডাকবেন। যেকোনও দরকারে।”
হাসপাতালে যাচ্ছে নন্দিনী। তেরো নম্বর বেডের বুড়োটা এক্সপায়ার করেছে বোধহয়। একফোঁটা রক্ত নেই শরীরে। কাল জিজ্ঞেস করেছিল কাঁপা কাঁপা গলায়, “মা, আমি বাঁচব?”
নন্দিনী স্মার্ট গলায় বেবাক মিথ্যে বলেছিল, “আলবাত।”
অথচ রক্ত নেই ব্লাড ব্যাঙ্কে। অ্যানিমিয়া গোটা পাড়ায়। শহরে। দেশে। কোথাও সেবিকাদের একটুকুও সম্মান নেই। উল্টে অপমান, কটুক্তি। ফ্লোরেন্সকেও সহ্য করতে হয়েছিল নিশ্চয়ই।
“পেরিয়ে গেছি মেঝেনদের দেশ,
পেরিয়ে গেছি কুষ্ঠেখসা গ্রাম
জানো কি তুমি অনেকে এখানেও
ফিসফিসিয়ে বলে তোমার নাম। ”
কবি জয়দেব বসুর এই পংক্তিটা ভারি প্রিয়।
হাসপাতালে পৌঁছে ভাড়া মেটানোর সময় টোটোচালক তরুণ বলে উঠল, “যদি কোথাও ব্যবস্থা না হয়, বলবেন। শক্তিনগর লেডিজ হোস্টেলে মামাতো দিদি থাকে। টিচার। বন্দোবস্ত হয়ে যাবে।”
সুপারের অফিসে ঢোকার আগেই কান্নার রোল কানে গেল নন্দিনীর। তেরো নম্বর বেডের পেশেন্ট পার্টি। গ্রীষ্মকালে এই এক কষ্ট। রক্ত পাওয়া যায় না। এবারে মহামারীর জন্য রক্তের আরও আকাল।
ফ্লোরেন্সের কথা মনে পড়ল হঠাৎ। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে সেনাদের কী সেবাটাই না করেছিলেন। এলিজাবেথ কেনি! অস্ট্রেলিয়ায় পোলিওর বিকলাঙ্গ শিশুদের পাগুলো যিনি জলের মধ্যে নাড়িয়ে নাড়িয়ে সবল করতেন। উনিশশো পঞ্চাশ সালে ইংল্যান্ডের একটা দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল নন্দিনীর। শয়ে শয়ে নার্স একরত্তি নবজাতকদের কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসছে ওয়ার্ড থেকে সূর্যের নিচে। চেঁচিয়ে বলছেন সিস্টার জেন ওয়ার্ড, “রোদে নিয়ে যাও গো, রোদে নিয়ে যাও। বাচ্চাগুলো বেঁচে যাবে।”
“ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দিয়েছেন! রক্ত নেই-” শব্দগুলো চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল নন্দিনীর কানে। মনে হল তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দিচ্ছে আবাসনের লোকজন।
“আমি ব্লাড দিতে চাই তেরো নম্বরের জন্য । বি পজিটিভ। নাম লিখুন নন্দিনী জোয়ারদার।” সুপারের ঘরে হুড়মুড় করে ঢুকল সে।
রক্ত দেওয়ার সময় আশেপাশে কলিগরা, ডাক্তাররা হাততালি দিচ্ছিল। টোটোচালক তরুণ কাছেই দাঁড়িয়ে। চলে যায়নি। অবাক হল না নন্দিনী। করোনা বড় শিক্ষক । রোজই কিছু না কিছু নতুন শেখাচ্ছে।
এখন যদি একটা খাতা আর পেন থাকত, অকালমৃত কবি জয়দেবের জন্য একটা কবিতা লিখত নন্দিনী।
তোমার মতো মানুষ বড়ই বিরল,
শব্দ নিয়ে জাগলারিই কি কবিত্ব?
সময় যখন বদলায় রঙ বদল ,
দুঃসময়ে চিনছি মানব চরিত্র।
অসাধারণ একটি লেখা…বর্তমান পরিস্থিতি নির্ভর এই লেখায় যেভাবে সাহিত্য রস ঢেলে দিয়েছেন দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত, তাতে তাঁকে কুর্নিশ না করে পারা যায় না ৷
Chorom bastob lekha. Onek kichhu jante parchhi