সকাল থেকে মেজাজটা ওপরের ‘সা’তে বাজছিল ডা. ঘোষের। গত মাসে হার্টের রোগের বাচ্চাটার বাড়ির লোকেদের পই পই করে সব বুঝিয়েছিলেন। হৃৎপিণ্ড থেকে ফুসফুসের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা বন্ধ। হার্টের নিচের ঘরের দেওয়ালে ফুটোও আছে। রক্তে অক্সিজেন ভালো ভাবে পৌঁছোচ্ছে না। হার্টের ওষুধ লিখে দিয়েছিলেন। অপারেশনের ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিতে বলেছিলেন। আজ একমাস বাদে ভ্যাক্সিন দেওয়ার সময় জানতে পারলেন এই একমাসে অপারেশনের ডাক্তার দেখানো তো দূরের কথা সব ওষুধপত্র বন্ধ করে বাচ্চাকে কাচের শিশি’র ফোঁটা খাওয়ানো চলছে! অথচ বাড়ির লোকেরা সকলেই উচ্চশিক্ষিত!
…….
ফুটপাথ দিয়ে দ্রুত হেঁটে আসছিলেন ডাক্তারবাবু। রাস্তায় আসতে আসতেও বাচ্চাটার কথাই ভাবছিলেন। বহুদিন হ’ল এসব বিকল্প পদ্ধতিতে বিশ্বাসীদের ভুল ভাঙানোর জন্য আর আগের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন না ডা. ঘোষ। তিনি ভালো করেই জানেন এঁদের ভুল ভাঙানো আর অন্ধ ধর্মবিশ্বাসীর ধর্মীয় কুসংস্কার তাড়ানো মোটামুটি একই ধাঁচের ব্যাপার। সময় আর যুক্তি দুইয়ের ভাগ্যেই শেষমেশ উলুবন!
রাজাবাজারের খালটার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাচ্চা মেয়েটার কথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো। বাবার হাতের আঙুল ঝাঁকিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো– বাবা, বাবা… দ্যাখো সমুদ্র!
– দূর পাগলি! এটা সমুদ্র নাকি?
– তবে কী? নদী?
– আমার মেয়েটা এখনো বোকা-ই থেকে গেলো।
বাবা মেয়ের গালটা টিপে দিয়ে কোলে তুলে নিয়ে বললেন– এটা সমুদ্রও নয়, নদীও নয়। সমুদ্র-নদীতে অনেএএক জল থাকে। এই এত্তোওও জল। এটাতো খাল। ওই ধর, নদীর ছোটো ভাই।
– ও
মেয়েটার উৎসাহে ভাঁটা পড়লো। ডাক্তারবাবু মুচকি হেসে আবার চলতে শুরু করলেন। খিঁচিয়ে থাকা মেজাজটা হাল্কা হয়েছে। সামনেই হাসপাতালের গেটটা দেখা যাচ্ছে…
…….
আজ বেশি পেশেন্ট নেই। তাড়াতাড়িই রাউন্ড হয়ে গেল। এবার পার্টি মিটে যেতে হবে। যদিও ‘পার্টি মিট’ কথাটা ডা. ঘোষের একেবারেই পছন্দ নয়। জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, পেশেন্টের বাড়ির লোকের সাথে গল্পগাছা করতে যাচ্ছি। আজ তিনজন ছুটি হয়ে বাড়ি যাবে। দু’শ নব্বইয়ের বাচ্চাটা এভাবে সুস্থ হয়ে যাবে ভাবতে পারেন নি। যখন এসেছিল- হাতে পায়ে সাড় ছিল না, খিঁচুনির পর খিঁচুনি হয়ে নেতিয়ে পড়েছিল। চারদিন ভেন্টিলেশনে থেকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসে। আজ ষোলো দিন বাদে ছুটি হচ্ছে। বেশ পুটপুট করে তাকাচ্ছে। চুকচুক করে দুধও টেনে খাচ্ছে।
দু’শ ছিয়ানব্বইয়ের পেশেন্টের বাড়ির লোককে সবার শেষে ডেকেছেন ডাক্তারবাবু। বাচ্চাটা খারাপ আছে।
– শুনুন, বাচ্চার অবস্থা খুবই খারাপ। মাথায় বড়সড় ক্ষতি হয়েছে। এখনো খিঁচুনি থামছে না। বুকের অবস্থাও ভালো না।
– ও। আচ্ছা, দুধ-টুধ টানতে পারছে?
– না। সে প্রশ্নই নেই। পুরোপুরি স্যালাইনে আছে। কবে টেনে খেতে পারবে বা আদৌ পারবে কিনা বলা মুশকিল। বাচ্চাকে বাঁচানো যাবে কিনা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
– আপনারা একটু চেষ্টা করে দেখুন।
– সে আপনি না বললেও আমাদের দিক থেকে যতটা করা সম্ভব করবো কিন্তু সে চেষ্টা কতটা সফল হবে…
– না, মানে ডাক্তারবাবু… এমনিতে ভয়ের কিছু নেই তো?
মাঝে মাঝে এরকম প্রশ্ন শুনলে ডা. ঘোষ নিজের বোঝানো নিয়ে সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। আসলে কাছের মানুষদের খারাপটা কেউ শুনতে চায় না। শুনলেও বুঝতে চায় না। বড্ড সাবধানে সত্যি কথাটা বলতে হয়। ডাক্তারের কাজটাই তাই- মিষ্টি কথা নয়, রূঢ় বাস্তবটা জানিয়ে দিতে হয়। নির্বিকার। ভাবলেশহীন মুখে। বাচ্চার এরকম অবস্থায় বাড়ির লোকের মনের ভেতর কী চলে সেটা ডাক্তারবাবু খুব ভালো করেই জানেন। তবু মুখে তার প্রকাশ রাখলে চলে না। আরও মিনিট দশেক বোঝানোর পর বাড়ির লোক বাচ্চার আশঙ্কাজনক অবস্থার আঁচ পেয়েছে বলে মনে হ’ল।
নিচের জন্ডিসের বাচ্চাটার বাড়ির লোক আবার কী জানি বলবে বলে এসেছে।
– ডাক্তারবাবু বাচ্চাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে কিছু অসুবিধে হবে না তো?
– দেখুন, এখন যেমন আছে তাতে অসুবিধে হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিছু সমস্যা হ’লে ইমার্জেন্সি তো খোলা রইলই…
সব কাজ মিটে যাওয়ার পর স্যারকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম– স্যার, জন্ডিসের বাচ্চাটা তো একদম ভালো আছে। তবু ওকে একটু টেনে রেখে বললেন কেন?
– বলি কি আর সাধে? সবই অভিজ্ঞতা। তোর যেদিন আমার মতো চুল পাকবে তুইও শিখে যাবি। অনেক গল্প আছে। একটা শোনাই- এরকমই এক বাচ্চা ছুটি হয়ে বাড়ি গেছিল। বাড়ি যাওয়ার পাঁচদিন বাদে শ্বাসনালীতে দুধ ঢুকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাচ্চাটা মারা যায়। তারপর পাড়াশুদ্ধ লোক এসে… ওই যা হয়…
– শ্বাসনালীতে দুধ আটকে যাওয়া- এ তো যে কোনও সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চারাও যে কোনও সময় হ’তে পারে। তার জন্য…
– কে বোঝাবে ভাই? আমার এক স্যার বলতেন জানিস… বাচ্চা আপাতত ঠিক আছে। হাসপাতালে আর রাখার খুব একটা কারণ দেখছি না। তবে বাড়ি গিয়ে মাথায় তাল পড়বে কিনা আমি জানিনা।
– তাই তো…
– সময়টাই এমন রে… রোগী আর চিকিৎসকের পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গাটা এমন টাল খেয়েছে যে সন্দেহ আর ভয়-ই জিতে যাচ্ছে বারবার। তাতে কার কী লাভ হচ্ছে জানি না। আমার মনে হয় রোগীর ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ডাক্তার ঝুঁকি নিতে ভয় পেলে সঠিকভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব? অথচ, আইন-আদালতের গেরো আর পাড়ার গুন্ডাদের চোখ রাঙানির যুগে ঠিক সেটাই হচ্ছে। যাক গে, শোন… আলমারির ওপরের থাকে পাঁচটা জলভরা আছে। তোরা ভাগ করে নিস। আমি বেরোলাম। অনেক বেলা হ’ল…