তখন সেকেন্ড ইয়ার এম বি বি এস-এর। রাত্রিবেলা ইমার্জেন্সিতে গিয়ে নতুন ইঞ্জেকশন দেওয়া শিখেছি। শিখেছি কিভাবে কাঁচের এম্পুল ভাঙ্গতে হয়, ঠিক কোন জায়গায় আঘাত করলে এম্পুলের মাথাটা ভাঙ্গে কিন্তু ওষুধটা পরে যায় না। ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বেড়ে উঠেছে। তখন রাত দুটো, এক এস্থমা রোগীকে ইঞ্জেকশন দিতে গিয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাসে এম্পুলের মাথায় বাড়ি দিয়ে মাথাটা ভাঙ্গলাম বটে কিন্তু জোরে চেপে ধরার জন্য পুরো এম্পুল ভেঙ্গে ওষুধ আমার হাতে পরে গেল, সাথে দু’একটা কাঁচের কুঁচি আঙুলে ঢুকে রক্তারক্তি। আঙুলের ব্যথার চেয়ে অনেক বেশি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম এটা ভেবে যে ওষুধটা রোগীর বাড়ির লোক বাইরে থেকে কিনে এনেছিলেন। পকেট হাতরে টাকা বের করে দিতে গেলাম, রোগীর ছেলে বললেন “না না ডাক্তারবাবু, (আমি যে তখনো ডাক্তার হইনি তা ঊনিশ বছরের আমি-কে দেখে যে কেউ বুঝতে পারে) এরকম তো হতেই পারে। আপনি বিব্রত হবেন না আমি এক্ষুনি ওষুধটা নিয়ে আসছি।” রাত দুটোয় উনি বাইরে ছুটলেন ওষুধ আনতে।
তখন ইণ্টার্ণ, সন্ধ্যা বেলা বাস থেকে পরে গিয়ে হাত কেটে গিয়েছে এক মধ্যবয়সী অফিস ফেরতা ভদ্রলোকের। আমি সুঁচ সুতো নিয়ে সেলাই করতে তৈরি হয়েছি ইমার্জেন্সিতে। সিনিয়র সার্জারির পিজিটি দাদা বলল “কি রে পারবি? না থাক, সর আমি করছি”
হাতে চার ইঞ্চি কাটা নিয়ে ভদ্রলোক বললেন “পারবেন পারবেন, কেন পারবেন না, ওনাকে চেষ্টা করতে দিন না।” মনপ্রাণ দিয়ে সেলাই করলাম ওনার হাত।
লক্ষ্ণৌ-এর এক গ্রীষ্মের দুপুর। রেডিয়েশন দেবার সময় রোগীর মাথা স্থির রাখার জন্য যে প্লাস্টিকের মাস্ক বানানো হয় তা বানাচ্ছি, একজন প্রৌঢ়া রোগীনির মুখে। দুবার বানানোর চেষ্টা করলাম, হলো না, তখন এম ডি ফার্স্ট ইয়ার। বার বার গরম মাস্ক রোগীর মুখে লাগানো হচ্ছে ওনার কষ্ট হচ্ছে। বললাম “সরি আম্মা”। রোগী বললেন ” কোই নেহি বেটা, ইসবার জরুর সহি সে বনেগা “। তৃতীয়বার সঠিক হোল।
এক বছর পনেরোর বালিকা, ব্রেন টিউমার। খুব জোরে ডাকলে চোখ খুলছে কোন মতে। নিউরো সার্জন বলেছেন কিছু করা যাবে না। আমি তখন এম ডি থার্ড ইয়ার। আমার প্রফেসর রাঊন্ড দিয়ে বললেন কিছু করার নেই বাড়ি নিয়ে যাও।
ওয়ার্ড থেকে বেড়িয়ে আসার সময় প্রফেসর চলে যাবার পর মেয়েটির বাবা এসে বললেন “আপ হি কুছ করলো ডক্টর সাব, কুছ ইলাজ তো হো, এয়সে বেটিকো বিনা ইলাজ মরতে হুয়ে নেহি দেখ সকতা মেয়, কম সে কম একদিন ভি মুঝে দেখকে পেহচান লে, একবার মু সে খানা খিলা দু, আখরি বার” হাত জোড়া চোখে জল। দৌড়ে প্রফেসরকে গিয়ে বললাম “স্যার একে একবার রেডিয়েশন দিয়ে দেখি যদি কিছু হয়।” উনি বললেন “করতে চাইছ কর কিন্তু খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না ”
স্ট্রেচারে করে এনে প্ল্যান করে রেডিয়েশন দিলাম। মনে রাখলাম বিখ্যাত রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট ও শিক্ষক প্রফেসর বি ডি গুপ্তার উপদেশ। “রেডিয়েশন দেওয়ার সুযোগ থাকলে অবশ্যই দেবে, মিরাকল ক্যান হ্যাপেন”। মেয়েটি পায়ে হেঁটে বাড়ি গেল বাবার হাত ধরে। বাবার চোখে দেখেছিলাম, না শুধু কৃতজ্ঞতা নয়, আমার প্রতি বিশ্বাস।
এই বিশ্বাসই আমাদের ডাক্তার বানায়, ডাক্তারি শেখায়। এঁরাই আমাদের প্রকৃত শিক্ষক। তাই শিক্ষক দিবসে এঁদের প্রণাম।