বিকেল হয়ে এলো। আমগাছের পাতার আড়ালে বেনে বৌ পাখিটা ডেকেই যাচ্ছে। পশ্চিম দিগন্তে ঘন মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। আধো অন্ধকারে এক কাপ চায়ের ইচ্ছে হয়। কিন্তু এ্যাতো করোনা রোগী দেখে বাইরে দোকানে গিয়ে আর রোগ ছড়াতে ইচ্ছে হয় না। তাই ইলেকট্রিক কেৎলিতে জল বসিয়ে টি ব্যাগের বাক্স হাতড়ানো। ঈস যদি আমার গান শোনার যন্ত্রটাও অন্ততঃ এ ঘরে থাকতো তাহলে প্রথম জীবনের মতো দেবব্রত বিশ্বাসের ‘গোধূলি গগনে মেঘে’ গানটা চালিয়ে চা খাওয়া যেতো।
তিনমাস আউট হাউসে বন্দী। একটা বাথ্রুম আর একটা ঘর। একই কম্পাউন্ডে একটু দূরে মা বাবার করা বাড়িতে সবাই আছে। মা কী যেনো বলছে। কথা বুঝতে পারি না। শুধুমাত্র আওয়াজটা শুনতে পাই। সবাই বোধহয় চা নিয়ে বসেছে। বাবা একবার বারান্দায় এসে আমার ঘরে আলো জ্বলেছে কিনা দেখে গেলো। সময় আর কাটে না। ইচ্ছে করছে সঈদ মুজতবা আলী সাহেবের দেশে বিদেশে আরেকবার পড়তে। রাতে খাবার দেবার আগে মণিকে- আমার মণিকাকে ফোনে বলে দেবো।
ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়া। দূরে কোথাও বৃষ্টি নেমেছে। আগামীকালের যুদ্ধের সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখি। পিপিই কিট, মাস্ক, লং হুড, গ্লাভ্ স্যানিটাইজার– সব কিছু সত্ত্বেও হয়তো আগামীকাল অথবা আগামী পরশু কিম্বা কোনও একদিন আমার জ্বর আসবে। আসবেই। ভাইরাল লোড বাড়ছে। এ্যাতো রোগী!
লোকজন আবার কেনো জানি না জ্বর হলে সেটা লুকিয়ে চেম্বারে আসে। মাস্ক নামিয়ে– বারবার বললেও ঠিক না করেই হাসি হাসি মুখে বলে ডাক্তার বাবু আমার খুব জ্বর আসতিছে– বুকে ব্যতা– গন্ধ পাই নাকো। আমার অসুখ হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। একজন এলো দাঁতে ব্যথা বলে। যখন দাঁত পরীক্ষা করে বললাম– কৈ কিছু নেই তো? তখন বললো আমার বড্ড জ্বর– গলায় ব্যথা – আসলে জ্বর বললে সরকার ধরে নিয়ে যাবে তাই…! স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। আজ স্টেথোটা স্টেরিলাইজ করতে ভুলে গেছি। দ্ধুর আর কী বা হবে?
ছেলে মেয়েদের পড়ার শব্দ পাচ্ছি। মা বোধহয় ঠাকুর ঘরে। আমার জীবনের জন্য ঠাকুরের সামনে বসে আছে। মণিকে একটা ফোন করি। গলাটা শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে। শুধু মনের নয়– তীব্র শরীরের ইচ্ছে। য্যানো ওর গলার শব্দটা আমার শরীরটাকে জড়িয়ে ধরবে। আপনি যাকে ফোন করছেন তিনি এখন আপনার ফোন ধরতে পারছেন না। দ্ধুর। ও নিশ্চয়ই বাচ্চাদের পড়াচ্ছে। হুঁঃ পড়ে পড়ে সব পন্ডিত জহরলাল নেহেরু হবে। অন্ততঃ মিসকলটা দেখে তো ফোনটা ব্যাক করবে!
মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। সব সময় মন-শরীর মানুষ সবাই কি যুক্তি মেনে চলে? রোমকূপে ক্রোধ জন্মায়। কিছু পরে পুষ্পদি রাতের খাবার দিয়ে যায়। মনে হয় থালাটা টান মেরে ফেলে দিই। পড়ে থাক। ছোটবেলার মতোন অভিমান হয়। বাইরে ফ্যান চলার মতোন খসখস শব্দ করে বৃষ্টি নামে। জানালার কার্নিশ থেকে– রেইন ওয়াটার পাইপ বেয়ে জল পড়তে থাকে। ক্ষিধে পায়। ঠান্ডা ভাত ঠান্ডা বাতাস ডাল মাছের ঝোল মিশিয়ে খেতে থাকি। এক টুকরো পেঁয়াজ– একটা লঙ্কা -সবাই জানে– মা’ও অথচ …… ফোন বেজে ওঠে “এই খেয়ে নিয়েছো? দ্যাখো না পুচাই কিছুতেই অঙ্ক করবে না … আমি ফোনটা শুনতেই পাই নি”। “খাচ্ছি”। “এমা সঅঅব তো ঠান্ডা জল … ঈস … রাগ করে না সোনা আমার” ফোনে চুম্বনের শব্দ হয়।
বৃষ্টি হতে থাকে। গাছের পাতা বেয়ে টুপটাপ জল পড়ে। আলো নিবিয়ে নিবিড় হয় রাত শরীরে প্রেমের বাতি জ্বলে ওঠে । চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই মণির কোলের কাছে পুচাই আর বালিশে বুক রেখে গাব্লু- অ্যাস্টেরিক্স পড়ছে। রাত আলোর মৃদু মায়ায় মণিকে আবছা দ্যাখা যায়। পুচাই কাঁদছে। ও বাবাকে খুঁজছে। যদিও ফোনে দ্যাখা হয়েছে তবু তো মেয়েটা আমার বুকের মধ্যে ঢুকেই তো ঘুমোতো। মণি ওকে সামলাতে পারবে না। যদি আমি ……কিন্তু সেতো হওয়ার নয় এখন চলছে এক আতঙ্কের দিনলিপি। দেখতে পাই আবছা আলোয় মণির গালের ডৌলটি। দেখতে পাই শরীরে লেগে থাকা রাত্রিবাসের ভেতরে অলৌকিক সম্পদের আভাস। উচ্ছৃত শরীর জড়িয়ে ধরে বিছানার পাশ বালিশ।
মিনিদের বাড়ির ঘড়িতে বারোটার ঘন্টা বেজে গেছে। আজ বৃষ্টি থামবে না। রাতভোর বৃষ্টিতে ভেসে যাবে– ধুয়ে যাবে সব না পাওয়া বেদনা। হঠাৎ ফোন বাজে। পাশ ফিরে ফোন ধরি। জেগে উঠি আমি। শরীর ঘুমায়ে পড়ে। “ডাক্তারবাবু একটা এমার্জেন্সির ব্যাপারে ফোন করছি– আমার স্বামীর তিনদিন ধরে জ্বর -নাকে গন্ধ নেই- শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, আপনি আগামীকাল বসবেন?”