ব্যক্তিত্ব হল মানুষের শারীরিক ও মানসিক তন্ত্রের গতিশীল সংগঠন যা পরিবেশের সাথে তার অভিযোজন নির্ধারণ করে। ব্যক্তিত্বের ইংরাজী প্রতিশব্দ ‘Personality’ শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ’ Persona’ থেকে। প্রাচীন গ্রিস দেশে নাট্য অভিনেতারা বিভিন্ন মুখোশ পরে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করতেন। ‘Persona ‘শব্দের অর্থ মুখোশ।
তাহলে প্রশ্ন উঠবে ব্যক্তিত্ব কিভাবে গড়ে ওঠে? ব্যক্তিত্বের বিকারই বা কেন দেখা দেয়? জন্মের পর থেকেই একটি শিশুকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়।সবার অভিযোজন ক্ষমতা সমান হয় না। সিগমন্ড ফ্রয়েডের মতে মানুষের মনের উপসত্তা তিনটি হল -ইড, ইগো এবং সুপার ইগো। সহজ ভাবে বললে “ইড” হল মানুষের পাশবিক প্রবৃত্তি এবং “সুপার ইগো” হল মানুষের বিবেক অর্থাৎ নৈতিকতা। “ইগো” চেষ্টা করে” ইড” ও “সুপার ইগো”র মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে।একটি শিশু কিভাবে, কোন পরিবেশে বড় হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে তার নৈতিক মূল্যবোধ ও পাশবিক প্রবৃত্তিগুলি (অর্থাৎ যথাক্রমে “সুপার ইগো” ও “ইড”) তৈরি হয়। আবার বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী” এরিক এরিকসন” ব্যক্তিত্বের মনোবৈজ্ঞানিক বিকাশের আটটি পর্যায়ের কথা বলেছেন। এক একটি ধাপ সফল ভাবে অতিক্রম করলে আমরা কিছু গুণাবলী লাভ করি যা আমাদের পরবর্তী ধাপে এগিয়ে চলার রসদ যোগায় এবং ক্রমশ আমাদের ব্যক্তিত্ব পূর্ণতা লাভ করে। অনেক সময় পরিবেশের প্রভাব,নানান অযাচিত ঘটনা জীবনপথের এই ধাপগুলো পেরিয়ে যাবার অন্তরায় হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথে বাধার সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্কের মধ্যে সেরোটোনিন অথবা মনোএমাইন অক্সিডেস ইত্যাদি রাসায়নিকের ঘাটতির সাথেও উগ্রতা, আবেগপ্রবণ মানসিকতার সম্পর্ক আছে। সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের আত্মীয়দের মধ্যে প্যারানোইড, সিজোইড, সিজোটেপাল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার বেশী দেখা যায়।
আমাদের আচার -আচারণ, চিন্তা-ভাবনা, পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়া- এসবই আমাদের ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভর করে। এই ব্যক্তিত্ব গঠনে কিছুটা যেমন জিনগত প্রভাব থাকে, তেমন কিছুটা থাকে যে পরিবেশে আমরা বেড়ে উঠি, তার প্রভাব।
ব্যক্তিত্বের সমস্যা থাকলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে নানান সমস্যা দেখা যায়। ব্যক্তিত্বের সমস্যা বা বিকার বিভিন্ন রকমের হতে পারে।
প্যারানোইড পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার
এনাদের মধ্যে সবাইকে সন্দেহ করার একটা প্রবণতা কাজ করে।আত্মীয় -স্বজন, বন্ধু -বান্ধব সবাইকেই এনারা অকারণে সন্দেহের চোখে দেখেন। কোন সাধারণ কথা শুনলেও এনাদের মনে হয় ওই কথাগুলো তাঁকে ভয় দেখানো বা বিদ্রুপ করার জন্য বলা হচ্ছে। এঁরা নিজেদের মধ্যে দীর্ঘদিন রাগ পুষে রাখেন। আমরা সাহিত্যে ‘মামলাবাজ লোক’ হিসাবে যে সব চরিত্র দেখি তাঁরা আসলে হয়তো এই জাতীয় পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত।
সিজোইড পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার
এনারা অন্য মানুষের সাথে মিশতে পারেন না। একা থাকতে পছন্দ করেন। অনেক সময় বিয়েও করেন না। এনারা আনন্দ অথবা দুঃখ কোনোটাই সহজে প্রকাশ করেন না, অপমান অথবা প্রশংসা কোনটাতেই উদ্বেলিত হন না।
এন্টিসোশ্যাল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার
এঁরা সামাজিক নীতি নিয়মের তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন অসামাজিক কাজ কর্মে জড়িয়ে পড়েন। প্রায়ই মিথ্যে কথা বলেন, আশেপাশের মানুষকে বোকা বানানোর জন্য ছল ও চাতুরির আশ্রয় নেন। অন্যের সাথে প্রায়ই ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন, দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে পারেন না, আবেগের বশে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন যার ফলাফল হয় মারাত্মক। ভুল করেও এদের অনুশোচনা হয় না। একই ভুল বার বার করেন।
বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার
এই জাতীয় রোগীরা সবসময় নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন, এঁদের মধ্যে সবসময় কাছের মানুষকে হারিয়ে ফেলার ভয় কাজ করে। এঁরা দুনিয়াকে সাদা-কালো ভাবে দেখেন। অর্থাৎ এঁদের কাছে কোন কিছু হয় খুব ভালো বা খুব খারাপ মনে হয়- মাঝামাঝি কিছু নেই। এঁরা নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না, ভাবনা চিন্তা না করে নানান সম্পর্কে সহজেই জড়িয়ে পড়েন। অনেকক্ষেত্রেই এঁরা আবেগের বশে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
হিস্ট্রিওনিক পারসোনালিটি
এঁরা সবসময় সবজায়গায় মধ্যমণি হয়ে থাকতে চান। সাজগোজের ওপর অনেকটা সময় ব্যয় করেন, উগ্র সাজগোজ ও উত্তেজক রকমের বেশভূষা ধারণ করেন। এনাদের কথাবার্তা সাধারণত আবেগতাড়িত ,অন্ত সারশুন্য ও নাটুকে হয়।
নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি
এনারা নিজেদের ক্ষমতা সম্বন্ধে অহংকারী হন, সবসময় উচ্চপদে এবং ক্ষমতার শীর্ষে থাকতে চান, সবসময় চান সবাই যাতে তাঁদের তোষামোদ করে চলেন, সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না, নিজেরটা ছাড়া অন্য কারোরই ভালো মন্দের খবর রাখেন না।
ডিপেন্ডেন্ট পারসোনালিটি
এঁরা অত্যন্ত ভীতু প্রকৃতির হন, একা কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না অথবা কাজ শুরু করতে পারেন না, দায়িত্ব অন্যের ওপর ছেড়ে দিতে চান, কোন কিছুতেই না বলতে পারেন না।
অবসেসিভ কম্পালসিভ পারসোনালিটি
এনারা দৈনন্দিন জীবনে নিয়ম-কানুন, রুটিন মেনে চলতে খুব পছন্দ করেন। রুটিনের বিন্দুমাত্র হেরফের হলে এঁরা খুব সমস্যায় পড়েন। এঁরা জীবনের সব কিছু নিখুঁত করতে চান, জীবনের আনন্দ উপভোগ না করে সবসময় নিজেকে কর্মক্ষেত্রেই আটকে রাখেন।
মানুষের ব্যক্তিত্ব কতটা উৎকৃষ্ট হবে সেটা যেমন তাঁর জিনগত বৈশিষ্টের ওপর নির্ভর করে, তেমনি তাঁর চারপাশের পরিবেশের ওপরেও নির্ভর করে। যদি কোন বাচ্চা ছোট থেকেই দেখে তার চারপাশের মানুষজন নেশা করছে, অসামাজিক কাজ কর্মে লিপ্ত হচ্ছে, তাহলে তার মধ্যে এন্টিসোশ্যাল পারসোনালিটি তৈরির সম্ভাবনা বাড়বে। যে সমস্ত শিশু ছোট বেলায় তীব্র শারীরিক ও যৌন উৎপীড়নের শিকার হয়, তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার, নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি, হিস্ট্রিওনিক পারসোনালিটি, এন্টিসোশ্যাল পারসোনালিটি দেখা যেতে পারে। যে সব বাচ্চাদের আত্মীয়রা তাদের খুব কড়া শাসনে রাখে অথবা মারধোর করে তারা বড় হলে তাদের মধ্যে এন্টিসোশ্যাল পারসোনালিটি দেখা যেতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে ৪০ বছরের পর থেকে এই জাতীয় রোগের তীব্রতা কমে আসে। যেমন এন্টিসোশ্যাল পারসোনালিটি, বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার -এগুলির ক্ষেত্রে এমন ঘটতে পারে। পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারের সাথে সাথে অন্য মানসিক সমস্যা যেমন ডিপ্রেশন, উদ্বিগ্নতার সমস্যা ইত্যাদিও দেখা যায়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে এন্টিডিপ্রেসেন্ট, সিডেটিভ, মুড স্টেবিলিজার, এন্টিসাইকোটিক ইত্যাদি মেডিসিন ব্যবহৃত হয়। অনেক ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং দরকার হয়।ডায়ালেকটিক্যাল বিহেভিয়ার থেরাপি নামের একজাতীয় কাউন্সেলিং পদ্ধতি বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার রোগের গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি।