“I had a little bird
Its name was Enza
I opened the window
And in-flew-enza,”
অনুবাদ করা গেল না। তবে ইন-ফ্লিউ-এঞ্জা যে আদতে ইনফ্লুয়েঞ্জা – সেটুকু অনুমান করা গিয়েছে নিশ্চিত।
এ ছড়া একশো বছর আগেকার – সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় আট কোটি মানুষের প্রাণ নিয়েছিল যে স্প্যানিশ ফ্লু, সেই প্রসঙ্গেই এই ছড়া, যা কিনা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা স্কিপিং করার সময় আওড়াতো – জানালা খুলে রাখার মতো একেবারে সাধারণ দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দিয়েও যে ঢুকে পড়তে পারে সাক্ষাৎ মৃত্যু, শিশুদের এই ছড়ার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সেই আতঙ্ক।
ছেলেমানুষি ছড়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকে সমাজের ছবি – এই ছড়ার ক্ষেত্রে সে ছবি আতঙ্কের। শিশুরা কি অনুভব করেছিল মৃত্যুর হিমশীতল চাহনি? শিশুবয়সে মৃত্যুকে নিয়ে ছড়া কেটে বড় হয়ে উঠল যারা, তারা প্রাপ্তবয়সে মৃত্যুকে দেখল ঠিক কোন চোখে??
আর সংবেদনশীল মানুষজনের মধ্যে যাঁরা আক্রান্ত হয়েছিলেন সেই মারণরোগে? তাঁরাই বা কেমন চোখে দেখেছিলেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাক্ষাৎ মৃত্যুকে? কেমনভাবে দেখেছিলেন অসুস্থতা আর আরোগ্যকে? অনিবার্য গৃহবন্দিত্বকে??
একজন শিল্পীর দুখানা ছবি নিয়ে একটু কথা বলা যাক।
শিল্পীর নাম এডওয়ার্ড মুনখ (Edvard Munch) – নরওয়ের মানুষ তিনি। মুনখ-এর নাম যাঁরা শোনেননি, তাঁদের একটা বড় অংশ জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে তাঁর আঁকা আর্তনাদের ছবি দেখে ফেলেছেন (The Scream) – সে ছবি প্রথাগত চিত্রশিল্পের গন্ডী ছাড়িয়ে জনসংস্কৃতি এবং বিজ্ঞাপনী সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই – এমনকি, বিস্ময়ের ওয়াও প্রকাশ করতে যে ইমোজি ব্যবহার করেন, তার মধ্যেও অনিবার্য সেই দ্য স্ক্রীম-এর ছায়া। কিন্তু, এডওয়ার্ড মুনখ-এর জীবন, তাঁর শিল্প বা শিল্পীমনন নিয়ে একটা সামগ্রিক আলোচনা করতে বসিনি এযাত্রা। আজ কথা বলব, তাঁর দুখানা ছবি নিয়ে – দুটি মাত্র ছবি নিয়েই।
ছবি দুটি – স্প্যানিশ ফ্লু-তে ভোগার সময় আত্মপ্রতিকৃতি এবং স্প্যানিশ ফ্লু থেকে উঠে আত্মপ্রতিকৃতি।
“শারীরিক অসুস্থতা, মানসিক অসুস্থতা, মৃত্যু প্রায় আমার জীবনের শুরুর দিন থেকেই আমার শিশুবয়সের দোলনার ওপরে উঁকি মেরে দাঁড়িয়ে থেকেছে – সারা জীবন আমার সঙ্গী হয়েছে।’ নিজের জীবন প্রসঙ্গে বলেছিলেন তিনি। পাঁচ বছর বয়সে মা-কে হারান তিনি – পিঠোপিঠি দিদিকে হারান চোদ্দ বছর বয়সে। দুটি মৃত্যুই গভীর প্রভাব ফেলে তাঁর মনে। নিজেও মানসিক অসুস্থতার শিকার হয়ে ভর্তি ছিলেন অ্যাসাইলামে। তাঁর শিল্পীমানস এসব মিলিয়েই। কাজেই, নিজের সম্পর্কে তাঁর যে কথাটি উদ্ধৃত করলাম এই অনুচ্ছেদের শুরুতেই, সে বিন্দুমাত্র অতিকথন বা দুঃখবিলাস নয়। নিজের জীবন আর নিজের ছবি নিয়ে বলতে গিয়ে মুনখ আরো বলেছিলেন – “নিজের জীবনের যতটুকু মনে পড়ে, আশৈশব আমি ভুগেছি এক চূড়ান্ত উৎকন্ঠায়, যে উৎকন্ঠাকে আমি প্রকাশ করতে চেয়েছি আমার ছবির মধ্যে দিয়ে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার জীবনে এই অসুস্থতা-রোগভোগ আর উৎকন্ঠা যদি না থাকত, তাহলে আমি হয়ত মাস্তুলহীন এক জাহাজের মতো দিগভ্রান্ত হয়ে থাকতাম।”
কিন্তু, এই করোনার বাজারে শুধুই অসুস্থতা-রোগভোগ-মৃত্যু বা তজ্জনিত উৎকন্ঠার ছবি নিয়ে কথা বলব না – বলব সেরে ওঠার কথা – সেরে ওঠার ছবির কথা।
প্রথম ছবিটি – সেল্ফ-পোর্ট্রেট উইথ দ্য স্প্যানিশ ফ্লু। ক্যানভাসের উপর তেলরঙ। ছবির প্রতিরূপ থেকে মূল ছবির আন্দাজ পাওয়া মুশকিল – কিন্তু, এ ছাড়া তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপায় থাকে না। ছবির বিস্তৃতি বিষয়ে একটা আন্দাজ পেতে গেলে মূল ছবির মাপ জানা জরুরী – এ ছবি বেশ বড় মাপের – উচ্চতায় প্রায় পাঁচ ফুট – চওড়ায় সাড়ে একান্ন ইঞ্চি, অর্থাৎ প্রায় সোয়া চার ফুট।
Edvard Munch – Self-Portrait with the Spanish Flu
এ ছবি আঁকা হয় ১৯১৯ সালে – স্প্যানিশ ফ্লু প্যান্ডেমিক তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বজুড়ে – আক্রান্ত মুনখ-ও।
ছবির একপাশে একটি চেয়ারে বসে রয়েছেন শিল্পী – একটু ওপাশে অবিন্যস্ত বিছানা – বুঝতে অসুবিধে হয় না, বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছেন তিনি – কিন্তু, সে বসে থাকা তাৎক্ষণিক – অনতিবিলম্বে তিনি ফিরবেন ওই বিছানায়। অসুস্থতা আমাদের একাকী করে – ছোঁয়াচে অসুখ তো আরো বেশী করে নিঃসঙ্গ করে দেয় – মুনখ-এর এই ছবিও একাকিত্বের – ছবির একটা বড় অংশ জুড়ে দেওয়াল – বিবর্ণ দেওয়াল – সে দেওয়ালের রঙ বিবর্ণ হলদেটে কমলা – প্রায় গেরুয়ার কাছাকাছি – আকাঙ্ক্ষাহীনতার প্রতীক যে গেরুয়া, সে রঙের ব্যবহার ছবিতে এনেছে দৈনন্দিন জীবন বিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলার আভাস – দেওয়ালের অংশত লাল রঙের উত্তাপে যেন প্রতিফলিত শিল্পীর জ্বরে পুড়ে যাওয়া শরীর – ছবিতে পার্সপেক্টিভের ব্যবহার এমন যে ছবির মধ্যে ত্রিমাত্রিকতার আভাস ন্যূনতম – অসুস্থ শিল্পীর অবসন্ন অস্তিত্ব যেন জরুরী তৃতীয় মাত্রাটুকু হারিয়েছে।
ছবি জুড়ে বেশ কিছু আঁকাবাঁকা লাইন – রঙ চাপানোর ক্ষেত্রেও তাই – কিন্তু দ্য স্ক্রীম (আর্তনাদ) ছবির মতো বাঁকা লাইন ছবিকে নিয়ন্ত্রণ করছে না – যে আঁকাবাঁকা লাইন, মুখ্যত, আবেগের প্রকাশ – এ ছবি, সে দিক থেকে দেখলে, আবেগ হারিয়েছে। না, ছবি আবেগ হারায়নি – অসুস্থতা আর একাকিত্বের ক্লান্তিতে শিল্পী অবসন্ন – শিল্পীর মুখের রঙ লক্ষ্য করুন – সে রঙ প্রায় দেওয়ালের রঙের সাথে মিশে থাকা পাণ্ডুর, বিবর্ণ – আবেগ বলতে, ঘরের ওই দেওয়াল যেন তাঁকে উত্তরোত্তর গিলে খাচ্ছে।
অসুস্থতা নিয়ে বলতে গিয়ে সুসান সন্তাগ লিখেছিলেন – জীবনের রাত্রির দিকটা হল অসুস্থতা। জন্মের সাথে সাথেই সবাই অর্জন করে দ্বৈত নাগরিকত্ব – একটি দেশে সুস্থ মানুষদের রাজত্ব, অপরটি অসুস্থদের। যদিও আমরা সবাই সুস্থ রাজত্বের পাসপোর্টটিই কাজে লাগাতে চাই সর্বদা, কখনও না কখনও, অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও, আমাদের মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়, হ্যাঁ, আমরা আপাতত অসুস্থদের জন্যে নির্ধারিত দেশটির নাগরিক।
পূর্ববর্ণিত ছবিটিতে মুনখ যদি অসুস্থদের জন্যে নির্ধারিত দেশটির নাগরিক থাকতে বাধ্য হন, তাহলে তার পরের ছবি – সেল্ফ-পোর্ট্রেট আফটার দ্য স্প্যানিশ ফ্লু। না, এখানে মুনখ সুস্থদের দেশটিতে পুরোপুরি প্রবেশাধিকার পাননি – বলা যায়, সে দেশে প্রবেশের জন্যে অভিবাসন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছেন।
একই বছরে আঁকা – অর্থাৎ ওই ১৯১৯ – মাপেও কাছাকাছি – অর্থাৎ দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট, চওড়ায় সোয়া চার – মাধ্যমও একই, ক্যানভাসে তেলরঙ।
Edvard Munch – Self-Portrait after the Spanish Flu
কিন্তু, আগের ছবিটির সাথে ফারাকটা দেখুন। এ ছবি দীর্ঘ অসুস্থতার শেষে সুস্থ সবল জীবনে ফিরে আসার – মারণরোগ থেকে আশাময়তায় ফেরার।
এ ছবি রঙবহুল – সবুজের ব্যবহার প্রচুর। না, নতুন প্রাণের কচি সবুজবর্ণ নয় – জটিল অসুস্থতা থেকে ফিরে আসার ক্লেদ আর ক্লান্তি মিলে গাঢ় বর্ণ – অন্ধকারের – তবু সে অন্ধকার সবুজের – প্রাণের। ছবির একেবারে সামনে পুরোটা জুড়ে শিল্পী – আগের ছবির তুলনায় মুখে রঙ ফিরেছে – উসকোখুসকো, না-কাটা দাড়ি, কোটরে ঢোকা চোখ – তবু আগের ছবির বিবর্ণ নিরক্ত পাংশু মুখের তুলনায় আরোগ্য এবং নবজীবনের ছাপ স্পষ্ট।
পার্সপেক্টিভের ব্যবহারটাও লক্ষ্যণীয়। আগের ছবি যেমন ফ্ল্যাট, দ্বিমাত্রিক, সে তুলনায় এ ছবি স্পষ্টতই ত্রিমাত্রিক – পুরোভাগে শিল্পী – পিছনে দেখা যাচ্ছে তাঁর ঘরের কিছু অংশ – পার্সপেক্টিভের চতুর ব্যবহারে সে ঘর যেন বেশ কিছুটা পেছনে রয়ে যাচ্ছে – অসুস্থ জীবনের ঘরবন্দী দশা থেকে বেরিয়ে আসছেন শিল্পী – এ ছবি আরোগ্যের দিকে এগোনোর। আরো লক্ষ্যণীয় – আগের ছবির দমচাপা ভাব এ ছবিতে উধাও – সবুজ ছড়িয়ে পড়েছে নিজের মুখ থেকে দেওয়ালে, আসবাবে – দেওয়ালে দেখা যাচ্ছে জানালা, বহির্জগতের আভাস।
সম্মুখভাগে শিল্পী নিজেই ছবিখানাকে এমনভাবে ভরে রেখেছেন, যে পেছনে দেখা যাওয়া ঘর আপাত শূন্য হলেও, এ ছবি তেমনভাবে নিঃসঙ্গতার বার্তা দেয় না – ছবিখানা সচল জীবনের।
একশো বছর আগে, এমনই এক অতিমারীর সময়ে এক যুগন্ধর শিল্পী ধরেছিলেন নিজের অসুস্থতাকে – সেই অসুস্থতা অতিক্রম করে সুস্থতার দিকে যাত্রাকে – রোগভোগ ও আরোগ্যলাভ, দুটি অনুভবকে পৃথক দুই ক্যানভাসে।
এই মুহূর্তে, এমনই ঘরবন্দী হয়ে কাটাচ্ছেন তামাম বিশ্বের এক বিরাট অংশের মানুষ – কয়েক লক্ষের বেশী মানুষ আক্রান্ত, সংক্রামিত বহুগুণ – মুনখের প্রথম ছবিটির মতো বিবর্ণ পাণ্ডুর জীবন এই মুহূর্তে এ পৃথিবীর বিভিন্ন কোণায় অসংখ্য মানুষের।
কিন্তু, কোনো বিবর্ণতা, কোনো অসুস্থতাই চিরস্থায়ী নয়। ঝরে যাওয়া ডালপালার জায়গায় ফুটে ওঠে কচি পাতা – বিবর্ণ পাণ্ডুর পারিপার্শ্বিকে আসে সবুজের ছোঁয়া। অসুস্থতা অনিবার্য হলে, আরোগ্যও তা-ই – হয়ত আরো বেশী করে সত্য, অন্তত বৃহত্তর প্রেক্ষিতে তো বটেই।
এটাই জীবন। জীবন এমনই।
খুবই অন্যরকম, বৈচিত্র্যে ভরা লেখা। খুব ভাল লাগল। এ-ধরণের লেখা সচরাচর পড়তে পাই না।
ছবির মতোই লেখার পার্সপেক্টিভটা চমকপ্রদ অথচ গভীর। হতাশার হাত ধরে থেকেও অনিবার্য আশার হাত না ছাড়ার প্রতিশ্রুতি।
ছবি দেখাও শিখতে হয়, না শিখে তারিফও করা যায় না। আবার শিখলাম, আর আবারও ধন্যবাদার্হ হলেন আপনি ?
শেষ পর্যন্ত শিল্পী জীবনের জয়গানই গেয়েছেন।দিনের পরে রাত যেমন সত্য,রাতের পরে দিন ও সত্য, এই বলিষ্ঠ আশাবাদ ই আমাদের অগ্রগামী অধঃপাতের দিকে এগোতে বাধা দেয়, ছবিগুলোর পর্যালোচনা এমন মোলায়েম ভাষায় করেছেন বিষান দা যেন মনে হচ্ছে “জলের মত ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কয়”
খুব সুন্দর একখানি লেখা তার মধ্যে ব্যাখ্যা কি অপূর্ব ?
Like!! Great article post.Really thank you! Really Cool.
These are actually great ideas in concerning blogging.
I really like and appreciate your blog post.
Very good article! We are linking to this particularly great content on our site. Keep up the great writing.